তুরস্ক-আমিরাত সংঘাতের নতুন কেন্দ্রবিন্দু উত্তর আফ্রিকা
তুরস্ক-আমিরাত সংঘাতের নতুন কেন্দ্রবিন্দু উত্তর আফ্রিকা - ছবি : সংগৃহীত
উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিসিয়াতে শনিবার হঠাৎ করে পার্লামেন্ট ভেঙে দেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট কায়েস সাইয়েদ। প্রেসিডেন্টের এই কাজে পেছন থেকে সমর্থন জানিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী। দেশটির পার্লামেন্টের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য প্রেসিডেন্টের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট ও পার্লামেন্টের মধ্যে এমন টানাপোড়েনের কারণে আরব বসন্তের সূতিকাগার দেশটিতে আবারো নতুন করে অস্থিতিশীলতা শুরু হয়েছে।
তিউনিসিয়ার এই ক্যুয়ের পিছনে মূলত পাশ্ববর্তী আঞ্চলিক শক্তিধর দেশগুলোর স্বার্থগত দ্বন্দ্ব রয়েছে। শুধুমাত্র তিউনিসিয়া নয়, সমগ্র উত্তর আফ্রিকায় স্বার্থগত কারণে দুটি ব্লকের উদ্ভব হয়েছে। একদিকে রয়েছে তুরস্ক এবং তার মিত্র কাতার। অপরদিকে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং উত্তর আফ্রিকান রাষ্ট্র মিসর।
১.
উত্তর আফ্রিকার ৫টি দেশ তথা মিসর, লিবিয়া, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, মরক্কো একাধারে আরব ও আফ্রিকান দেশ। এই দেশগুলোর মাঝে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন : সবগুলো দেশেরই উত্তরে রয়েছে ভূমধ্যসাগর, দক্ষিণ সীমান্তে রয়েছে বিস্তীর্ণ সাহারা মরুভূমি।
মরক্কো বাদে উত্তর আফ্রিকার বাকি চারটি রাষ্ট্র দীর্ঘ সময় উসমানিয়া সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। উসমানিয়াদের পতনের যুগে এই দেশগুলো চলে যায় ইউরোপীয় শক্তিদের হাতে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছুকাল পর সবগুলো উত্তর আফ্রিকান রাষ্ট্র স্বাধীনতা অর্জন করে। বর্তমানে তুরস্কের অন্যতম পররাষ্ট্রনীতি হলো উত্তর আফ্রিকায় তার পুরনো উসমানিয়া প্রভাব ফিরিয়ে আনা।
অপরদিকে উত্তর আফ্রিকার শক্তিশালী রাষ্ট্র মিসর এবং আরব অঞ্চলের আরেক শক্তিশালী রাষ্ট্র সংযুক্ত আরব আমিরাতের অন্যতম লক্ষ্য হলো, এই অঞ্চল থেকে তুর্কি প্রভাব হটানো। এক্ষেত্রে মিসর-আমিরাত জোট পাশে পাচ্ছে কিছু ইউরোপীয় শক্তিকে। অপরদিকে তুরস্কের সাথে আরব রাষ্ট্র কাতার ছাড়া নির্ভরযোগ্য কোনো মিত্র নেই এই অঞ্চলে।
বর্তমানে উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে তুর্কি-কাতার ব্লক এবং মিসর-আমিরাত ব্লকের দ্বন্দ্বের কারণেই মূলত সংঘাতের উৎপত্তি হচ্ছে। এসব সংঘাতের কোনোটিতে এগিয়ে রয়েছে তুর্কি-কাতার ব্লক তো কোনোটিতে আমিরাত-মিসর ব্লক।
২. মিসর
উত্তর আফ্রিকায় সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিকভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র মিসর। ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরের মধ্যে সংযোগকারী সুয়েজ খাল ছাড়াও বিস্তীর্ণ ভূমধ্যসাগরীয় জলরাশি মিসরকে এনে দিয়েছে এক অসামান্য ভৌগোলিক প্রভাব।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর লৌহমানব গামাল আবদেল নাসেরের সময় সমগ্র আরব বিশ্বকে নেতৃত্ব ও দিয়েছে এই মিসর। এখন অবশ্য আরব বিশ্বের নেতৃত্বের আসনে দেশটি নেই। কিন্তু মিসরকে বাদ রেখে আরব বিশ্বে কোনোরূপ অবস্থান তৈরি করাও সম্ভব নয় বাইরের কোনো দেশের পক্ষে।
