লুজান চুক্তি এবং ২০২৩ সাল
লুজান চুক্তি এবং ২০২৩ সাল - ছবি : সংগৃহীত
লুজান চুক্তি ও ২০২৩ সালকে কেন্দ্র করে আলোচনার শীর্ষে আছে তুরস্ক। অনেক জল্পনা কল্পনা আছে এই চুক্তিকে নিয়ে। বলা হচ্ছে, চুক্তির ১০০ বছর পূর্ণ হলে ২০২৩ সালের পর তুরস্ক ফিরে পাবে হারানো ভূখণ্ড, ফিরে পাবে প্রণালীর নিয়ন্ত্রণ, খিলাফত আরো কত কী!
সত্যি কি তাই? লুজান চুক্তি কি শেষ হবে ১০০ বছর পূর্ণ হলে? বা আদৌ কি তুরস্ক তার হারানো সবকিছু ফিরে পাবে? চলুন দেখা যাক কী এই লুজান চুক্তি এবং কী কী আছে এ চুক্তিতে।
লুজান চুক্তি
১৯২৩ সালের ২৪ জুলাই সুইজারল্যান্ডের লুজান শহরে সই হয় এই চুক্তি। লুজান শহরের নাম অনুসারে চুক্তির নামকরণ করা হয় লুজান চুক্তি। যেটির আনুষ্ঠানিক নাম ছিল 'লুজানে তুরস্কের সাথে স্বাক্ষরিত শান্তি ও যুদ্ধবন্দি বিনিময় চুক্তি'।
১৪৩টি ধারাবিশিষ্ট চুক্তিটি লিখিত হয় ফরাসি ভাষায়। আঙ্কারার গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ১৯২৩ সালের ২৩ আগস্ট এটি অনুমোদন করে। এরপর ১৯২৪ সালের ১৬ জুলাই নাগাদ অন্য রাষ্ট্রগুলোর আইনসভায়ও চুক্তিটি অনুমোদিত হয়। পরে ১৯২৪ সালের ৬ আগস্ট থেকে চুক্তিটি কার্যকর হয়।
লুজান চুক্তির একপক্ষে ছিল তুরস্ক, অপরপক্ষে ছিল মিত্রশক্তির দেশ ব্রিটেন, ফ্রান্স, গ্রিস, ইতালি, জাপান, রোমানিয়া, সার্বিয়া ও চেকোস্লোভাকিয়া।
চুক্তির পটভূমি :
লুজান চুক্তি বুঝতে হলে এর ইতিহাস জানা খুবই জরুরি। কেননা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী মিত্রশক্তি লুজান চুক্তির আগে উসমানিয়া সাম্রাজ্যের সাথে সেইভ্রেস চুক্তি করে। আর সেই চুক্তি মেনে না নেয়ার ফল হিসেবেই কিন্তু লুজান চুক্তি করা হয় পুনরায়। লুজান চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে সেইভ্রেস চুক্তি বাতিল হয়ে যায়, এবং তখন থেকে চুক্তিটিকে আধুনিক তুর্কি রাষ্ট্রের ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
সেইভ্রেস চুক্তির শর্তাবলি ছিল ওসমানিয়া রাষ্ট্রের জন্য অত্যন্ত কঠোর এবং একপক্ষীয়। কিন্তু এসময় সমগ্র উসমানিয়া সাম্রাজ্যের বেশিরভাগ অংশ কার্যত মিত্রশক্তির দখলে ছিল, তাই তাদের চাপিয়ে দেয়া চুক্তিতে স্বাক্ষর করা ছাড়া উসমানিয়াদের সামনে কোনো বিকল্প ছিল না।
এদিকে উসমানিয়া সাম্রাজ্যের তুর্কি–অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে ইতোমধ্যেই মিত্রশক্তির দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। আর সেইভ্রেস চুক্তি স্বাক্ষরেরও আগে ১৯১৯ সালেই তুর্কি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সৃষ্টি হয়েছিল। তারা তুরস্কের এশিয়া অংশের আঙ্কারায় একটি বিকল্প সরকারের সৃষ্টি করেছিল এবং জিএনএ বা 'গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি' নামে নতুন একটি আইনসভা নির্বাচিত করেছিল। গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি সরকারের নেতা ছিলেন উসমানিয়া সেনাবাহিনীর বিখ্যাত সমরনায়ক মুস্তফা কামাল পাশা।
