আফগানিস্তান সঙ্কট : সামরিক পন্থাই সমাধান?
আফগানিস্তান সঙ্কট : সামরিক পন্থাই সমাধান? - ছবি : সংগৃহীত
আফগানিস্তানে চলমান অচলাবস্থায় সশস্ত্র পন্থাকেই সঙ্কট সমাধানের উপায় মনে করছে উভয় পক্ষ। কাতারের দোহায় আফগান শান্তি চুক্তি সই হলেও শান্তির দেখা পায়নি যুদ্ধবিধস্ত আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষ।
চুক্তি অনুযায়ী ১ মে সকল বিদেশী সৈন্য প্রত্যাহারের কথা থাকলেও তা এখনো সম্ভব হয়নি নানা হিসাব নিকাশের ফাঁক-ফোকরে। আমেরিকার নেতৃত্বে ন্যাটো সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর দেশটির শাসন ক্ষমতায় কারা থাকবে- এ নিয়ে সকল আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। তালেবান বর্তমান সরকারকে দেশ শাসনের অনুপযুক্ত মনে করে। তারা মনে করে, কাবুল সরকার পরাধীনতার প্রতীক। তাই এই সরকার পদত্যাগ করার মাধ্যমে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হওয়ার মাধ্যমে দেশের নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে (তা অবশ্যই হতে হবে ইসলামি শরিয়াহ মোতাবেক) দেশের চলমান অচলাবস্থা দূর করা সম্ভব। কিন্তু বিপরীত দিকে কাবুল সরকারের দাবি হলো, তালেবান বর্তমান সরকারের কাছে আত্মসমর্পণ করার মাধ্যমে দেশের সকল সঙ্কট দূর করা সম্ভব হবে। এমনকি প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে তার বর্তমান ক্ষমতার মেয়াদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আগাম নির্বাচনও তিনি দিবেন না।এত গেল দেশের অভ্যন্তরে তালেবান কাবুল রিজিমের ক্ষমতাকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব।
কিন্তু আঞ্চলিক শক্তিশালী দেশগুলো ও পরাশক্তি দেশগুলো কে কী ভাবছে সেসব বিষয়কেও মুল্যায়ন করতে হবে। কারণ, আফগান বিষয়ে তারা দৃশ্যত দুটি ব্লকে ভাগ হয়ে দুপক্ষকে গোপনে অথবা প্রকাশ্যেই সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। ঈদুল আজহার আগে দু'পক্ষ যুদ্ধ বিরতির প্রশ্নে একমত হতে পারেনি। তালেবান দাবি জানিয়েছিল, তাদের পাঁচ হাজার বন্দিকে মুক্তির বিনিময়ে ছয় মাসের যুদ্ধ বিরতির জন্য তারা প্রস্তুত আছে। কিন্তু কাবুল সরকার তাতে সম্মত হতে পারেনি। এরপর কোনো সমঝোতা ছাড়াই ইরানের আমন্ত্রণে অনুষ্ঠিত আন্তঃআফগান আলোচনা শেষ হয়।
তালেবান ঈদুল আজহা উপলক্ষে তিন দিনের এককতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণ করেছিল। কিন্তু উভয় পক্ষ আলোচনা চালিয়ে যেতে তখন পর্যন্ত যথেষ্ট আন্তরিক ছিলো বলেই মনে হয়। কিন্তু ঈদুল আজহা নামাজ চলাকালে কাবুল সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা কর্মচারীদের খুব কাছে রকেট হামলা হয়। কাবুল প্রশাসন এ হামলার জন্য তালেবানকে দায়ী করে এবং আশরাফ গনি বেশ শক্ত ভাষায় এর প্রতিক্রিয়া জানায়। তিনি বলেন, তার ক্ষমতার শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তালেবানকে প্রতিরোধ করে যাবেন। তালেবান ওই হামলার দায় অস্বীকার করে।পরে ইসলামিক স্টেট ওই হামলার দায় স্বীকার করে।
এরই মধ্যে তুরস্কের কাবুল বিমান বন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বে সেনা প্রত্যাহার না করে, ন্যাটো সৈন্য প্রত্যাহারের পরও তাদের অবস্থানকে তালেবান আগ্রাসন হিসেবে বিবেচনা করবে বলে জানিয়েছে। তুরস্কের সাথে আলোচনার আগ্রহ প্রকাশ করে তালেবান। কিন্তু আলোচনা ফলপ্রসূ হওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। এদিকে তুরস্ক কাবুল সরকারের বিশেষ ইউনিটকে উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য তুরস্কে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। এছাড়া তুরস্ক আমেরিকার সাথে ন্যাটো সৈন্য প্রত্যাহারের পর তৃতীয় কোনো দেশে কাবুল সরকারের সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। এবং প্রাথমিকভাবে কাতারে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটি ব্যবহারের জন্য কাতারের সাথে আলোচনার অব্যাহত থাকার মাঝেই, তুরস্ক সরাসরি কাবুল সেনাদের প্রশিক্ষণ নিজ দেশের মাটিতে আয়োজন করাকে তালেবান ভালোভাবে নেবে না।
