শামীম ছুটে চলুক বহু দূর

আফফান উসামা | Jul 26, 2021 01:16 pm
শামীম পাটোয়ারী

শামীম পাটোয়ারী - ছবি : সংগৃহীত

 

মাথার ওপরের ওই দূর সোনালি হাসৌজ্জ্বল আকাশটা আজ সফেদ নীল সুন্দর মনমুগ্ধকর হলেও, মনের কোনে বার বার উঁকি দিচ্ছে, হঠাৎ করে তার বুক চিরে কালো মেঘের দেখা মিলবে না তো! কোথাও থেকে এক টুকরো কালো মেঘ ধেয়ে এসে মুহূর্তে গোটা শুভ্র আকাশটা ছেয়ে যাবে না তো। কিংবা, বাগানের আজ সবচেয়ে সুন্দর সুভাসিত ফুলটা হঠাৎ ঘ্রাণ হারিয়ে নিস্তেজ হয়ে ঝরে পড়বে না তো! অথবা, আজ ব্যাট হাতে দারুণ পারফর্ম করে, প্রতিপক্ষের ওপর আক্রমণ চালিয়ে বিপত্তি বাধা দূর করে, সাথে ফিল্ডিং দিয়ে নজর কেড়ে মুগ্ধতা ছড়ানো শামীম কোনো একদিন এই মনেরই কাঁটা হবে না তো!

না, না... আমি কখনো চাই না এমনটা হোক। চাই, এই আকাশ সদা উদ্ভাসিত থাকুক। চাই ফুলটা অনন্তকাল সুভাসিত করুক, চাই শামীম এভাবেই কোটি মানুষের মুখের হাসি হয়েই পথ চলুক। কিন্তু একটা ভয় মনের ভেতরে উঁকি দিয়ে ফিরে বারে বারে৷ আসলে জীবনে ঘটতে থাকা কিছু ঘটনার সুত্রে ভয়টা আপনা আপনিই চলে আসে। সফেদ নীল আকাশ, সুভাসিত ফুল বা একজন শামীম, কম তো দেখেনি এই চোখ। কিন্তু সময়ের স্রোতে কালের বিবর্তনে নীল আকাশে মেঘ জমেছে, অতঃপর তা সেই মেঘলাকাশের বুক চিরে বারিধারা হয়ে ঝরে পড়েছে, বাগানের ওই সুভাসিত ফুলে হঠাৎ পোকা ধরেছে, অতঃপর একদিন তা নিস্তেজ হয়ে ঘ্রাণ হারিয়েছে। শামীমের মতো হাসি ফোটানো নাসির, সাব্বির একটা সময় আফসোসের কারণ হয়েছে, অতঃপর তারা ক্ষণে ক্ষণে বহু দূরে হারিয়েছে, হারাচ্ছে।

আহা নাসির, সাব্বির। কত স্বপ্নই না দেখেছিল এই জাতি তাদের নিয়ে। কতই আশা করেছিল তাদের ঘিরে। কত ইচ্ছেই না পুষেছিল তাদের নামে হৃদয়জুড়ে। কিন্তু হায়... সময়ের পরিক্রমায় তারা আজ শুধুই বুক পোড়ানো গরম দীর্ঘশ্বাস! শুধুই কী তারাই? সম্ভাবনা নিয়ে স্বপ্ন দেখিয়েছে তো আর কত কত নাম। হালের মোসাদ্দেক, শুভাগত, বিজয়রাও একই কাতারে। প্রার্থনা তাই শুধুই প্রভুর দরবারে, তার আকাশে যেন মেঘ না আসে, ফুল যেন সুবাস দেয় শুরুর এই ধারা অব্যাহত রেখে অন্তত দেড় যুগজুড়ে। সাব্বির-নাসিরের মতো শামীম যেন পথ না হারায় ভুল করে। তার নাম যেন দীর্ঘশ্বাস নয়, বরং উচ্চারিত হোক তৃপ্তির সুরে।

যাহোক, আজ পত্রিকাজুড়ে বা টিভি পর্দায় যার নাম সুরে সুরে, সেই শামীম পাটোয়ারীকে চিনে আসি সংক্ষিপ্ত লিখনিতে—

অভিষেক ম্যাচে বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার যে সাকিবের হাতে লাল-সবুজের এই দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার স্বীকৃতি নিলেন শিরে, সেই সাকিবের উদ্বোধনী ম্যাচে শামীম ছিলেন মোটে ছয় বছরের এক বাচ্চা ছেলে৷
২০০০ সালের ০২ সেপ্টেম্বর চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলায় ধানুয়া গ্রামে পিতা আব্দুল হামিদ পাটোয়ারী ও মাতা রিনা বেগমের ঘর আলোকিত করে জন্ম নেন আজকের শামীম পাটোয়ারী। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে শামীম সবার ছোট।