তাহলে আমরা বুঝতে পারি, সেইভ্রেস চুক্তি যখন স্বাক্ষরিত হয়, তখন উসমানিয়া সাম্রাজ্যে কার্যত দুটি সরকার ছিল– মিত্রশক্তির অধিকৃত কনস্টান্টিনোপলভিত্তিক উসমানিয়া সরকার এবং আঙ্কারাভিত্তিক গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির সরকার।
আঙ্কারাভিত্তিক সরকারের বক্তব্য ছিল, তারাই তুর্কি জনসাধারণের প্রকৃত প্রতিনিধি। তাই তারা সেইভ্রেস চুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করে, এবং সেইভ্রেস চুক্তির পর মিত্রশক্তির সাথে আঙ্কারাভিত্তিক সরকারের সশস্ত্রবাহিনীর যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। তুরস্কের ইতিহাসে এটি 'তুর্কি স্বাধীনতা যুদ্ধ' হিসেবে পরিচিত।
তুর্কি স্বাধীনতা যুদ্ধে আঙ্কারাভিত্তিক সরকার প্রধানত গ্রিস, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের বিরুদ্ধে এবং ১৯২০ ও ১৯২১ সালে যথাক্রমে আর্মেনিয়া ও জর্জিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। ১৯২০ সালে কনস্টান্টিনোপলভিত্তিক উসমানিয়া সরকারের সাথেও তাদের সংঘর্ষ হয়। এই যুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়া ও আইনত স্বাধীন কিন্তু কার্যত সোভিয়েত রাশিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত সোভিয়েত আজারবাইজান, সোভিয়েত বুখারা ও সোভিয়েত ইউক্রেন আঙ্কারাভিত্তিক সরকারকে সহায়তা করে। এর পাশাপাশি ইতালি আঙ্কারাভিত্তিক সরকারের সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া থেকে বিরত থাকে।
১৯২২ সালের অক্টোবর নাগাদ আঙ্কারাভিত্তিক সরকার গ্রিস, ফ্রান্স, আর্মেনিয়া ও কনস্টান্টিনোপলভিত্তিক উসমানিয়া সরকারের বিরুদ্ধে জয়ী হয়, এবং উসমানিয়া সাম্রাজ্যের জাতিগত তুর্কি–অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর সিংহভাগ যা সেইভ্রেস চুক্তির মাধ্যমে মিত্রশক্তি ছিনিয়ে নিয়েছিল তা তুর্কি জাতীয়তাবাদীদের হস্তগত হয়। ১৯২২ সালের ১১ অক্টোবর উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়।
এরফলে বাধ্য হয়ে ২৮ অক্টোবর মিত্রশক্তি পুনরায় আলোচনার জন্য চিঠি দেয়। একটি চিঠি যায় জিএনএ সরকারের কাছে, আরেকটি যায় উসমানিয়া সরকারের কাছে। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে কামাল পাশা তিন দিন পর ১ নভেম্বর সালতানাতের বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। এর মধ্য দিয়ে কামাল পাশা ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছে যান। এবং তার সরকার লুজান চুক্তির আলোচনায় অংশ নেয়। দীর্ঘ ৮ মাস আলোচনার মাধ্যমে অবশেষে ২৪ জুলাই ১৯২৩ সালে লুজান চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
চুক্তির বিষয়বস্তু
