আমেরিকা মোড়ল হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতীক - ছবি : সংগৃহীত
আমেরিকার নেতৃত্বে যখন ইরাক আক্রমণ করা হয় তখন দেশটির শক্তিশালী অর্থনৈতিক কাঠামো ছিল। স্বাধীনভাবে শাসিত হলে এতদিনে ইরাক উন্নত দেশের সারিতে শামিল হতো। সাদ্দাম হোসেন দেশের মানুষের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্রের প্রয়োগ করেছিলেন। এমনকি আমেরিকার শত্রু ইরানের বিরুদ্ধেও এমন অস্ত্র প্রয়োগ করেছেন। সাদ্দামের মানবতাবিরোধী নিষ্ঠুর কর্মকাণ্ড আমেরিকার মদদেই ঘটেছিল। তাই ওই সময় তারা সাদ্দামের বিরুদ্ধে এমন গণবিধ্বংসী অস্ত্রের অভিযোগ আনেনি। অভিযোগটি আনা হলো যখন তারা দেখল, মধ্যপ্রাচ্যে একজন জাতীয়তাবাদী নেতার উত্থান হতে যাচ্ছে যিনি আরবদের নেতৃত্বে দিলে আমেরিকার আধিপত্য ও ইসরাইলের জন্য হুমকি হতে পারে। একই কারণে আরব লীগের সদস্য, আফ্রিকার উদীয়মান দেশ লিবিয়াকেও ধ্বংস হয়ে যেতে হল। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সিরিয়া ও ইয়েমেনকেও শেষে এই তালিকায় যুক্ত হতে হলো।
পরাশক্তি আমেরিকার অন্যায্য যুদ্ধ কিভাবে বিভিন্ন জাতির জন্য ভয়াবহ পরিণতি বয়ে আনল আমরা বিগত দশকগুলোকে তার দর্শক। তারা মূলত প্রথমে একটা বয়ান তৈরি করছে। তাদের এজন্য একদল বয়ান রচনাকারী গোষ্ঠী রয়েছে। এরপর সেই বয়ান জনমানুষের কাছে পৌঁছানোর জন্য তাদের রয়েছে শক্তিশালী মিডিয়া। আফগানিস্তান আক্রমণ করার জন্য তাদের নতুন তৈরি করা শব্দগুলো ছিল ‘জঙ্গিবাদ’ ও ‘ইসলামী সন্ত্রাসবাদ’। ইসলামী বিশ্বে ‘মুজাহিদ’ শব্দটির ব্যাপক প্রচলন অল্পসময়ের ব্যবধানে হয়ে গেল ‘জঙ্গি’। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যারা লড়াই করেছিল তাদের তকমা ছিল ‘মুজাহিদ’। তারা ইসলামী বিশ্বে মহিমান্বিত হয়েছেন একসময়। অথচ এদেরই সর্বশেষ সংস্করণ তালেবান হয়ে গেল ‘জঙ্গি’। তালেবানদের বিরুদ্ধে লড়াইকে বৈধতা দিতে এলো ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের’ কথামালা। আরো কিছু চটকদার শব্দ ও বয়ান তালেবানকে ‘দানব’ ও আমেরিকাকে ‘স্বর্গীয়’ শক্তি হিসেবে মানুষের সামনে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
ইতিহাসে দানব চরিত্রটি বিপুল শক্তির মালিক বোঝায়। দানবরা সাধারণত অসুরের শক্তি দিয়ে ভালো মানুষগুলোকে হত্যা করে। শয়তান তাদের মূল দেবতা। অন্য দিকে মানুষকে বাঁচাতে লড়াই করে ভালো মানুষেরা। তারা পৃথিবীর নায়ক। তাদের পৃষ্ঠপোষক আমেরিকা। আর তারা বাইবেলে বর্ণিত ঈশ্বরের আশীর্বাদপুষ্ট। বিশ্বে এমন ধারণা সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা বিগত সাত দশকের বেশি সময় ধরে চলছে। প্রপাগান্ডা শব্দটি দিয়ে ঠিক এমন ধারণা ও আবহ তৈরি করাকে বোঝায়। ভালো কথার মোড়কে সৃষ্ট এ বয়ান কতটা মারাত্মক, সুপার পাওয়ার আমেরিকার বিপুল পেশিশক্তির প্রয়োগে ইতিহাস এর সাক্ষী হয়ে গেছে। আশার ব্যাপার হচ্ছে একমেরু বিশ্বের ভয়াবহ পরিণতি থেকে বিশ্ববাসী সম্ভবত পরিত্রাণ পেতে যাচ্ছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা বিশ্ব মোড়ল হয়েছে। এরপরে তারাই যেন ইতিহাসের বরপুত্র। তবে তারা ভাষারও মালিক, ভাষার ওপর তারা জোর খাটাতে পারেন। তাই নিজেদের মতো বয়ান তৈরি করে সেটি প্রতিষ্ঠা করেন। হিরোশিমা নাগাসাকিতে মানুষের ওপর পরমানু বোমা হামলা চালায় আমেরিকা। সেখানে কত লোক মারা গেছে সেটা নিয়ে বিভিন্ন মত ও হিসাব রয়েছে। কোনো হিসাবে তা এক লাখের কম নয়। কারো মতে সেটা আড়াই লাখ। তবে পরমাণু বিকিরণের ভয়াবহ ক্ষতিকর প্রভাব ওই অঞ্চলের মানুষ গত ৭৫ বছর ধরে ভোগ করছে। সেখানে এখনো জন্ম নিচ্ছে বিকলাঙ্গ শিশু। এমন মানব বিধ্বংসী অস্ত্রের একমাত্র ব্যবহারকারী আমেরিকা; এতে কারো সন্দেহ থাকার কথা নয়। মানুষের বিরুদ্ধে এতবড় অপরাধ আমেরিকা ছাড়া অন্য কেউ করতে পারেনি। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, যাদের বিরুদ্ধে আমেরিকা এই অপরাধ করেছে সেই জাপানিদের তারা বগলদাবা করেছে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি করেও কোনো জাতিকে অধীনস্থ বানিয়ে তাদের কাছ থেকে বন্ধুত্বের এমন স্বীকৃতি আদায় ইতিহাসের বিরল ঘটনা। এমন ওষুধ তারা জাপানিদের গিলিয়েছে প্রতিশোধ নেয়া তো দূরের কথা উল্টো আমেরিকার হয়ে লড়তেও তারা প্রস্তুত হয়ে যায়।