২০১১ সালে আরব বসন্তের পর মিসরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় আসেন মুসলিম ব্রাদারহুডের মোহাম্মদ মুরসি। মুরসির ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তুরস্কের সাথে মিসরের সম্পর্ক সবচেয়ে মধুর ছিল। কেননা তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যিপ এরদোগান মুসলিম ব্রাদারহুডপন্থী রাজনীতি করতেন ছাত্রজীবনে।
ভূমধ্যসাগরের দুই তীরে, আরব ও তুর্কি নামক দুই জাতির ক্ষমতায় আসীন ব্যক্তি দুজন একই মতাদর্শের হওয়ায় অনেকেই ধারণা করেছিলেন, মিসর ও তুরস্ক শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হবে এই অঞ্চলে। কিন্তু সব হিসাবকে ভুল প্রমাণ করে, এক বছরের মাথায় ক্ষমতাচ্যুত হন মিসরীয় প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি। এরপর মিসরের ক্ষমতায় আসেন আবদেল ফাত্তাহ সিসি। সিসি ক্ষমতায় এসেই কঠোর ও নিষ্ঠুরতমভাবে দমন করে মিশরে বিরাজমান ব্রাদারহুডের প্রভাবকে।
মুরসিকে হটানো এবং ব্রাদারহুডবিরোধী কঠোন অভিযানের কার্যক্রমে শুরু থেকেই নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়েছিলো তুরস্ক। এতে করে তুরস্কের এরদোগান এবং মিসরের সিসির সম্পর্ক হয়ে উঠো দা-কুমড়ো টাইপ। এরদোগানের ব্রাদারহুডের নেতাদের তুরস্কে আশ্রয়দান এবং তুরস্ক থেকে সিসির শাসনবিরোধী প্রচার অব্যাহত রাখায় মিসরের সিসি সরকার আরো বেশি ক্ষুব্ধ হয় এরদোগানের প্রতি। এতে করে দেশ দুটির সম্পর্ক একদম তলানিতে গিয়ে ঠেকে।
মিসরের সিসি সরকার এরপর সম্পর্ক গড়ে তোলে তুরস্কের বিরোধীতাকারী হিসেবে পরিচিত দেশগুলোর সাথে। ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রিস ও গ্রিক সাইপ্রাসের সাথে বিভিন্ন চুক্তি ও সামরিক সহায়তামূলক কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে তুরস্ককে বারবারই প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে এসেছে মিসর।
আরব অঞ্চলে তুরস্কের উত্থানে সবচেয়ে বেশি ভীত সংযুক্ত আরব আমিরাত। আরব আমিরাত চাচ্ছে আগামী দিনে মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃত্বের আসনে বসতে। তুরস্কের উত্থান তার এ পথে সবচেয়ে বড় বাধা। আর তাই আরব আমিরাত যেখানেই তুরস্কের বিরোধিতাকারী শক্তি পেয়েছে, সেখানেই রসদ জুগিয়েছে। আর তাই আরব আমিরাত এবং মিসর বর্তমানে অন্যতম কৌশলগত মিত্রে পরিণত হয়েছে।
দীর্ঘ আট বছরের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ আরোপের মধ্য দিয়ে ক্রমেই মিসরকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন সিসি। সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে মিসর অনেক সফলতা অর্জন করেছে বিগত বছরগুলোতে। এদিকে মিসর ও তুরস্কের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক যতই খারাপ হোক, দেশ দুটির অর্থনৈতিক সম্পর্ক আগের চেয়েও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আফ্রিকায় মিসরই এখন পর্যন্ত তুরস্কের সবচেয়ে বড় ব্যাবসায়িক পার্টনার।
৩. মিসর ও তুরস্কের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক বর্তমানে কেমন!