লুজান চুক্তির মাধ্যমে বর্তমান তুরস্কের সীমানা নির্ধারণ করা হয়। তুরস্কের ঋণের বোঝা হালকা করা, প্রণালী সংক্রান্ত বিষয়ে পরিবর্তন, তুরস্কের সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ন্ত্রণ, কাপিচুলেশন সিস্টেম বাতিলসহ আরো অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয় এই চুক্তিতে।
১৪৩ ধারা বিশিষ্ট এই চুক্তিতে ৫টি প্রস্তাবনার মাধ্যমে বিষয় অনুসারে অনুচ্ছেদ গুলোকে বিন্যস্ত করা হয়।
# তুরস্কের সীমানা নির্ধারণ
লুজান চুক্তির মাধ্যমে বর্তমান তুরস্কের সীমানা নির্ধারণ করা হয়। নির্ধারিত হয় তুরস্কের সাথে গ্রিস, ইরান, সিরিয়া ও ইরাকের সীমানা।
* তুরস্ক-গ্রিস সীমানা
লুজান চুক্তির মাধ্যমে তুরস্কের সাথে গ্রিসের সীমানা নির্ধারিত হয়। এজিয়ান সাগরে তুরস্কের ভূখণ্ড থেকে তিন মাইলের মধ্যে যে দ্বীপগুলো আছে সেগুলো তুরস্কের হাতে আসে। এছাড়া বাকি দ্বীপগুলো গ্রিসের হাতে ছেড়ে দিতে হয় তুরস্ককে।
* তুরস্ক-ইরান সীমান্ত
লুজান চুক্তিতে তুরস্কের সাথে ইরানের সীমান্ত অপরিবর্তিত থাকে।
* তুরস্ক সিরিয়া সীমান্ত
লুজান চুক্তিতে তুরস্কের সাথে সিরিয়ার সীমানা নির্ধারিত হয় ১৯২১ সালের ২০ অক্টোবর ফ্রান্সের সাথে তুরস্কের করা চুক্তি অনুসারে।
* তুরস্ক-ইরাক সীমান্ত
লুজান চুক্তির সময় মাসুল শহর ইরাকের কাছে হস্তান্তর করতে অস্বীকার করে তুরস্ক। আর তাই মাসুল শহরটি তুরস্কের অধীনে থাকে চুক্তি অনুযায়ী।
পরে ১৯২৬ সালে ব্রিটেন, তুরস্ক ও ইরাকের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী মাসুল শহর ইরাকের কাছে ছেড়ে দেয় তুরস্ক।
* ফ্রান্স ও ইতালি
ফ্রান্স ও ইতালি সেইভ্রেস চুক্তিতে বর্তমান তুরস্কের যে অংশগুলো দখল করেছিল তা ছেড়ে দেয়। কার্যত যুদ্ধের মাধ্যমে তা ফিরে পেয়েছিল তুরস্ক।
* সাইপ্রাস
লুজান চুক্তি অনুযায়ী সাইপ্রাসকে ব্রিটেনের কাছে হস্তান্তর করে তুরস্ক। পরে ১৯২৬ সালে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীন হয় সাইপ্রাস। কিন্তু সাইপ্রাসে তুর্কি জাতিগোষ্ঠীর উপর ব্যাপক নির্যাতন ও নিপীড়ন চালানো হলে ১৯৭৪ সালে অভিযান চালিয়ে তুরস্ক উত্তর সাইপ্রাসের কিছু অংশ দখল করে নেয়।
# ঋণের বোঝা লাঘব
লুজান চুক্তির মাধ্যমে উসমানিয়া সাম্রাজ্যের যে ঋণ ছিল তা তুরস্কের উপর চাপিয়ে না দিয়ে উসমানিয়া সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীন হওয়া সব দেশের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হয়।
# গ্রিসের সাথে জনগণ বিনিময়
এই চুক্তির মাধ্যমে তুরস্কে বসবাসরত গ্রিসের নাগরিকদেরকে নিজ দেশে ফেরত নেয়া আবার গ্রিসে বসবাসরত তুর্কিদের তুরস্কে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
# কপিচুলেশন সিস্টেম বাতিল
সেইভ্রেস চুক্তিতে উসমানিয়া সাম্রাজ্যের মধ্য দিয়ে বিদেশী মানুষ, পণ্য ও জাহাজ শুল্কবিহীন বা অবাধে চলাচলের সুব্যবস্থা করা হয়েছিল। লুজান চুক্তিতে এই সিস্টেম বাতিল করা হয়।