এছাড়াও পাকিস্তান ও হাঙ্গেরিকে সাথে নিয়ে কাবুল বিমান বন্দরের দায়িত্ব নেয়ার প্রস্তাব আমেরিকার কাছে দিলেও, সম্প্রতি পাকিস্তান চীনের সাথে মিলে আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা আনয়নে ৫ দফা যৌথ প্রস্তাব ঘোষণা করেছে। এতে স্পষ্ট বলা যায়, তুরস্কের সাথে কাজ করার চেয়ে চীনের সাথে কাজ করায় বেশি স্বার্থগত লাভালাভ দেখছে পাকিস্তান। কারণ পাকিস্তান যেকোনো মূল্যে আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা চায়। এতে তালেবান ক্ষমতা এককভাবে দখল করলেও পাকিস্তান অখুশি হবে না। চীনের অবস্থান এর চেয়ে ভিন্ন কিছু, এমনটি মনে হয় না। কিন্তু তুরস্ক একে তো ন্যাটো সদস্য, তার ওপর তালেবান তুরস্ককে আফগানিস্তানের অন্য তুর্কি জনগোষ্ঠীকে তালেবানের বিরুদ্ধে উস্কানি দেয়ার ব্যাপারে বরাবরই সন্দেহ করে আসছে।
এর যথেষ্ট কারণও রয়েছে এরদোগান তালেবানকে আফগানিস্তানের অন্য জাতিগোষ্ঠীর ওপর আগ্রাসন চালানোর অভিযোগ করে তা বন্ধ করার আহ্বান করে উপদেশ দিয়েছে। উজবেক কমান্ডার রশিদ দোস্তম এখনো তুরস্কের আশ্রয়ে রয়েছেন। বিষয়টি তুরস্ক তালেবান সম্পর্কের ভবিষ্যতকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। তাই তুরস্কের সাথে আফগান বিষয়ে অভিন্ন স্বার্থ দেখতে পাচ্ছে না পাকিস্তান। অন্য দিকে চীন যেমন পাকিস্তানের পরীক্ষিত বন্ধু, তেমনি আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতার প্রশ্নে, তাদের অভিন্ন স্বার্থই আফগানিস্তান বিষয়ে চীন পাকিস্তানকে একই সরলরেখায় নিয়ে এসেছে। এছাড়া তালেবান ইরান, রাশিয়ার সাথে আগের শত্রুতাপূর্ণ সম্পর্ক থেকে সরে এসে কৌশলগত বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করছে, এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলছে। যা এই দুই দেশের সাথে কাবুল প্রশাসনের দূরত্ব তৈরি করতে পেরেছে।
সেনা প্রত্যাহরের পর কাবুল সরকারের নাটকীয় বিপর্যস্ত অবস্থায় আমেরিকা নড়েচড়ে বসেছে। চুক্তি ভঙ্গ করে তালেবানকে লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন ও সেনাবাহিনীর প্রধান কেনেথ ম্যাকেন্জি এরূপ হামলা অব্যাহত থাকবে বলেও জানিয়েছেন। কারণ হিসেবে তারা কাবুল সরকারে নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসেন।
এছাড়া বাইডেন আশরাফ গনিকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত যাবতীয় বেপারে সাহায্য সহোযোগিতা এবং ফি বছর চার বিলিয়ন অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রুতির আশ্বাস দিয়েছে। ২০২২ অর্থ বছরে আফগানিস্তানের কাবুল সরকারকে ৩.৩ বিলিয়ন অর্থ সহায়তার ব্যাপারটি নিশ্চিত করেছে।যার মধ্যে আফগান বিমান বাহিনী এবং বিশেষ মিশন উইংকে সহায়তা করার জন্য এক বিলিয়ন ডলার, জ্বালানি, গোলাবারুদ এবং খুচরা যন্ত্রাংশের জন্য এক বিলিয়ন ডলার এবং আফগান সৈন্যদের বেতন দিতে ৭০০ মিলিয়ন ডলার অন্তর্ভুক্ত।
এছাড়াও আমেরিকা ৩১ আগষ্টের পর আফগানিস্তানের কাবুল সরকারকে আকাশপথে সহায়তার জন্য আফগানিস্তানের বাইরের কোনো ঘাঁটি ব্যবহারের কথাটিও নিশ্চিত করছে একাধিক মাধ্যম।
আমেরিকান একাধিক গোয়ন্দা রিপোর্ট বলছে, সেনাপ্রত্যাহরের পর ৬ মাসের মধ্যে কাবুল সরকারের পতন হতে পারে। যার সত্যতার বিষয়টি এখন পরিষ্কার। কারণ, ইতিমধ্যেই ১ মে থেকে এখন পর্যন্ত দেশের ৮৫ ভাগ এলাকা তালেবান দখল করেছে। এর সাথে গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত ক্রসিংও তাদের দখলে।
তাহলে প্রশ্ন হতে পারে, আমেরিকা সব জেনে বুঝে কেন অপাত্রে বিনিয়োগ করছে?
