তুরস্ক-তালেবান সমঝোতা কতটুকু সম্ভব?
আলোচনার টেবিলে তালেবান প্রতিনিধিদল। ইনসেটে এরদোগান ও ইমরান খান - ছবি : সংগৃহীত
মার্কিন জোট ২০ বছরের অসম যুদ্ধ শেষে কোনো ধরনের সমাধান ছাড়াই তল্পিতল্পা গুটিয়ে আফগান থেকে বিদায় নিচ্ছে। ন্যাটোভুক্ত একমাত্র মুসলিম দেশ তুরস্ককে সমস্যা নিরসনে ভূমিকা রাখার জন্য আমেরিকার পক্ষ থেকে কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। তুরস্ক কোনো আপত্তি না করে কিছু শর্ত জুড়ে সম্মতি প্রদান করেছে। মার্কিন জোট-সমর্থিত নিরূপায় কাবুল সরকার তুরস্কের এই অবস্থানকে স্বাগত জানালেও দখলদার মুক্ত করা আফগানের মুক্তিবাহিনী তালেবান সেটা মেনে নেয়নি।
তালেবান মুখপাত্রদের নানা বিবৃতিতে এর নিন্দা জানানো হয়েছে। হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলা হয়েছে, 'ন্যাটো জোটের সঙ্গে ফিরে না গেলে তুরস্ককেও দখলদার বিবেচনা করা হবে। তখন তুরস্কের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া হবে।'
কিন্তু তালেবানি হুঁশিয়ারির কোনো তোয়াক্কা না করেই তুরস্ক এখনো নিজ সিদ্ধান্তে বহাল। তবে তুরস্কের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তালেবানের সাথে তারা বৈঠকে বসবে। এবং সমঝোতা করেই তারা আফগানিস্তানে থাকবে। কিন্তু বাস্তবে তা কতটুকু সম্ভব?
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তুরস্কের যোগ করা শর্তাবলীতেই অসমোঝতার বীজ নিহিত রয়েছে। তুরস্ক একটি শর্ত আরোপ করেছে, 'আফগানে তুরস্ককে অর্থনৈতিক, লজিস্টিক ও গোয়েন্দা সহায়তা দিতে হবে ন্যাটোকে।' তার অর্থ হচ্ছে, তুরস্কের ছত্রছায়ায় ন্যাটো জোটের উপস্থিতি নির্ধারিত সময়ের পরও পরিপূর্ণভাবে বজায় থাকবে। তবে কৌশলে পরিবর্তন আসবে। এত দিন সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে উপনিবেশ ধরে রেখেছে। এবার অন্য ফ্রন্টে সামরিক বাহিনী পাঠিয়ে গোয়েন্দা তৎপরতা ও অন্যান্য উপায়ে উপনিবেশ ধরে রাখবে। তালেবান তো কোনোভাবেই ন্যাটোর উপস্থিতি মেনে নেবে না।
তুরস্কের দাবির প্রেক্ষাপটে গোয়েন্দা সহযোগিতা দিতে সম্মত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। শান্তিচুক্তিতে বলা হয়েছে, নির্দিষ্ট সময়ের পর ন্যাটো জোটের কোনো সেনা আফগান-ভূমে থাকবে না। তুরস্কের সহযোগিতার জন্য মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা থাকা তো দীর্ঘ দিনের সাধনা শান্তিচুক্তিরই স্পষ্ট লঙ্ঘন। বিভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার দক্ষতার সাথে ডিভাইড তৈরি করার কুখ্যাতি রয়েছে। নৃতাত্ত্বিক সকল জনগোষ্ঠী নিয়েই তালেবান এবারের সরকার গঠন করতে চায়। মার্কিন গোয়েন্দাদের উপস্থিতিতে তা সহজ হবে বলেও মনে করে না তালেবান।
এত দিন তুরস্ক কখনো তালেবানের মুখোমুখি হয়নি। এখন মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার অবদানে মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছে না তারা। তালেবান আর নতুন কোনো সঙ্ঘাতে জড়াতে চায় না। আবার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশী হস্তক্ষেপও মানতে নারাজ। অথচ তুরস্কের জুড়ে দেয়া শর্তাবলীর মাধ্যমে নতুন সঙ্ঘাত ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশী হস্তক্ষেপের দ্বারই উন্মোচিত হচ্ছে।
তুরস্কের প্রতি তালেবানের আস্থারও সংকট রয়েছে। সোভিয়েত উত্তর আফগানে তালেবান যখন কাবুলের শাসনভার গ্রহণ করে, উত্তর আফগানে জেনারেল রশিদ দোস্তম তাদের বিরুদ্ধে কঠোর প্রতিরোধ গড়ে তোলে। নর্দার্ন এলায়েন্স দোস্তমের নেতৃত্বে বেশ কিছু দিন তাদের শক্ত অবস্থান ধরে রাখে। ধারণা করা হয়, তখন তুরস্কের সহযোগিতাতেই দোস্তম এই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। পরে পরাহত হয়ে দোস্তম তুরস্কে আশ্রয় নিলে তুরস্ক সরকার তাকে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দেয়। ২০০১ সালে তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করার ক্ষেত্রেও স্থল অভিযানে আমেরিকার হয়ে ভূমিকা রাখে দোস্তম নেতৃত্বাধীন নর্দার্ন এলায়েন্স। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের গুম খুন শারীরিক ও যৌন উৎপীড়নের দায়ে ২০০৮ সালে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিলে দোস্তম আবারো তুরস্কে পলায়ন করেন। পরে এসব অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দিয়ে তাকে আশরাফ গানি সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট করা হয়। তালেবান শান্তচুক্তির পর বিদেশী সেনা প্রত্যাহারের প্রথম দিকেই দোস্তমের অঞ্চল উত্তর আফগান দখলে নিলে এবারো তিনি তুরস্কে আশ্রয় নেন এবং রাষ্ট্রীয় আতিথেয়তা লাভ করেন।
