গল্পটা আমাদের শরিফুলের

আফফান উসামা | Jul 27, 2021 12:57 pm
শরিফুল

শরিফুল - ছবি : সংগৃহীত

 

সদ্য সমাপ্ত জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজটায় আলোচনায় উঠেছে এসেছে অনেক ক্রিকেটার। চায়ের কাপের গরম আড্ডায় উঠে এসেছে অনেক নাম। সিরিজজুড়ে নজর কেড়েছেন নানাজন নানাভাবে। টেস্টে মাহমুদউল্লাহ, ওয়ানডেতে সাকিব আর টি-২০-তে শামীম-সৌম্য তো সবার ওপরে। সোহান, তামিম, তাসকিন, লিটনও আলোচনায় উঠে এসেছেন মাঝে মাঝে। কিন্তু সব নামের ভিড়ে একটা নাম আলো ছড়াচ্ছেন চুপিসারে। নিজের কাজটা তিনি করে চলেছেন পুরো দমে। ওয়ানডেতে ইকোনমি চারের ঘরে রেখে তুলে নিয়েছিলেন ২ ম্যাচে ৫ উইকেট। আর টি-২০-তে তিন ম্যাচে নিয়েছেন ৭ ইকোনমিতে ৬ উইকেট; সর্বোচ্চ উইকেট শিকারিও তিনি। তবুও তিনি কেন জানি আলোচনার বাইরে বলা চলে। তাই ভাবলাম আজ আলোচনা হোক তাকে ঘিরে-

গল্পটা এক হতদরিদ্র পরিবারের। কখনো এক বেলা, কখনো দুই বেলা, কখনো আবার সারা বেলাতেও খাবার জোটে না। থাকতে হয় উপোস। এক মুঠো অন্নের জন্য কতই না লড়াই করতে হয় এই জীবনের সাথে। অতঃপর যা মিলে তা দিয়ে কোনো রকমে বেঁচে থাকা। ভরপেট; সে যেন এক স্বপ্নই বটে। বাংলার সেই বহুল প্রচলিত প্রবাদ ‘নুন আনতে পান্তা ফুরোয়’ যেন তাদের ঘিরেই লেখা হয়েছিল। কবি নজরুলের সেই অমর পঙ্‌ক্তিখানাও যেন তার মাঝে ফুটে উঠেছে,

“হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান।
তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রীস্টের সম্মান।
কণ্টক-মুকুট শোভা...”।

ছয় সদস্যের বড় পরিবার তাদের। সর্বকর্তা ভূমিহীন এক কৃষক। রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভেজে পরিবারের মুখে আহার তুলে দিতে অন্যের ভূমিতে নিজেকে দেন বিলিয়ে। অভাবের তাড়নায় পাশাপাশি ভাড়া ভ্যানও চালান কখনো কখনো গ্রামের ওই ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে। এত কষ্ট, এতো লড়াই কিন্তু তবুও আদর্শ বাবা হতে পিছপা হননি। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করতে অনুপ্রাণিত করেছেন, নিজে হাতেই সংসারের হাল ধরে রেখেছেন। নিজ দেহের ঘাম ঝরিয়ে একা হাতে সংসার খরচ জুটিয়েছেন। আর স্বপ্ন দেখছিলেন, কোন একদিন সন্তানেরা লেখাপড়া শেষে এই ঘামের মূল্য পরিশোধ করবে।

সবই ঠিক ছিল। কিন্তু স্বপ্নে বাধ সাধল পরিবারের ছোট ছেলেটা। খাতা-কলম ছেড়ে তার মন যে ব্যাটে বলে আকরে ধরেছে। পড়ালেখায় ফাঁকি দিয়ে প্রায়ই ছুটে যেত ক্রিকেট মাঠে। ভলিবলটাও দারুণ খেলতো বলে শোনা যায় লোকমুখে। স্কুলে যাওয়ার পথে বাজারের এক দোকানে বই রেখে চলে যেত খেলতে। এর জন্য মায়ের বকুনি আর বাবার পিটুনিও কম খেতে হয়নি তার। তবুও খেলা ছাড়েনি। জানেনই তো নিষিদ্ধ জিনিসে আকর্ষণ বেশি। যাহোক, গতির সাথে বৈচিত্র্যময় দারুণ বোলিংয়ের সক্ষমতার কারণে কৈশোরেই স্থানীয় বিভিন্ন দলে ডাক পড়ত ছয় ফুট লম্বা এই পেসারের।

২০১৫ সালে বিকেএসপিতে ডাকও পেয়েছিলেন ভলিবল খেলোয়াড় হিসেবে। তবে সেখানে না অনাগ্রহ দেখিয়ে ক্রিকেট নিয়েই পথচলার সিদ্ধান্ত নেন। ক্রিকেটের প্রতি তার ভালোবাসা দেখে অনেকেই পরামর্শ দেন ভালো ক্লাবে ভর্তি করিয়ে দিতে। কিন্তু দুমুঠো খাবার জোগাড়ই যেখানে দায়, সেখানে ক্লাবের খরচ দেবেন কী করে? ফলে পরিবারের কেউ রাজি ছিলেন না। তবে ক্রিকেটের প্রতি ছোট ভাইয়ের ভালোবাসা দেখে বড় ভাই আর নিজেকে আটকে রাখতে পারেননি। একপর্যায়ে ছোট ভাইয়ের স্বপ্ন পূরণ করবেন বলে নিজ পড়ালেখায় ইতি টেনে কাজ নেন ঢাকার একটি গার্মেন্টসে।

