গোলকিপার বাবার উইকেটকিপার সন্তান
গোলকিপার বাবার, উইকেটকিপার সন্তান - ছবি : সংগৃহীত
ফুটবল একটা সময় আমাদের দেশে কতটা জনপ্রিয়তা আর উন্মাদনা সৃষ্টি করেছিলো তা বুঝাতে হয়তো হালের জনপ্রিয় ক্রিকেটারদের বাবা'রা খানিকটা হলেও ভূমিকা রাখবেন৷ সাকিবের বাবার কথা তো সবাই জানেন, ফুটবলার থেকে ফুটবল কোচ আর সংগঠকও ছিলেন। মাশরাফীর বাবাও কম কিসে, সাকিবের বাবার বন্ধু হিসেবে তিনিও চলেছেন একই পথে। তেমনি কাজী নাসিবুল হাসান সান্নুও ছিলেন সেই পথেরই পথিক। তার ছেলে নুরুল হাসান সোহানও তো জাতীয় দলে খেলে!
কাজী নাসিবুল হাসান সান্নু ফুটবলার ছিলেন বটে, কিন্তু জাতীয় দলে খেলার সৌভাগ্য হয়নি। সান্নু খুলনার প্রথম বিভাগ ফুটবল লীগের সেরা গোলরক্ষক ছিলেন। তখন আরামবাগের গোলরক্ষক হিসেবে বেশ নাম-ডাক ছিল সান্নুর। কিন্তু লাল-সবুজের এই দেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ মেলেনি তার। ফলে এই ব্যর্থতা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল, ব্যথা দিচ্ছিল সময়ে সময়ে। কিন্তু বাবার সেই অপূর্ণতা প্রাপ্তির স্রোতে ধুয়ে দিয়েছে ছেলে। ছেলে তার লাল-সবুজের ওই জার্সি গায়ে ৪৭ হাজার বর্গমাইলের এই দেশের প্রতিনিধিত্ব করে।
বাবা ছিলেন ফুটবলের অতন্দ্র প্রহরী; গোলরক্ষক। গ্লাভস হাতে দলকে সুরক্ষা করতেন নিজের সর্বস্ব দিয়ে। দ্রুত গতিতে সেকেন্ডের ভগ্নাংশে লাফিয়ে উঠে প্রতিহত করতেন বিপক্ষ দলের আক্রমণ। ছেলেও তাই, গ্লাভস হাতে বাবার মতো ক্ষিপ্ততা তার মাঝেও বহমান। গ্লাভস হাতে দলকে সমর্থন দিতে তার জুড়ি মেলা ভার। দ্রুত সময়ে শরীরের মোচরে চুম্বকের মতো হাত সাফাইয়ে কী দারুণ ছবিই না আঁকেন উইকেটের পেছনে। কখনো কখনো তো বিস্ময়ের বিস্ফোরণও ঘটে যায়। বাবা ছেলের পার্থক্য কেবল দুটি স্থানে। এক. তিনি গোল কিপার, আর ছেলে উইকেটকিপার। আর দ্বিতীয়টা হলো, সান্নু তো ছিলেন খুলনার সেরা, আর ছেলে তার দেশ সেরা!