ছোট থেকেই শামীমের পড়ালেখায় মন বসত না। তার ধ্যানজ্ঞান ছিল ক্রিকেটকে ঘিরে। পড়াশোনায় ফাঁকি দিয়ে খেলতে যাওয়ায় ফলে একাধিকবার বাবার হাতে মারও খেতে হয়েছে তার। যাহোক, ৮-৯ বছর বয়সেই স্থানীয় টিভি-টুর্নামেন্টে নাম লিখিয়ে ফেলেন। স্থানীয় ক্রিকেটে শামীমের আশা-জাগানিয়া পারফরম্যান্স দেখে তার চাচা তাকে ভর্তি করে দেন ক্লেমন ক্রিকেট একাডেমিতে। সেখান থেকেই শামীমের ঠিকানা হয় দেশের ক্রিকেটের সূতিকাগার বিকেএসপি। ২০১৫ সালে সফরকারী পশ্চিমবঙ্গ অনূর্ধ্ব-১৭ দলের বিপক্ষে ২২৬ রানের দারুণ এক ইনিংস খেলেন শামীম। ওটাই তাকে ২০১৮ যুব বিশ্বকাপ দলের ক্যাম্পে সুযোগ করে দেয়।

ছোটবেলা অবশ্য শামীম অনুসরণ করতেন তামিম ইকবালকে। তবে যেহেতু নিজে অলরাউন্ডার হয়েছেন, ফলে সাকিব আল হাসান হয়ে উঠেন তার অনুপ্রেরণা। পাশাপাশি কোহলির আক্রমণাত্মক ব্যাটিং তার খুব প্রিয়। আর ফিল্ডিংয়ে তার আদর্শ বিশ্ব সেরা জন্টি রোডস। কিন্তু তখনও কি শামীম ভেবেছিলেন, একদিন তিনি ও তার দল ভবিষ্যৎ প্রজন্মের আদর্শ ও বড়দের অনুপ্রেরণা হবেন? কারণ? কারণ, তারা বিশ্বকাপ জিতেছেন! অনুর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেটে বাংলাদেশকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন করেছেন, শিরোপা জিতিয়েছেন। যা আজো বড়রা বা তার আগেরও যারা, তারাও কখনো পারেননি।

শুরুর দিকে শামীম টপ মিডল অর্ডারে ব্যাটিং করলেও একটা সময় নিজেকে আরো পেছনে নিয়ে আসেন। তিনি তার সাধ্য ও সেরা জায়গাটা খুঁজে নেন। বুঝে নেন দল ও দেশের প্রয়োজনীয়তা- বাংলার ক্রিকেট যে একজন ফিনিশারের অভাবে ভুগে চলেছে। সুতরাং শামীম তার নিজেকে সেভাবেই গড়ে তুলেছেন। অনুর্ধ্ব-১৯ পরবর্তী ঘরোয়া ক্রিকেট বা বিসিবির এ দলের হয়েও নিজের সক্ষমতার প্রমাণ রেখেছেন। নিজের অপার সম্ভাবনার জানান দিয়েছেন। সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু ডিপিএলেও নিজেকে মেলে ধরেছিলেন। ফলেই সুযোগ মিলে গেল জাতীয় দলের পরবর্তী মিশনে, অর্থাৎ জিম্বাবুয়ে সিরিজে। এর আগেই অবশ্য অনুর্ধ্ব ১৯ সতীর্থ শরিফুল জাতীয় দলের দুয়ারে তরি ভিড়িয়েছেন।

শরিফুলও লাল সবুজের হয়ে নিজেকে চিনিয়েছেন বিশ্ব দরবারে। বন্ধু শামীম ফিরবেন খালি হাতে তা কি হতে পারে? প্রথম ওয়ানডেতে একাদশে সুযোগ মিলেনি, কিন্তু বদলি ফিল্ডার হিসেবে মাঠে নেমেই দারুণ ক্যাচে বিস্মিত করেছেন গোটা দেশকে। অতঃপর দ্বিতীয় টি-টুয়েন্টিতে সুযোগ পেয়ে খানিক সময়ের জন্য ব্যাট হাতে ঝড় তুলে ১৩ বলে ২৯ করলেও দলকে জেতাতে পারেননি। কিন্তু শেষ ম্যাচে আর ক্ষুধার্ত থাকেননি, দলকে জিতিয়ে ফিরেছেন বীরের বেশে। মাত্র ১৫ বলে ৩১ রান করে। আর তাতেই আজ খেলার পাতার জাতীয় শিরোনাম তিনি।

যাহোক, এই শামীমের কিন্তু একটা মজার ঘটনা আছে। ঘটনাটা শোনা হয়েছে ক্লেমন একাডেমীর তার কোচের মুখে। একবার তিনি নাকি শামীমকে নিয়ে একটা টুর্নামেন্টে দল পাঠিয়েছিলেন। সেখানে ছক্কা হাঁকিয়ে ছয়টি বল হারিয়ে ফেলেছিলেন শামীম। ফলে আয়োজকরা শামীমকে বলেছিল মাঠ থেকে উঠে যেতে। কারণ তাদের বল ফুরিয়েছে। তবে ওই ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ৯৯ রানে আউট হয়ে সাজঘরে ফিরেছিলেন শামীম।

শেষ কথায় বলি প্রথমের সুর, শামীম ছুটে চলুক বহু দূর। তাকে নিয়ে আরো লিখতে চাই। একবার দুবার নয়, বহুবার। যেই লেখার শিরোনাম হবে ‘দ্য ফিনিশার’!


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us