# প্রণালীর নিয়ন্ত্রণ
তুরস্কের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত গুরুত্বপূর্ণ দুটি প্রণালী বসফরাস ও দারদানেলিস প্রণালী। কৃষ্ণ সাগরীয় দেশগুলোর ভূমধ্যসাগরে যেতে প্রথমে বসফরাস ও পরে দার্দানেলিস প্রণালী হয়ে যেতে হয়। এবং এর কোনো বিকল্প নেই।
লুজান চুক্তিতে এই দুই প্রণালী দিয়ে জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রণে একটি আন্তর্জাতিক কমিটি করার সিদ্ধান্ত হয়। যে কমিটিতে তুরস্কও থাকবে, কিন্তু তার হাতে কোনো কর্তৃত্ব থাকবে না। এছাড়াও এই দুই প্রণালীর তীরবর্তী অঞ্চলকে অস্ত্রমুক্ত রাখারও সিদ্ধান্ত হয়। এমনকি এর আশপাশে কোনো অস্ত্রধারী বাহিনীও রাখতে পারবে না তুরস্ক। এছাড়া প্রণালী দুটি দিয়ে অতিবাহিত জাহাজ থেকে তুরস্কের টোল আদায়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।
কিন্তু পরে প্রণালী দুটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সুইজারল্যান্ডের মন্ট্রিক্স শহরে আরেকটি চুক্তি হয় ২০ জুলাই ১৯৩৬ সালে। চুক্তিটি তুরস্ক, ব্রিটেন, ফ্রান্স, বুলগেরিয়া, অস্ট্রেলিয়া, গ্রিস, জাপান, রোমানিয়া, সোভিয়েত রাশিয়া, ও যুগোস্লাভিয়ার মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে প্রণালীগুলোর কর্তৃত্ব পুরোপুরি তুরস্কের কাছে ছেড়ে দেয়া হয়।
কিন্তু তুরস্ক এগুলো দিয়ে চলাচলকারী কোনো জাহাজ থেকে টোল নিতে পারবে না। শুধুমাত্র রক্ষণাবেক্ষণের জন্য নামমাত্র কিছু টাকা নিতে পারবে। মন্ট্রিক্স চুক্তিটি প্রতি ২০ বছর পর নবায়ন হয়। সর্বশেষ নবায়ন হয়েছে ২০১৬ সালে। ফলে এ চুক্তিটি ২০৩৬ সাল পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।
তাহলে চুক্তির মেয়াদ ১০০ বছর পূর্ণ হলে ২০২৩ সালের পর থেকে তুরস্ক বসফরাস ও দার্দানেলিস প্রণালীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবে এমনটি হচ্ছে না।
এখানে একটি বিষয় বলে রাখি, লুজান চুক্তি একটি শান্তিচুক্তি এবং চুক্তির কোথাও ১০০ বছর পর মেয়াদ শেষ হবে এমনটি উল্লেখ নেই। ফলে ১০০ বছর পর ২০২৩ সালে চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে না। আর ১০০ বছর পর আন্তর্জাতিক চুক্তির মেয়াদ শেষ হয় বিষয়টিও সঠিক নয়।
এক্ষেত্রে মস্কো চুক্তির কথা বলা যায়। যা ১৯২১ সালের ১৬ মার্চ সোভিয়েত রাশিয়া ও আঙ্কারাভিত্তিক সরকারের মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়। ২০২১-এ ১০০ বছর পূর্ণ হলেও চুক্তিটি এখনো বলবৎ আছে। কেননা যদি চুক্তিতে সুনির্দিষ্ট কোনো মেয়াদ উল্লেখ করা না থাকে এবং চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্রগুলো যদি বিলুপ্ত না হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে চুক্তিটি ১০০ বছর পেরিয়ে কয়েক শ' বছর পরও সচল থাকতে পারে।