সোহান জাতীয় দলে খেলেন। সদ্য সমাপ্ত জিম্বাবুয়ে সিরিজে দারুণ খেলেছেন। গ্লাভস হাতে উইকেটের পেছন হতে দলকে সমর্থন দিয়েছেন৷ আগামী অস্ট্রেলিয়া সিরিজেও উইকেটের পেছনের দায়িত্ব তার। একেই হয়তো কপাল বলে, প্রকৃতি কখন কী করে তা কে বলতে পারে? এই তো কিছু দিন আগেও ব্যাট হাতে দারুণ পারফর্ম করেও দলে জায়গা মিলছিল না তার স্থানে একাধিক নাম আছে বলে। দেশ সেরা কিপারে তকমা নিয়েও অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছিল সুযোগের। আর এখন যখন সুযোগ মিলল তখন যাদের কারণে সুযোগ আসছিল না, তারাও বাইরে। অর্থাৎ জাত উইকেট কিপার তিনি একাই আছেন দলে।
সোহানের এই লড়াইটা আজকের ছিল না। তাকে প্রতিনিয়ত, প্রতি মুহূর্তে বাধা পাড়ি দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে হচ্ছিল। ২০১৪ সাল থেকেই আলোচনায় ছিলেন। কিন্তু কেন যেন তবুও সুযোগ মিলছিল না৷ হয়তো কিপিংয়ে সেরা হলেও, ব্যাট হাতে ততটা সাবলীল ছিলেন না বলে। যাহোক, অবশেষে সুযোগ মেলে জাতীয় দলে। ১৫ জানুয়ারি ২০১৬ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। সেই ম্যাচে ৫ বলে ৭ রানে অপরাজিত থাকেন সোহান। পরের ম্যাচে সুযোগ না হলেও, সিরিজের শেষ ম্যাচে ১৭ বলে ৩০ রানের ইনিংস খেলেন তিনি। পরে ব্যাট হাতে ব্যর্থ হওয়ায় টি-২০ দল থেকে বাদ পড়েন ২০১৭ সালে। এরই মাঝে দুটি ওয়ানডে খেলেছিলেন সোহান। সেখানে অবশ্য ব্যাট হাতে দারুণ করেন। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তাদেরই মাঠে দুই ম্যাচে ২৪ ও ৪৪ রানের ভালো দুটো ইনিংস খেলেন দলের বিপর্যয়ে। কিন্তু তবুও কেন জানি, এত ভালো খেলেও পরে আর ওয়ানডেতে সুযোগ হয়নি। সুযোগ মিলল ৫ বছর পর। ততদিনে বয়সটা ২২ হতে ২৭ ছুঁয়েছে। এইবার ওয়ানডের পাশাপাশি টি-২০-তেও সুযোগ মিলেছে।
সুযোগটা না মিললে সোহানের প্রতি একটু বেশিই অবিচার হতো নিঃসন্দেহে। ঘরোয়া ক্রিকেট বা বিপিএল কিংবা বঙ্গবন্ধুর নামের সকল টুর্নামেন্টে ব্যাট হাতে এতো দারুণ খেলছিলেন যে সমালোচকদের মুখে হতেও প্রশংসা বেড়িয়েছে। সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু ডিপিএলেও ১৫০ উর্ধ্ব স্ট্রাইকরেটে রান তালিকায় ছিলেন সেরা পাঁচে। যাহোক, অবশেষে সুযোগ মিলেছে এই ঢের। এখন প্রয়োজন সোহানের নিজের সেরাটা দিয়ে জায়গাটা আকড়ে রাখার। শুধু জাতীয় দলে খেলতে পারার গৌরব নয়, দল ও দেশকে কিছু দিতে পারার তৃপ্তি নিয়েই যেন শেষটা হয় তার।
ছেলের সাফল্যে সব ভুলে যাননি বাবা। আদর্শ বাবার ন্যায় পাশে থেকে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন তিনি। ওই উপদেশমালার ভেতর থেকে নিঃসন্দেহে সেরা এই উক্তিটি। যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ প্রচার হয়েছিলো, 'শৃঙ্খল ও নিয়ম অনুযায়ী চলবে। কখনো যেন কোনো অহংকার না দেখায়। জাতীয় দলের হয়ে খেলছ বলে অনেক কিছু ভাবতে হবে এমন কিছু যেন কখনোই মনে না পড়ে।'
শেষ কথার মর্মার্থ সবার বেলায় খাটে। কবির সুরে তা এভাবেই বলা চলে,
'আপনাকে বড় বলে
বড় সেই নয়,
লোকে যারে বড় বলে
বড় সেই হয়।'