২০১৬ সালে দিনাজপুরে ক্লেমন ক্রিকেট স্কিল প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ভর্তি হন সেই দীর্ঘদেহী পেসার। অনুশীলনে যোগ দিতে তার নিজের একটা ব্যাট সেটও ছিল না তখন। তখন তার প্রথম গেম সেটের ব্যাটটি কিনে দেন বড় ভাইয়ের ভাড়ায় থাকা বাড়ির মালিক। যাহোক, কিছু দিন পর সেখানে খেলোয়াড় বাছাইয়ে আসেন রাজশাহী ক্লেমন একাডেমির প্রশিক্ষকরা। যেই দলে ছিলেন সাবেক খেলোয়াড় আলমগীর কবির, ধীমান ঘোষ ও হান্নান সরকার। সেখানে একটি বল করার তাকে মনে ধরে নির্বাচকদের। বাঁ হাতি এই পেসারকে সিলেক্ট করেন তারা। তারপর তাকে নিয়ে যান ক্লেমন একাডেমি রাজশাহীতে। আলমগীর কবির নিজেই তার খরচ বহন করার দায়িত্ব নেন। নিজের প্রিয় কিটটাও দিয়ে দেন তাকে। আর তার তত্ত্বাবধানে চলতে থাকে অনুশীলন।

পরের গল্পটা সবারই জানা। সাফল্যও তার দিকে ছুটে এসেছে পরিশ্রমের সাথে পাল্লা দিয়ে। তিনি জানতেন তার নিজেকে গড়ে তুলতেই হবে। তার পরিবার এখন শুধুই তার দিকেই তাকিয়ে, তার উপরেই ভরসা করে আছে। বড় ভাইয়ের ত্যাগের মূল্যটাও তাকেই চুকাতে হবে। তিনি ব্যর্থ হলে যে ভবিষ্যৎ আরো অন্ধকারচ্ছন্ন হয়ে যাবে। যাহোক, নিজেকে বিলিয়ে দেয়ার প্রথম সাফল্যটা এসেছে পরবর্তী বছরেই। ২০১৭ সালে থার্ড ডিভিশনে খেলার সুযোগ পান তিনি। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। অধ্যবসায় আর কঠোর পরিশ্রমের ফলে ডিপিএল, বিপিএল, অনূর্ধ্ব-১৭, অনূর্ধ্ব-১৯ ও বাংলাদেশ ‘এ’ দলেও সুযোগ মেলে যায় দ্রুত সময়ে। অতঃপর আজকে জাতীয় দলে। পারফর্মও করছেন সমতালে।

তবে তাকে নিয়ে বলতে গেলে আলাদা করে অনুর্ধ্ব- ১৯ সময়কাল নিয়ে বলতেই হবে। ওই সময়টাই তো তাকে অন্য সবার থেকে আলাদা করে দিয়েছে। তাকে চিনেছে গোটা দেশ। তার নাম ছড়িয়েছে বিশ্বজুড়ে। ক্রিকেটে চোখ রাখা প্রতিটি অন্তরে শরিফুল নামটা গেঁথে গিয়েছে। ধপঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ উপজেলার দণ্ডপাল ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম নগরডাঙ্গা এলাকার দুলাল মিয়ার দ্বিতীয় ছেলে শরিফুল ইসলামকে এখন পুরো দেশের সবাই চেনে। সবাই নিজেদের সম্পদ ভাবে। ভাববেই না কেন? এই শরিফুল যে দেশকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন খেতাব এনে দিয়েছে। প্রথমবারের মতো শরিফুল ও তার অনূর্দ্ধ ১৯ সঙ্গীদ্বয় বিশ্বকাপ জিতেছে!

এখন শরিফুল জাতীয় দলে খেলেন। খেলেও চলেছেন দারুণ ধারাবাহিকতায়। উইকেট উপড়ে ফেলে হাসি ফুটাচ্ছেন দেশের কোটি মানুষ মুখে। এদিকে তার পারিবারিক অবস্থাও পাল্টে গেছে। ভাঙা টিনের ঘর আজ হাফ বিল্ডিংয়ে পরিনত হয়েছে। বাড়ির পাশেই বড় ভাইকে গড়ে দিয়েছেন গরুর খামার। তবে সবই সম্ভব হয়েছে দৃঢ় ইচ্ছা শক্তির দাপটে। কতটা ইচ্ছে ছিল জানেন? এক সাক্ষাৎকারে শরিফুলের মা বলেছিলেন, "ক্রিকেট খেলার প্রতি ওর নেশা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, মাঝ রাতে ঘুমের ঘুরে ‘আউট আউট’ বলে চিত্কার করে উঠতো মাঝে মাঝে!"

সারকথা-
একজন শরিফুল মানেই ভালোবাসার জয়,
একজন শরিফুলেই দারিদ্র্যতার জয়।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us