এর সহজ উত্তরটা হচ্ছে, কাবুলের পতন মানে তালেবান ক্ষমতা দখল। এতে আফগানিস্তানে সহজে প্রবেশ করবে চীন। তালেবানের পক্ষ থেকে চীনকে সবুজ সংকেত দেয়া হয়েছে। তারা চীনকে আফগানিস্তানের কৌশলগত বন্ধু বলে উল্লেখ করে একাধিক বক্তব্য দিয়েছে।এমনকি চীনের সাথে তালেবান ২০১৯ সাল থেকেই কূটনৈতিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। চীন আফগানিস্তানে অবাধে প্রবেশ করতে পারা মানে মধ্য এশিয়াকে চীনের বিআরআই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা। এতে চীনের অর্থনৈতিক উত্থানকে কোনোভাবেই ঠেকানো সম্ভব হবে না আমেরিকার পক্ষে। এছাড়া ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা আরো হুমকির মুখে পরবে। তাই আফগানিস্তান নীতিতে আমেরিকার প্লান বি কার্যকর করতে ভারত ও তুরস্ককে সাথে নিয়ে আফগানিস্তানকে অস্থিতিশীল করে তুলতেই, কাবুল সরকারকে সাহায্যের পাশাপাশি, বিভিন্ন মিলিশিয়া গড়ে তোলে, তালেবানকে প্রতিরোধ করতে চাইছে। যাতে তালেবান কোনোভাবেই কম সময়ে খুব সহজেই ক্ষমতা দখল করতে না পারে। এছাড়া মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিংকেন সম্প্রতি ভারত সফরে আফগানিস্তান বিষয়ে ভারতের সাথে একজোট হয়ে কাবুল সরকারের পক্ষে অবস্থান নেবে- এমনই আভাস দিয়েছে। এছাড়া কোয়াড বিষয়ে উভয় দেশ একজোট হয়ে দক্ষিণ চীন সাগর এবং ভারতীয় উপসাগরের চীনের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাতে একমত হয়।
তালেবান এর আগে প্রাদেশিক রাজধানী এবং গুরুত্বপূর্ণ শহর সামরিক উপায়ে দখল করবে না বলে জানিয়েছিল। কিন্তু আমেরিকার বার বার চুক্তিভঙ্গ এবং মিলিশিয়া বাহিনীর তৎপরতা বাড়তে থাকায় তারা এই নীতি থেকে সরে এসেছে।তালেবানের রাজনৈতিক ডেপুটি প্রধান মোল্লা বারাদার গনি চীন সফর করে নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। চীনকে প্রতিশ্রুতি দেন যে চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে তালেবান হস্তক্ষেপ করবে না। একইভাবে চীন জানায়, আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতার প্রশ্নে চীন সবসময় আফগানিস্তানের পাশে থাকবে। এর বিনিময়ে তালেবান যেন পূর্ব তুর্কিমেনিস্তান ইসলামিক মুভমেন্টসহ অন্যান্য সশস্ত্রপন্থী গ্রুপের সাথে দূরত্ব বজায় রাখে। এই সফরে পরই মূলত তালেবান দক্ষিণ আফগানিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শহরে সামরিক অভিযান শুরু করে। এর মধ্যে কান্দাহার, হেরাত আর লস্করগাহের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ তালেবান দখলে নিয়েছে, এখনো সংঘর্ষ চলমান।
এই অভিযানের মাধ্যমে একটি বিষয় পরিষ্কার, তালেবান ও কাবুল প্রশাসন উভয়ই আলোচনার মাধ্যমে যে চলামন সঙ্কট সমাধানের ব্যাপারে হতাশ তা সহজেই অনুমেয়। সামরিক উপায়কেই উভয়পক্ষ ক্ষমতা দখলের শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে বিবেচনা করছে।
তথ্যসূত্র : মিলিটারি টাইমস, নেভিটাইমস, ডেইলি সাবাহ, নিউ আরব, নিউইয়র্ক টাইমস, গার্ডিয়ান।
লেখক : শিক্ষার্থী জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
merajislam920@gmail.com