আর একটি বিষয় ধারণা করা হয় যে এই লুজান চুক্তির ফলে তুরস্ক খনিজসম্পদ উত্তোলন করতে পারছে না। এখানে বলতে হয়, বিষয়টি নিয়ে চুক্তিতে কোনো অনুচ্ছেদই নেই।
ফলে এ-সংক্রান্ত কোনো নিষেধাজ্ঞাও নেই। আর তুরস্ক প্রধান খনিজ দ্রব্য ক্রোমাইট, বক্সাইট ও তামা নিয়মিতভাবে উত্তোলন করে থাকে। তুরস্ক কৃষ্ণসাগরে তাদের বৃহত্তম গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পেয়েছে, এবং সেখান থেকে গ্যাস উত্তোলনের ব্যবস্থাও শুরু করেছে। যদিও তুরস্কের মূল ভূখণ্ডে গ্যাস সরবরাহ করতে তাদের এখনো কয়েক বছর সময় লাগবে। এছাড়া তুরস্ক কৃষ্ণসাগর ও ভূমধ্যসাগরে তেল ও গ্যাসের অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছে।
তাহলে ১০০ বছর পূর্ণ হয়ে চুক্তি শেষ হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই তুরস্কের খনিজসম্পদ উত্তোলন করার জন্য। আর ১০০ বছর হলে চুক্তির মেয়াদ তো শেষ হচ্ছে না।
তাহলে এখন প্রশ্ন হতে পারে, তুরস্ক কি কোনোভাবে এই লুজান চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে?
এই প্রশ্নের উত্তরে যাওয়ার আগে এই চুক্তির ফলে তুরস্কের অর্জনের দিকটা একটু বিবেচনা করা দরকার বলে মনে করি। সেইভ্রেস চুক্তির সাথে তুলনামূলক আলোচনা করলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
* সেইভ্রেস চুক্তির মধ্য দিয়ে উসমানিয়া সাম্রাজ্য কার্যত ৪,৫৩,০০০ বর্গ কি.মি. আয়তনবিশিষ্ট মিত্রশক্তির উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল। লুজান চুক্তির মাধ্যমে তুরস্ক একটি অপেক্ষাকৃত বড়, স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। যার আয়তন হয় ৭,৮৩,৩৫৬ বর্গ কি.মি।
* সেইভ্রেস চুক্তি অনুযায়ী আনাতোলিয়ার বিরাট এক অংশজুড়ে স্বাধীন আর্মেনিয়া ও কুর্দিস্তান রাষ্ট্র গঠনের কথা ছিল। কিন্তু লুজান চুক্তিতে এ প্রসঙ্গটি উল্লেখ করা হয়নি। ফলে আনাতোলিয়ার প্রায় সম্পূর্ণ অংশ নতুন তুর্কি রাষ্ট্রের হাতে আসে।
* সেইভ্রেস চুক্তি অনুযায়ী উসমানিয়া রাষ্ট্রের ব্যাংক, বাজেট বলা যায় অর্থনীতিকে পুরোপুরি মিত্রশক্তির হাতে সমর্পণ করা হয়েছিল। লুজান চুক্তি তুরস্কের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ তুর্কি সরকারের হাতে ফিরিয়ে দেয়।
* সেইভ্রেস চুক্তিতে তুর্কি সামরিক শক্তির ওপর ব্যাপক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। লুজান চুক্তির মধ্য দিয়ে এসব বিধিনিষেধের অবসান ঘটে।
* উসমানিয়া সুলতানরা ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোকে একটি বিশেষ সুবিধা প্রদান করেছিলেন। এই অনুযায়ী, উসমানিয়া সাম্রাজ্যের মাটিতে অবস্থানরত কোনো ইউরোপীয় নাগরিকের বিচার উসমানিয়া আইনে করা যেত না। লুজান চুক্তি এই বৈষম্যমূলক ব্যবস্থা রহিত করে।