ভূমধ্যসাগরে গ্রিস ও অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তিকে দমিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে হলে তুরস্কের জন্য মিসর অপরিহার্য। আবার নীল নদের মাধ্যমে দুই ভাগে ভাগ হওয়া মিসরের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয় হলো উজানের দেশ ইথিওপিয়ার নীল নদের উপর গ্র্যান্ড রেনেসাঁস বাধ নির্মাণ। মিসর তার বর্তমান মিত্র দেশগুলোকে নিয়ে একা ইথিওপিয়াকে ঠেকাতে সক্ষম হচ্ছে না।
ইথিওপিয়ায় অন্যতম সহযোগী দেশ তুরস্ক। চীনের পরই ইথিয়পিয়াতে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগকারী দেশ হলো তুরস্ক। আর তাই ইথিওপিয়ার ওপর তুরস্কের একটা প্রভাব রয়েছে।
অর্থাৎ ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের যেমন দরকার মিশরকে ঠিক তেমনি ইথিওপিয়ার সাথে বাঁধ সংক্রান্ত বিরোধ মেটাতে মিসরের ও তুরস্ককে দরকার। এই দুই সমীকরণ মিলিয়ে, দেশ দুটি বর্তমানে সীমিত আকারে কূটনৈতিক সম্পর্ক আবারো শুরু করেছে। তবে তা এখনো কার্যকর কোনো পর্যায় পর্যন্ত যেতে পারেনি।
সর্বশেষ অবস্থা অনুযায়ী এখনো মিসরের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে আরব আমিরাত রয়েছে এবং এই অঞ্চলের বিভিন্ন রাজনৈতিক সমীকরণে আরব আমিরাত এবং মিসর এক হয়েই কাজ করে থাকে।
৩. লিবিয়া
তুরস্ক-কাতার এবং আমিরাত-মিসর এই দুই ব্লকের মধ্যকার দ্বন্দ্বের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো লিবিয়া। লিবিয়া বর্তমানে কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত। দেশটির রাজধানীসহ পশ্চিমাঞ্চলীয় অঞ্চলগুলোর সরকার তুরস্কপন্থী। অপরদিকে দেশটির পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চলের সরকার হলো আমিরাত ও মিসরপন্থী।
তুরস্কপন্থী পশ্চিমাঞ্চলীয় সরকার আবার জাতিসঙ্ঘ-সমর্থিত। তুরস্ক তাই লিবিয়ার সাথে আন্তর্জাতিকভাবে সমুদ্রসীমা চুক্তি সম্পন্ন করতে পেরেছে ভূমধ্যসাগরে। বলা যায়, ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের কার্যকর মিত্র এখন একমাত্র লিবিয়া। এছাড়াও লিবিয়ার পশ্চিমাঞ্চলে অনেকগুলো সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করছে তুরস্ক। এছাড়াও পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে কাতার সরকার ব্যাপক সহায়তা করে যাচ্ছে।
লিবিয়ার তেলখনির বেশিরভাগই পূর্বাঞ্চলে। পূর্বাঞ্চলের দখলে থাকা সরকারটিকে সামরিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ব্যাকআপ দিচ্ছে মিসর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এই দুই ব্লকের সরব উপস্থিতির কারণে অদূর ভবিষ্যতে লিবিয়াতে কোনোরূপ রাজনৈতিক সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
অর্থাৎ তুরস্ক এবং আমিরাত ব্লকের দ্বন্দ্বের কারণে দ্বিখণ্ডিতই হয়ে গেল একটি রাষ্ট্র!
৪. আলজেরিয়া
১৯৫৫ সালে যখন আলজেরিয়ার স্বাধীনতার জন্য যখন জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদে ভোটাভুটি হয়, তখন তুরস্ক আলজেরিয়ার পক্ষ না নিয়ে তার পশ্চিমা বন্ধুদের পক্ষে ভোট দেয়। সেই তখন থেকে দীর্ঘ সময় অবধি আলজেরিয়ার সাথে তুরস্কের সম্পর্ক ভালো ছিল না।
কিন্তু ভূরাজনৈতিক নানা সমীকরণে বর্তমান তুর্কি সরকারের সাথে আলজেরিয়ার ক্ষমতাসীন সরকার কৌশলগত ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। হঠাৎ করে দেশ দুটির সম্পর্কে নাটকীয় পরিবর্তন আসার কারণ হলো
* আলজেরিয়ার উপর দীর্ঘকাল ধরে ফ্রান্সের একটা মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব রয়েছে। রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে ফ্রান্স থেকে স্বাধীনতা অর্জন করলেও দেশটির শিক্ষা ব্যবস্থা, অর্থনীতিতে ফ্রান্সের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। আলজেরিয়ার বর্তমান সরকার এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে চাচ্ছে। আর এজন্য তাদের নির্ভরযোগ্য মিত্র দরকার। আর এক্ষেত্রে তুরস্ক বড় একটা বিকল্প।
