ভারতীয় মুসলিমদের বিরুদ্ধ ৫টি অভিযোগ ও বাস্তবতা

মাসুম মুরাদাবাদী | Jul 26, 2021 08:05 pm
ভারতীয় মুসলমান

ভারতীয় মুসলমান - ছবি : সংগৃহীত

 

আসামের পর ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তরপ্রদেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন প্রণয়নের কথা চলছে। ‘দুটো সন্তানই উত্তম’ শিরোনামে এ কার্যক্রম এমনিতেই সব নাগরিকের ওপর বাস্তবায়নের প্রস্তুতি চলছে, কিন্তু যারা জানেন, তারা ভালোভাবেই জানেন যে, ভারতে যখনই জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করার আলোচনা শুরু হয়, তখনই এর তীর গিয়ে সর্বদা মুসলমানদের ওপর গিয়েই পড়ে। আসাম ও উত্তরপ্রদেশে এই আলোচনা শুরু করার উদ্দেশ্য এটিই মনে হয়। কেননা এর নেপথ্য উদ্দেশ্য জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করার আগ্রহ নয়, বরং এর আড়ালে রাজনৈতিক রুটি সেঁকা ও মুসলমানদের হয়রানি করা।

বিভিন্ন সময়ে করা সার্ভে এ কথা প্রমাণ করেছে, ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অন্য সম্প্রদায়ের চেয়ে কম। কিন্তু এর পরও তাদের বিরুদ্ধে ভারতের জনসংখ্যায় সমস্যা তৈরির অভিযোগ আরোপ করা হচ্ছে। মুসলমানদের সম্পর্কে যেসব কথা বারবার বলা হয়, তন্মধ্যে পাঁচটি বেশি দৃশ্যমান। মুসলমানদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হচ্ছে, তারা বেশি সন্তান জন্ম দেয় এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য একমাত্র তারাই দায়ী। দ্বিতীয়ত, এ কথা বলা হয় যে, মুসলমানদের কারণে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তৃতীয় অভিযোগ হচ্ছে, মুসলমানরা ইচ্ছা করেই জনসংখ্যা বৃদ্ধি করছে। যাতে ধীরে ধীরে হিন্দুরা সংখ্যালঘু হয়ে যায়। আর মুসলমানরা দেশের ক্ষমতার মালিক হয়ে যায়। চতুর্থ অভিযোগ হচ্ছে, মুসলমানরা একাধিক বিয়ে করে; যাতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এ জন্য এ স্লোগান দেয়া হয়- ‘আমরা পাঁচ, আমাদের পঁচিশ’। পঞ্চম, এ কথা বেশ জোর দিয়ে বলা হয় যে, ইসলাম পরিবার পরিকল্পনার বিরোধী। এ জন্য মুসলমানরা এটি মানে না। মূলত এই প্রপাগান্ডা দিয়ে সাম্প্রদায়িকতা ও মুসলিমবিদ্বেষী শক্তিগুলো অক্সিজেন পেয়ে থাকে। এ কারণে এটিকে বাতাস দিতে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলোর সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখা যায়। নির্বাচনের ময়দানে এ ধরনের কথাগুলো বেশি বলা হয়।

আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রী কোনো একসময় গুজরাট অ্যাসেম্বলির নির্বাচনী প্রচারাভিযানের সময় ‘আমরা পাঁচ, আমাদের পঁচিশ’ স্লোগান মাতিয়ে হিন্দু ভোটারদের একতাবদ্ধ করতে সফল হন। সরলমনা সাধারণ হিন্দুদের ওপর এই প্রপাগান্ডার প্রভাব এমন হয় যে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে তাদের বিদ্বেষ আরো বেড়ে যায়। এটিই মূলত ফ্যাসিবাদী দলগুলোর উদ্দেশ্য যে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও অত্যাচারকে উসকে দেয়া এবং তাদের অসহায় বানিয়ে দেয়া। স্বাধীনতার পর থেকে ক্রমাগত এটিই হচ্ছে। কোনো সরকারই এটি হ্রাস করার জন্য প্রকৃত সংখ্যা জনগণের সামনে পেশ করেনি। কিছু দিন আগে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এস ওয়াই কুরাইশী এ বিষয়ের ওপর একটি গ্রন্থ লিখেছেন। ‘জনগণের দায়িত্ব : ইসলাম, পরিবার পরিকল্পনা ও ভারতীয় রাজনীতি’ শিরোনামে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত ওই গ্রন্থে তিনি এই ফলাফলে উপনীত হন যে, ‘জন্মের হার মুসলমানদের মাঝে বেশি, তবে এতটা নয়, যতটা প্রপাগান্ডা করা হচ্ছে।