তুরস্ক রশিদ দোস্তম ছাড়াও কাবুল সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলছে। রাষ্ট্রীয় প্রটোকলে তালেবানের সাথে যোগাযোগ না হলেও গণতান্ত্রিক বিভিন্ন ফ্রন্টের লোকজনের সাথে বৈঠক করছে। যেখানে চীন রাশিয়া ও ইরানের মতো দেশ ভবিষ্যত আফগান সরকার গঠনের একক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে তালেবানকে সমীহ করে চলছে, তুরস্ক সেখানে কাবুল সরকারের প্রতি সহানুভূতি দেখিয়ে নিজ দেশেই তালেবানকে দখলদার বানিয়ে দিচ্ছে। তুরস্কের এই কাবুলপ্রীতি দেখে চুক্তির সময় শেষ হওয়ার পর তুরস্কের উপস্থিতি মেনে নেয়াতে তালেবান শান্তি মিশনে বিশেষ কোনো লাভের আশা করতে পারছে না। বরং পরিস্থিতি আরো জটিল হওয়ারই আশঙ্কা করছে।এজন্য বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তুরস্কের পক্ষে তালেবানের সাথে সমঝোতায় পৌঁছা সম্ভব হবে না।
আফগান একটি ল্যান্ডলকড কান্ট্রি। তার কোনো সমুদ্র বন্দর নেই। বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম এই হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। এজন্য আফগানদের কাছে এর গুরুত্ব অপরিসীম। বলা যায়, এই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরই আফগানদের স্বাধীনতা। তুরস্ককে মুসলিম রাষ্ট্র স্বীকার করলেও তো তার স্বার্থের জন্য তালেবান নিজেদের স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে পারে না। এজন্য আন্তর্জাতিক এই বিমানবন্দরে তুরস্কের কর্তৃত্ব মেনে নিতে চায় না তালেবান। তালেবানের দাবি, '২০ বছর ধরে তুরস্ক ন্যাটো জোটের অংশ হিসেবে আফগানে ছিল। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ২০২০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারিতে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুসারে আঙ্কারাকেও আফগান ছাড়তে হবে।'
উদ্ভূত এই পরিস্থিতিতে তুরস্ক কতটুকু সফল হতে পারবে, আগামীর দিনগুলোই তা বলে দেবে। তবে এখন পর্যন্ত ভালো কিছুর আভাস পাওয়া যাচ্ছে না। তুরস্ক এই ইস্যুতে তালেবানের মিত্র দেশ পাকিস্তানকে সাথে রাখতে চেয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান এই পর্যন্ত নীরবতাই পালন করে যাচ্ছে। বিশ্লেষকদের ধারণা, তুরস্কের এই অবস্থানকে পাকিস্তান সমর্থন দিতে প্রস্তুত নয়। আফগানের চূড়ান্ত স্বাধীনতা পাকিস্তানেরও কামনা। তাছাড়া কিছু দিন আগে ইমরান খান বলেছিলেন, তালেবান বিজয় আনন্দে এতটাই বেপরোয়া হয়ে গেছে যে পাকিস্তানকেও তোয়াক্কা করছে না। এজন্য স্পর্শকাতর এ ইস্যুতে তালেবান আপন অবস্থান থেকে আদৌ ফিরে আসবে কিনা, ওই হিসাবও কষতে হচ্ছে পাকিস্তানের। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নানা শক্তি যখন তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্ৰহ প্রকাশ করছে, সেখানে নিজের ইমেইজও নষ্ট করতে চাচ্ছে না পাকিস্তান।
ওদিকে নানা ইস্যুতে একই কন্ঠস্বর তুরস্ককেও সরাসরি নিষেধ করার মতো সক্ষমতা ইমরান সরকারের নেই। তাই নীরবতাকেই প্রাধান্য দিচ্ছে পাকিস্তান। পাকিস্তানকে সাথে রেখে তালেবানের ওপর প্রভাব বিস্তারের আশা খুবই ক্ষীণ। এজন্য তুরস্কের থিংকট্যাঙ্ককে অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা ও সাবধানতার সাথে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। আফগানিস্তানের দৃশ্যমান ও নেপথ্য নায়কদের যথাযথ বিশ্লষণে রাখতে হবে। এটাও মাথায় রাখতে হবে, বহিরাগত পরাশক্তি আফগানিস্তানে কখনো সফলতা অর্জন করতে পারেনি। আফগানিস্তান পরিশাক্তিদের গোরস্থান হিসেবে খ্যাত।