* পশ্চিম সাহারা অঞ্চল নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবেশী মরক্কোর সাথে আলজেরিয়ার বিরোধ বিদ্যমান। আলজেরিয়া চায়, মরক্কোর কাছ থেকে পশ্চিম সাহারা স্বাধীনতা অর্জন করুক। অপরদিকে মরক্কো পশ্চিম সাহারাকে নিজেদের সার্বভৌমত্বের অংশ মনে করে।
পশ্চিম সাহারা নিয়ে মরক্কো ও আলজেরিয়ার বিরোধে মরক্কোর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। চতুর্থ আরব দেশ হিসেবে গত বছর মরক্কোর ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। আর এই স্বীকৃতি দেয়ার বিনিময়ে মরক্কো পশ্চিম সাহারায় নিজেদের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি আদায় করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। আর পুরো প্রক্রিয়ায় মধ্যস্থতা করেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত।১
মরক্কোর এই কূটনৈতিক সফলতাকে টেক্কা দিতে হলে আলজেরিয়ারও দরকার একটি শক্তিশালী মিত্র।
অপরদিকে উত্তর আফ্রিকা তথা মাগরেব অঞ্চলে ও শক্তিশালী মিত্রের অভাবে ধুঁকছে তুরস্ক। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে তুরস্ক এবং আলজেরিয়া হঠাৎ করেই কৌশলগত মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে।২
* লিবিয়ার পশ্চিমে অবস্থিত আলজেরিয়া। লিবিয়ার পশ্চিমাঞ্চলীয় অঞ্চলে তুরস্কপন্থী সরকারের টিকে থাকতে হলে আলজেরিয়ার নৈতিক সমর্থন দরকার। এই বাস্তবতায় তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান সাহায্যের আহবান করেন আলজেরিয়া সরকারের কাছে। তুরস্ককে নিজেদের অনুকূলে রাখতে লিবিয়া বিষয়ে তুরস্কের অবস্থানকে সমর্থন দান করে আলজেরিয়া।
বর্তমানে আলজেরিয়াতে তুরস্কের বিনিয়োগ দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশ দুটির মধ্যে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন হয়েছে গত বছর। তুরস্ক তার এলএনজি আমদানির বড় অংশ আলজেরিয়া থেকে করে থাকে। অপরদিকে আলজেরিয়াও ইলেকট্রনিকস, টেক্সটাইলসহ বিভিন্ন কোয়ালিটি পূর্ণ তুর্কি পণ্য আমদানি করে থাকে। এছাড়া আলজেরিয়াতে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে তুরস্ক। যা উত্তর আফ্রিকায় তুরস্কের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ এবং আলজেরিয়ার ক্ষেত্রে ও সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক বিনিয়োগ এটি।৩
তুরস্কের সাথে আলজেরিয়ার সম্পর্ক যত ঘনিষ্ঠ হচ্ছে, ততই আলজেরিয়ার সাথে সম্পর্ক শীতল হচ্ছে সংযুক্ত আরব আমিরাত শাহীর।
৫. মরক্কো
উত্তর আফ্রিকায় একমাত্র রাজতান্ত্রিক দেশ হলো মরক্কো। রাজতান্ত্রিক দেশ হলেও দেশটিতে সীমিত আকারে গণতান্ত্রিক সরকার রয়েছে। আর সেই সরকারের ক্ষমতাসীন জোটের প্রধান দল হলো মুসলিম ব্রাদারহুড-সমর্থিত পিজেডি পার্টি। আর তাই মনে হতে পারে মরক্কোর সাথে তুরস্কের কূটনৈতিক সম্পর্ক মধুর পর্যায়ে, কিন্তু বাস্তবে তা নয়।
আলজেরিয়ার সাথে তুরস্কের সম্পর্ক আলোচনা করতে গিয়েই আমরা দেখেছি, পশ্চিম সাহারা অঞ্চল নিয়ে তুরস্কের সাথে মরক্কোর একটা মনস্তাত্ত্বিক বিরোধ তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি মরক্কোর বাদশাহ'র সাথে আরব আমিরাতের যুবরাজের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। এমতাবস্থায় মরক্কো কর্তৃক তুরস্কের সাথে আন্তরিক সৌহার্দ্য পূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন সম্ভব ও নয়।
অর্থাৎ আলজেরিয়াতে তুরস্ক এগিয়ে এবং আমিরাত পিছিয়ে থাকলেও মরক্কোতে এসে অবস্থা পুরোপুরি বিপরীত।
৬. তিউনিসিয়া