সাধারণভাবে এ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করা হচ্ছে যে, কোনো হিন্দু পরিবারে দুটো সন্তান থাকলে, মুসলমান পরিবারে রয়েছে ১০টি সন্তান।’ ড. কুরাইশী তার গবেষণায় লিখেছেন, কখনোই হিন্দু ও মুসলমানদের মাঝে এক সন্তানের বেশি পার্থক্য ছিল না। তার বক্তব্য, বর্তমানে মুসলমানরা বেশ দ্রুত বরং হিন্দুদের চেয়ে বেশি পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। এ হার হ্রাস পেয়ে ০.৪৮ এ নেমে এসেছে। দ্বিতীয় ভুল বোঝাবুঝি এই যে, জনগণের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। এ কথায় এতটুকু সত্য আছে যে, বিগত ৬০ বছরে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ৪ শতাংশ। আর হিন্দুদের মধ্যে জনসংখ্যার হার হ্রাস পেয়েছে; অর্থাৎ হিন্দু জনসংখ্যা ৮৪ শতাংশ থেকে হ্রাস পেয়ে ৭৯ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। তার বক্তব্য, এ ঘাটতিটুকু শুধু মুসলমান নয়, বরং অন্য সব জাতির মধ্যে বণ্টন হয়ে গেছে। মুসলমানদের সংখ্যা ৯.৮ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১৪ শতাংশ হয়েছে। এর মাধ্যমে জনসংখ্যার ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার প্রশ্ন উঠতেই পারে না। মুসলমানদের সংখ্যা ৬০ বছরে মাত্র ৪ শতাংশ বেড়েছে। এই হিসাবে তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ থেকে ৬০০ বছর লেগে যাবে।
বর্তমানে আসামের নবনির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার মাথার ওপরও মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির ভূত চেপে বসেছে। এর সবচেয়ে বড় কারণ হলো- তার হাতে এমন এক রাজ্যের ক্ষমতার বাগডোর এসেছে, যেখানে সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যা অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৩৪ শতাংশ মুসলমান। আসামের মুসলমানদের বিরুদ্ধে অনবরত এ প্রপাগান্ডা চালানো হচ্ছে যে, তাদের মধ্যে বেশির ভাগই অনুপ্রবেশকারী, যারা প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ থেকে এসেছে। নবনির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রীর প্রথম মিশনই হচ্ছে, তিনি যেকোনোভাবেই হোক মুসলমানদের জনসংখ্যা ‘নিয়ন্ত্রণ’ করে তার রাজনৈতিক গুরুদের খুশি করবেন। এ জন্য তিনি তার রাজ্যে মুসলিম জনসংখ্যা কমিয়ে আনার জন্য বিভিন্ন ধরনের স্কিম তৈরি করেছেন। সবচেয়ে বড় স্কিম হচ্ছে, দুইয়ের অধিক সন্তানের জনক এখন থেকে সরকারি চাকরি পাবে না। দুইয়ের অধিক সন্তানের জনক যারা আগে থেকে সরকারি চাকরিরত আছে, তাদের বিরুদ্ধে শিষ্টাচারমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হবে। এ ধরনের বিধিবিধান বিজেপিশাসিত অন্য প্রদেশগুলোতেও জারি করা হয়েছে। অর্থাৎ দুইয়ের অধিক সন্তানের জনকদের স্থানীয় নেতা নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। এই আইন প্রয়োগকারী রাজ্যের মধ্যে রয়েছে গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, কর্নাটক ও হরিয়ানা। বিজেপিশাসিত নয় এমন কিছু রাজ্য যেমন- রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা ও উড়িষ্যাতেও এই আইন অনুসরণ করা হচ্ছে। উত্তরপ্রদেশও অতি দ্রুত এ তালিকায় প্রবেশ করবে।

