এক...দুই...তিন...চার, অবশেষে থামল তার ছুটে চলা। নিস্তেজ হয়ে শুয়ে পড়লো মাঠে। বিভ্রম নিয়ে ধেয়ে আসা মায়াবি বলটার গতিপথ বুঝে ওঠার আগেই উড়ুপথে ঘুরতে ঘুরতে এভাবেই চার-চারবার ডিগবাজি খেল পেছনের অফ স্ট্যাম্পটা। মোস্তাফিজের বিভ্রান্ত জাগানিয়া বুদ্ধিদীপ্ত বিষাক্ত কাটারে পরিসমাপ্তি ঘটল ব্যাট হাতে অজি অধিনায়ক ম্যাথু ওয়েড অধ্যায়ের। ফিরলেন সাজঘরে। পরবর্তী বলটা যেন আরো মন্ত্রমুগ্ধ, এস্টন অ্যাগের চোখ দুটিই যেন বলে দিচ্ছিল বাস্তবতা। কিভাবে প্রথম বলেই প্যাভিলিয়নের পথ ধরলেন বুঝে উঠতেই যেন পারছিলেন না!

▪ দুই
মার্শ-হ্যানরিকুয়েস জুটি তখন অর্ধশতক ছাড়িয়েছে। বুঝে-শুনে হাত খুলে শট খেলতেও শুরু করেছেন। গত ম্যাচের ম্যাচ সেরা নাসুমের স্পিন ধরছেন না, হেসেখেলে তাকে খেলছেন ওরা। লক্ষ্য তখন অনেক বড়, গড়তে হবে রান পাহাড়। মনে নিশ্চয়ই গত ম্যাচ হারের প্রতিশোধ নেবার স্পৃহা। তাদের এমন আগ্রাসনে, ভয় তখন কোটি বাঙালির মনে। মিরপুরে ১৫০ মানেই তো জয়ের সম্ভাবনা। চোখে যখন সর্ষে ফুল, বরাবরের মতো তখন একজনই ত্রাতা। তিনি সাকিব আল হাসান। বোলিংয়ে তার খুব বেশি বৈচিত্র নেই। কিন্তু মাথায় বুদ্ধিতে ভরা, বুদ্ধিদীপ্ত বোলিংয়ে তিনিই সেরা। কেন সেরা, তাই যেন ভয়ঙ্কর হতে থাকা হ্যানরিকুয়েসকে বিদায় করে আরো একবার জানান দেয়া।

▪ তিন
মিচেল মার্শ দারুণ ফর্মে আছেন। সদ্য শেষ হওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজেও যার দেখা মিলেছে, বাংলাদেশে এসেও অল্প সময়েই খাপ খাইয়ে নিয়েছেন নিজেকে। নিজেকে কতটা বাংলার আবহাওয়া মানিয়ে নিয়েছেন৷ বোঝা গেছে প্রথম ম্যাচেই। তবে শেষটা রাঙাতে পারেননি। কিন্তু সেদিনে অতৃপ্তি আজ মেটাতে শুরু হতেই ছিলেন দৃঢ়প্রত্যয়ী। ব্যাটে বল আসছিল সমতালেই বলা চলে। হ্যানরিকুয়েসকে সাথে নিয়ে সাহসী ব্যাটিংই করছিলেন নিঃসন্দেহে। তবে সাকিবের শিকার হয়ে হ্যানরিকুয়েস ফিরলেও তিনি ছিলেন দলের ভরসা হয়ে। কিন্তু পুড়ে পুড়ে খাঁটি হওয়া এক বাঙালি বোলার যে ছিলেন শিকারের খোঁজে। শরিফুল নামের অখ্যাত শিকারীর হাতে যখন তিনি শিকার হলেন, ততক্ষণে গত ম্যাচের মতো এ দিনও পৌঁছে গেছিলেন ৪৫ রানে!

▪ চার
মিরপুরে বেড়ে উঠেও মিরপুররের মাটিকে চিনতে না পারা অন্যায়ই বটে। ওই অন্যায়টাই তিনি করলেন পর পর দুই ম্যাচে। অথচ সদ্য সমাপ্ত জিম্বাবুয়ে সিরিজে সিরিজ সেরা হওয়ায়, অনেকের চোখে বড় স্বপ্ন ছিল তাকে ঘিরে। প্রথম ম্যাচের আউটটাকে আত্মহত্যাই বলা চলে, তবে তবুও আশা ছিলো দ্বিতীয় ম্যাচটাকে নিয়ে। দলের দুই নিয়মিত ওপেনারের বিরতিতে তার ওপর দায়িত্বটাও ছিলো অন্য সময় থেকে একটু বেশিই নিঃসন্দেহে। বিশেষ করে অস্ট্রেলিয়ার মতো বড় দলের বিপক্ষে উদ্বোধনীতে নাইমকে নিয়ে দারুণ ভিত্তি গড়ে দিয়ে আলো কেড়ে নিতে পারতেন নিজের দিকে। দেখা যাক কী হয়, আরো তো তিন ম্যাচ বাকি আছে।

