মিসরের উচ্চাভিলাষ ও তুরস্কের সাথে দ্বন্দ্বের কারণ
এরদোগান ও সিসি - ছবি : সংগৃহীত
উত্তর আফ্রিকায় সামরিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ভৌগোলিকভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র মিসর। ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরের মধ্যে সংযোগকারী সুয়েজ খাল ছাড়াও বিস্তীর্ণ ভূমধ্যসাগরীয় জলরাশি মিসরকে এনে দিয়েছে এক অসামান্য ভৌগোলিক প্রভাব।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর লৌহমানব গামাল আবদেল নাসেরের সময় সমগ্র আরব বিশ্বকে নেতৃত্ব ও দিয়েছে এই মিসর। এখন অবশ্য আরব বিশ্বের নেতৃত্বের আসনে দেশটি নেই। কিন্তু মিসরকে বাদ রেখে আরব বিশ্বে কোনোরূপ অবস্থান তৈরি করাও সম্ভব নয় বাইরের কোনো দেশের পক্ষে।
২০১১ সালে আরব বসন্তের পর মিসরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে ক্ষমতায় আসেন মুসলিম ব্রাদারহুডের মোহাম্মদ মুরসি। মুরসির ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তুরস্কের সাথে মিসরের সম্পর্ক সবচেয়ে মধুর ছিল। কেননা তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যিপ এরদোগান মুসলিম ব্রাদারহুডপন্থী রাজনীতি করতেন ছাত্রজীবনে।
ভূমধ্যসাগরের দুই তীরে, আরব ও তুর্কি নামক দুই জাতির ক্ষমতায় আসীন ব্যক্তি দুজন একই মতাদর্শের হওয়ায় অনেকেই ধারণা করেছিলেন, মিসর ও তুরস্ক শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হবে এই অঞ্চলে। কিন্তু সব হিসাবকে ভুল প্রমাণ করে, এক বছরের মাথায় ক্ষমতাচ্যুত হন মিসরীয় প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি। এরপর মিসরের ক্ষমতায় আসেন আবদেল ফাত্তাহ সিসি। সিসি ক্ষমতায় এসেই কঠোর ও নিষ্ঠুরতমভাবে দমন করে মিশরে বিরাজমান ব্রাদারহুডের প্রভাবকে।
মুরসিকে হটানো এবং ব্রাদারহুডবিরোধী কঠোন অভিযানের কার্যক্রমে শুরু থেকেই নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়েছিলো তুরস্ক। এতে করে তুরস্কের এরদোগান এবং মিসরের সিসির সম্পর্ক হয়ে উঠো দা-কুমড়ো টাইপ। এরদোগানের ব্রাদারহুডের নেতাদের তুরস্কে আশ্রয়দান এবং তুরস্ক থেকে সিসির শাসনবিরোধী প্রচার অব্যাহত রাখায় মিসরের সিসি সরকার আরো বেশি ক্ষুব্ধ হয় এরদোগানের প্রতি। এতে করে দেশ দুটির সম্পর্ক একদম তলানিতে গিয়ে ঠেকে।
মিসরের সিসি সরকার এরপর সম্পর্ক গড়ে তোলে তুরস্কের বিরোধীতাকারী হিসেবে পরিচিত দেশগুলোর সাথে। ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রিস ও গ্রিক সাইপ্রাসের সাথে বিভিন্ন চুক্তি ও সামরিক সহায়তামূলক কার্যক্রম বাস্তবায়নের মাধ্যমে তুরস্ককে বারবারই প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে এসেছে মিসর।
আরব অঞ্চলে তুরস্কের উত্থানে সবচেয়ে বেশি ভীত সংযুক্ত আরব আমিরাত। আরব আমিরাত চাচ্ছে আগামী দিনে মধ্যপ্রাচ্যের নেতৃত্বের আসনে বসতে। তুরস্কের উত্থান তার এ পথে সবচেয়ে বড় বাধা। আর তাই আরব আমিরাত যেখানেই তুরস্কের বিরোধিতাকারী শক্তি পেয়েছে, সেখানেই রসদ জুগিয়েছে। আর তাই আরব আমিরাত এবং মিসর বর্তমানে অন্যতম কৌশলগত মিত্রে পরিণত হয়েছে।
দীর্ঘ আট বছরের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ আরোপের মধ্য দিয়ে ক্রমেই মিসরকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছেন সিসি। সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে মিসর অনেক সফলতা অর্জন করেছে বিগত বছরগুলোতে। এদিকে মিসর ও তুরস্কের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক যতই খারাপ হোক, দেশ দুটির অর্থনৈতিক সম্পর্ক আগের চেয়েও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আফ্রিকায় মিসরই এখন পর্যন্ত তুরস্কের সবচেয়ে বড় ব্যাবসায়িক পার্টনার।
মিসর ও তুরস্কের মধ্যকার কূটনৈতিক সম্পর্ক বর্তমানে কেমন!
ভূমধ্যসাগরে গ্রিস ও অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তিকে দমিয়ে প্রভাব বিস্তার করতে হলে তুরস্কের জন্য মিসর অপরিহার্য। আবার নীল নদের মাধ্যমে দুই ভাগে ভাগ হওয়া মিসরের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চিন্তার বিষয় হলো উজানের দেশ ইথিওপিয়ার নীল নদের উপর গ্র্যান্ড রেনেসাঁস বাধ নির্মাণ। মিসর তার বর্তমান মিত্র দেশগুলোকে নিয়ে একা ইথিওপিয়াকে ঠেকাতে সক্ষম হচ্ছে না।
ইথিওপিয়ায় অন্যতম সহযোগী দেশ তুরস্ক। চীনের পরই ইথিয়পিয়াতে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগকারী দেশ হলো তুরস্ক। আর তাই ইথিওপিয়ার ওপর তুরস্কের একটা প্রভাব রয়েছে।
অর্থাৎ ভূমধ্যসাগরে তুরস্কের যেমন দরকার মিশরকে ঠিক তেমনি ইথিওপিয়ার সাথে বাঁধ সংক্রান্ত বিরোধ মেটাতে মিসরের ও তুরস্ককে দরকার। এই দুই সমীকরণ মিলিয়ে, দেশ দুটি বর্তমানে সীমিত আকারে কূটনৈতিক সম্পর্ক আবারো শুরু করেছে। তবে তা এখনো কার্যকর কোনো পর্যায় পর্যন্ত যেতে পারেনি।
সর্বশেষ অবস্থা অনুযায়ী এখনো মিসরের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে আরব আমিরাত রয়েছে এবং এই অঞ্চলের বিভিন্ন রাজনৈতিক সমীকরণে আরব আমিরাত এবং মিসর এক হয়েই কাজ করে থাকে।