* সেইভ্রেস চুক্তি অনুযায়ী মিত্রশক্তি উসমানিয়া রাষ্ট্রের ওপর বিরাট এক ক্ষতিপূরণের বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিল। লুজান চুক্তিতে তুরস্ককে এই ক্ষতিপূরণ তো দিতেই হয়নি, উল্টা তুর্কি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গ্রিক সৈন্যরা আনাতোলিয়ায় যে ক্ষয়ক্ষতি করেছে, তার জন্য গ্রিসের কাছ থেকে তুরস্ক ক্ষতিপূরণ দাবি করে। শেষ পর্যন্ত গ্রিস ক্ষতিপূরণ প্রদান না করে এদিরনে প্রদেশ সংলগ্ন একটি ক্ষুদ্র অঞ্চল তুরস্কের কাছে হস্তান্তর করে।
* সেইভ্রেস চুক্তি অনুযায়ী মিত্রশক্তি আর্মেনীয় গণহত্যার জন্য উসমানিয়া কর্মকর্তাদের বিচারের মুখোমুখি করতে চেয়েছিল। কিন্তু লুজান চুক্তিতে এই প্রসঙ্গের কোনো উল্লেখ করা হয়নি, এবং এর মধ্য দিয়ে কার্যত মিত্রশক্তি তুরস্ককে আর্মেনিয়া গণহত্যার দায় থেকে দায়মুক্তি প্রদান করে।
তাহলে বলা যায়, এই চুক্তির ফলে তুরস্ক কার্যত অনেক সুবিধা অর্জন করেছিল। যদিও অনেক ভূমি ছেড়ে দিতে হয়েছিল ও শর্ত মেনে নিতে হয়েছিল এই চুক্তির ফলে। তবে মোটের ওপর তুরস্কের অর্জন নেহাত কম নয়।
এখন, এরপরও যদি তুরস্ক চায়, তবে চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়া সম্ভব। সম্ভাব্য উপায় হতে পারে-
যে রাষ্ট্রগুলোর সাথে লুজান চুক্তি করা হয়েছে সেই রাষ্ট্রগুলোর সাথে মিলে নতুন একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে পারে। ফলে লুজান চুক্তি বাতিল হয়ে যাবে। যেমনটা লুজান চুক্তি করার ফলে সেইভ্রেস চুক্তি বাতিল হয়ে গেছে।
আবার লুজান চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী অন্য রাষ্ট্রগুলোর সম্মতিক্রমে চুক্তিটি বাতিল করে দিতে পারে। যেমন মস্কো চুক্তি। ১৯২১ সালের মস্কো চুক্তি অনুযায়ী সোভিয়েত রাশিয়া ও আঙ্কারাভিত্তিক সরকার অতীতে রুশ ও ওসমানিয়া সাম্রাজ্যদ্বয়ের মধ্যে স্বাক্ষরিত সকল চুক্তিকে বাতিল বলে ঘোষণা করে। ফলে ১৯২১ সালের আগে রাষ্ট্র দুটির মধ্যে স্বাক্ষরিত সকল চুক্তি বাতিল হয়ে যায়।
কিংবা কারো তোয়াক্কা না করেই তুরস্ক চুক্তিটি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে। যা হবে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। এবং এর ফলে চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী অপর রাষ্ট্রগুলোর প্রতিক্রিয়া কী হবে, সেটা অনিশ্চিত। আর এর ফলে কার্যত তুরস্ককেই সেইভ্রেস চুক্তিতে ফিরে যেতে হবে।
আর হ্যাঁ এই চুক্তি বাতিল হলে খিলাফত কিন্তু ফিরে আসবে- এ ধারণাটিও সঠিক নয়। কেননা লুজান চুক্তির সাথে খিলাফতের কোনো সম্পর্কই নেই।
লুজান চুক্তির আগেই ১৯২২ সালে কামাল পাশা উসমানিয়া সালতানাত বিলুপ্ত করেছিলেন। আর লুজান চুক্তির পর ১৯২৪ সালে তুরস্কে কামাল আতাতুর্ক খিলাফতের বিলুপ্তি ঘোষণা করেন।
সালতানাত ও খিলাফত বিলুপ্তি ছিল কামাল পাশার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, যা সরাসরি লুজান চুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল না।