আরব বসন্তের সূতিকাগার উত্তর আফ্রিকার সবচেয়ে ছোট রাষ্ট্র তিউনিসিয়া। নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে দেশটিতে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠিত হয়। এই নির্বাচনে সবচেয়ে এগিয়ে ছিল মুসলিম ব্রাদারহুডের আদর্শে গঠিত আন নাহদা পার্টি।
তিউনিসিয়ার এলিট শ্রেণী এবং ডিপ স্টেট সম্পূর্ণভাবে ডানপন্থার বিরোধী। আর তাই ডিপ স্টেটের ভয়ে (মিসর থেকে শিক্ষা নিয়ে ) সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্টি হয়েও প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেনি আন নাহদা পার্টি। দলটির শীর্ষ নেতা রাশিদ ঘানুশি পার্লামেন্টের স্পিকার নির্বাচিত হন।
সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্টি হলেও দেশ চালাতে ব্যাপক বেগ পেতে হয় আন নাহদা পার্টিকে। কেননা প্রেসিডেন্ট ছিলেন আন নাহদার সম্পূর্ণ বিপরীত ধারার (প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আন নাহদা জিতে আসতে পারেনি)। এছাড়াও দেশটার এলিট শ্রেণী এবং ডিপ স্টেটের বিরোধিতা তো রয়েছেই।
আন নাহদা যে দেশটির ক্ষমতায় থেকেও ক্ষমতাহীন, তার নজির দেখা গিয়েছিল লিবিয়া যুদ্ধের সময়। লিবিয়াতে যুদ্ধে জড়ানোর আগে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগন লিবিয়ার পশ্চিম সীমান্তের দেশ আলজেরিয়া ও তিউনিসিয়া উভয়ের কাছে সহায়তা চান।
আলজেরিয়ার সরকার আদর্শিকভাবে তুরস্কের সরকারের মিত্র না হলেও ভূ-রাজনৈতিক কারণে তুরস্ককে আংশিক সমর্থন জানায়। অপরদিকে তিউনিসিয়ার ক্ষমতাসীন সরকার আদর্শিকভাবে তুরস্কপন্থী হওয়ার পাশাপাশি ভূ-রাজনৈতিকভাবেও তুরস্কের পক্ষে অবস্থান নেয়া তাদের জন্য লাভজনক ছিল। কিন্তু দন্তহীন বাঘ আন নাহদার সরকার তুরস্ককে কোনো সাহায্য করতে পারেনি বিরোধী দল এবং ডিপ স্টেটের বিরোধিতায়।
নামকাওয়াস্তে তিউনিসিয়াতে টিকে থাকা তুর্কি মিত্র আন নাহদারও অবশেষে পতন হতে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর আন নাহদার এই পতনে সবচেয়ে জোরালো ভূমিকা রেখেছে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্লেয়ার সংযুক্ত আরব আমিরাত!
অর্থাৎ তিউনিসিয়াতেও মিসরের মতো ব্রাদারহুডপন্থী সরকারের পতন হতে যাচ্ছে। আর এই দুই দেশেই ব্রাদারহুড পরবর্তী নতুন সরকারের সবচেয়ে কাছের মিত্র যে আরব আমিরাত তা তো বলার উপেক্ষা রাখে না।
৭.
আরব বসন্তের পর উত্তর আফ্রিকায় ব্রাদারহুডের প্রভাব বৃদ্ধি পাওয়ায় একটা সময় মনে হয়েছিল এই অঞ্চলে তুরস্ক শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে পারবে। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে, এই অঞ্চলে ব্রাদারহুডের প্রভাব কমেই ক্ষীণ হচ্ছে এবং শক্তিশালী হচ্ছে ব্রাদারহুডের কট্টর বিরোধী আরব আমিরাত সরকার।
আরব আমিরাত এই অঞ্চলের ৫টি রাষ্ট্রের মধ্যে তিনটি রাষ্ট্রের সাথে মিত্রতা স্থাপনে সক্ষম হয়েছে। অপরদিকে তুরস্ক একটিমাত্র রাষ্ট্রের সাথে মিত্রতা স্থাপন করতে পেরেছে। আর বাকি একটি রাষ্ট্র লিবিয়াতে দুটি সরকার বিরাজমান। যার একটি তুরস্কপন্থী এবং অপরটি আমিরাতপন্থী।
দীর্ঘ স্বৈরশাসনের যাঁতাকল থেকে ২০১১ সালের আরব বসন্তের পর মুক্তি পায় উত্তর আফ্রিকার দেশগুলো। কিন্তু ওই মুক্তি যে চূড়ান্ত মুক্তি নয়, চলমান সংকটগুলো সেটি বারে বারে দেখায় দিয়ে যাচ্ছে।
রেফারেন্স
১. ইসাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে মরক্কো পশ্চিম সাহারার সার্বভৌমত্বের দাবি আদায় করলো আমেরিকা থেকে : https://www.google.com/.../20201210-morocco-recognizes...
২. আলজেরিয়ার নতুন মিত্র তুরস্ক : https://www.google.com/.../is-there-a-hope-for-french.../amp
৩. আলজেরিয়ায় তুর্কি বিনিয়োগ : https://thearabweekly.com/algerian-president-stresses...