▪ পাঁচ
সূর্যের শুভ্র আলো যাদের ছড়ানোর কথা, তাদের হাতেই এসেছে কালো মেঘের ঘনঘটা। সৌম্য ফিরেছেন শূন্য রানে। গত ম্যাচে রান পাওয়া নাইম শেখও আজ নিস্তব্ধ। দুই ওপেনারের সম্মিলিত রান এদিন দুই অঙ্ক ছুঁতে ব্যর্থ। কি হবে এবার? প্রশ্নের উত্তরে তার দিকেই চোখ সবার। তিনি বাংলাদেশের বিশ্বসেরা সাকিব আল হাসান। গত ম্যাচের মতো কম্পমান নৌকার বৈঠাটা হাতে নিয়ে হাল ধরলেন মেহেদীকে সাথে নিয়ে। সাহস সঞ্চয়ে শুরুতেই মন দিলেন আগ্রাসনে। স্টার্কের হাত ছুঁয়ে ধেয়ে বলগুলো পাঠালেন সিদ্ধহস্তে সীমানার ওপারে। এভাবেই পথ দেখিয়েছেন দলকে, হাসি ফুটিয়েছেন মানচিত্রের মুখে।

▪ ছয়
ক্রিকেট তো এমনি, কখন কী হয়ে যায়, যায় না তো বলা। কথায় আছে ‘ক্রিকেট গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা।' অনিশ্চয়তাটা কখনো আসে প্রতিপক্ষের তুখোড় পরিকল্পনায়, কখনো নিজের হেলায়। এদিন কী হয়েছিল, তা নিজেরাই ভালো বোঝেন। তবে দারুণভাবে জয়ের পথে চলতে থাকা দলটার ৮.৩ ওভার থেকে ৯.৩ ওভারে পা ফসকেছে দুই-দুইবার। যার ফলে ৫৮/২ থেকে ৫৯/৪ হয়েছে মাত্র কিছু সামান্য সময়ের ব্যবধানে। অভিজ্ঞ দুই সেনানির এমন বিদায়ে ১২১-এর ছোট লক্ষ্যও তখন ভয়ের কারণ।

▪ সাত
অপার সম্ভাবনার পাহাড় নিয়ে লাল-সবুজের দলে কতই না দেখা মিলেছে নতুন মুখের৷ কিন্তু সময়ের সাথে অযত্ন অবহেলায়, কখনো বা নিজের হেলায় হারিয়েছে তারা বহু দূরে। তবে তাদের মাঝে আফিফ নামটা একটু ভিন্ন। তার মাঝে অনেকেই খুঁজে পান সাকিব আল হাসানের মন্ত্র। বিশেষ করে চাপের মুখে ম্যাচ বের করে আনার সক্ষমতা তাকে দিয়েছে ভিন্নতা। বিশ্লেষকদের বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে একটু যত্ন নিলে আফিফই হতে পারেন বাংলাদেশেরর মিডল অর্ডারের রত্ন। মিডল অর্ডারে কেন হবেন ভরসা, ব্যাট হাতেই যেন দিলেন জবাবটা। গত ম্যাচের ন্যায় আজও পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নদের সম্মুখেও দেখিয়েছেন তার আত্মবিশ্বাসের পারদ কতটা!

▪ আট
দুই অভিজ্ঞ মাঝির এমন বিদায়ে তরীর তীরে পৌঁছা নিয়ে ভাগ্যের আকাশে যখন সংশয়ের কালো মেঘ দানা বেঁধেছে, এরই মাঝে আবার বার বার পা ফসকানো মেহেদীও জলে ডুবেছে; তখন শেষ ভরসা হয়ে স্রোতের বিপরীতে লড়ে চলেছেন দুজন। বুঝে শুনে অবস্থা দেখে ঠান্ডা মাথায় আফিফ-সোহান হাল ধরেছেন স্রোতে কম্পমান নৌকাটার, লক্ষ্য একটাই; জয়ের বন্দরে নোঙর ফেলানো। দৃঢ়প্রত্যয়ী থেকেছেন দুজনেই, দেখে দেখে বল বুঝে, দুজনে মিলে আছড়ে ফেলেছেন সীমানার ওপারে। আফিফের ৬ বাউন্ডারির শেষটা যখন সীমানায় চুমু খায়, জয়ের আনন্দে দুজনের হাত তখন মুষ্টিবদ্ধ!

▪ নয়
গুঞ্জন উঠেছিল, ভয় হচ্ছিল। ডিআরএস থাকবে না শোনা যাচ্ছিল। এতো বড় সিরিজ ডিআরএসহীন, ভাবতেই কেমন লাগে তাই না? যাহোক, ডিআরএস থাকবে না শুনে আম্পায়ারদের নিয়ে মজা করা হচ্ছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। যদিও দায়টা তাদেরই বলা চলে। তবে এই সমালোচনা যে হিতে বিপরীত হবে কে ভেবেছিল তা? ভাগ্যিস শেষ মুহূর্তে ডিআরএসের সংযোজন হয়েছিল। নইলে কী হতো, ভাবলেই বুকটা কেঁপে উঠছে নিজের অজান্তেই, আনমনে!