উল্লেখ্য, আসামে দু’টি সন্তানের নীতি বাস্তবায়ন মিস্টার শর্মার পূর্ববর্তী মুখ্যমন্ত্রী গত জানুয়ারিতেই শুরু করে দিয়েছেন। এখন তিনি দুইয়ের অধিক সন্তানের জন্মদাতাকে সব সরকারি সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার বিশেষ লক্ষ্য হচ্ছে মুসলমান। আপনাদের স্মরণে থাকার কথা, তিনি বিগত সময়ে ‘শরণার্থী মুসলমানদের’ এ পরামর্শ দিয়েছিলেন, তারা যেন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ‘সভ্য পন্থা’ অবলম্বন করে। মূলত বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টিতে আসামের মুসলমানরা ‘শরণার্থী’, যারা বাংলাদেশ থেকে দেশত্যাগ করে আসামে এসে বসবাস করছেন। আপনাদের এ কথাও মনে থাকার কথা, তিনি অ্যাসেম্বলি নির্বাচনী প্রচারাভিযানে স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, রাজ্যের ৩৪ শতাংশ মুসলিম জনসংখ্যা বিজেপির অ্যাজেন্ডায় যুক্ত নয়, কারণ তারা বিজেপিকে ভোট দেয় না। শর্মার এ বক্তব্য তার দলের কার্যকৌশলের অংশ তো অবশ্যই এবং তিনি এমনটি নির্বাচনের ময়দানে বলেছেন। কিন্তু এখন তিনি যখন সবার সাথে ন্যায় আচরণ করার শপথ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন, তখন তাকে সংবিধান অনুসরণ করতে গিয়ে এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত, যার উপকারিতা জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই ভোগ করবে। তবে এটি বিস্ময়কর তামাশা যে, বিজেপির নেতারা সংবিধান রক্ষার শপথ গ্রহণ সত্ত্বেও প্রকাশ্যে তার বিরোধিতা করছে। এতে এটি প্রমাণ হয় যে, তাদের কাছে সংবিধানের কোনো গুরুত্ব নেই।

বিগত সময়ে এক বক্তৃতায় মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা বলেছিলেন, ‘শরণার্থী মুসলিম সম্প্রদায়ের সামগ্রিক উন্নয়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে পরিবার পরিকল্পনা নীতি গ্রহণ করা উচিত। কেননা দেশে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বিশেষত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মাঝে কর্মসংস্থানের ঘাটতি সৃষ্টি হচ্ছে।’ তিনি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দায়িত্বশীলদের ওপর জোর দিয়ে বলেছিলেন, ‘তারা যেন তাদের সম্প্রদায়ের লোকদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ওপর মনোযোগ দিতে উৎসাহ দেন।’ মুখ্যমন্ত্রী এ পর্যন্ত বলেন, ‘সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারীদের এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করছে।’ এ বক্তব্য থেকে এ কথা স্পষ্ট হয়, আসামে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের সব প্রচেষ্টা মুসলমানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আর সরকার এটিকেই লক্ষ্য বানাতে চাচ্ছে। এটি মূলত শাসক দলের নীতি ও অ্যাজেন্ডার অংশ। আর এর উদ্দেশ্য মুসলমানদের টার্গেট বানানো ছাড়া অন্য কিছু নয়।

অথচ বাস্তব সত্য এর বিপরীত। ২০১৯-২০ সালের সরকারি গণনা এটি প্রমাণ করে, যদি আসামে কোনো সম্প্রদায়ের জনসংখ্যার হার হ্রাস পেয়ে থেকে, তা হলে সেটি শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের। এ সময় মুসলমানদের জনসংখ্যা মাত্র ২.৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অথচ ২০০৫-০৬ সালে এ বৃদ্ধির হার ছিল ৩.৬ শতাংশ; অর্থাৎ সরকারি গণনামতে, মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১.২ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। অথচ এর বিপরীতে হিন্দু জনসংখ্যার হার বৃদ্ধি পেয়েছে। আর যেখানে একের অধিক বিয়ে নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, সেখানে বলতে হয়, এটিও কল্পনার চেয়ে বেশি কিছু নয়। কেননা ভারতে নারী-পুরুষের হার বিগত ১০০ বছর ধরে একই রকম বলবৎ রয়েছে। এতে কোনো পরিবর্তন আসেনি। ২০২০ সালের গণনামতে, এক হাজার পুরুষের বিপরীতে নারী রয়েছে ৯২৪ জন। এ অবস্থায় ব্যাপকহারে দ্বিতীয় স্ত্রী গ্রহণের তো প্রশ্নই আসে না।

মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু নিউজ ০৪ জুলাই,
২০২১ থেকে উর্দু থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক : ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us