তালেবানের তুরস্ক বিরোধিতা : নেপথ্যে রাশিয়া ও চীন!

জান্নাত খাতুন | Jul 26, 2021 12:51 pm
তালেবানের তুরস্ক বিরোধিতা : নেপথ্যে রাশিয়া ও চীন!

তালেবানের তুরস্ক বিরোধিতা : নেপথ্যে রাশিয়া ও চীন! - ছবি : সংগৃহীত

 

আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো সরে গেলেও তুরস্ক থেকে যেতে চাচ্ছে। তুরস্ক কেন আফগানিস্তানে থাকতে চায়? আর তালেবান কেন তাতে আপত্তি করছে?

বিষয়টি বুঝতে হলে একটু পিছিয়ে যেতে হবে। ১৬ শতকে ওই সময়ের দুটি বৃহৎ সাম্রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধ হলো। পরবর্তী কয়েক শ' বছর ধরে আরো ১১টি যুদ্ধ হলো। যুদ্ধের ফলে একটি সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে গেল, আরেকটি সাম্রাজ্য সুপার পাওয়ারে পরিণত হলো- ব্রিটিশদের মতো। ওই সাম্রাজ্যগুলোর মধ্যে একটি ছিল ওসমানিয়া সালতানাত, আরেকটি ছিল রুশ সাম্রাজ্য।

তুর্কি ও রুশদের মধ্যকার শত্রুতা শতাব্দী পুরনো। আজ তুরস্ক ও রাশিয়ার সম্পর্ক খানিকটা উষ্ণ হলেও তাদের শত্রুতা এখনো বজায় আছে। রুশ সাম্রাজ্যের সাথে যুদ্ধে ওসমানিয়া সালতানাতের শক্তি কমে যায়। রুশরা মনে করত, ওসমানিয়ারা মধ্য এশিয়ার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা দখল করতে চায়। অবশ্য, এসব যুদ্ধের কারণ ছিল ক্রিমিয়া ও অন্যান্য ইউরোপীয় রাজ্য। তবে এটিও একটি কারণ ছিল৷ ওই যুদ্ধগুলোতে রুশ সাম্রাজ্য জয় লাভ করে তাদের ইউরোপীয় রাজ্য ও মধ্য এশিয়ার রাজ্যগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। আজ একুশ শতকে এসে রুশ সাম্রাজ্য না থাকলেও রাশিয়া নামক দেশ আছে। ওসমানিয়া সালতানাত না থাকলেও তুরস্ক আছে। আর দুই জাতিই নিজেদের ঐতিহাসিক শত্রুতা ভুলে যায়নি।

তো এবার আসা যাক এর সাথে আফগানিস্তানে তুর্কি সেনা থাকা বা না-থাকার সাথে সম্পর্ক কী? আমেরিকা আফগানিস্তান থেকে সৈন্য অপসারণের পর ন্যাটোর দ্বিতীয় বৃহৎ বিশাল সেনাবাহিনীবিশিষ্ট সদস্য তুরস্ককে অনুরোধ করে কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব নেয়ার জন্য।

আমেরিকা এই অনুরোধ করেছে দুটি কারণে। এক, আমেরিকার পরই তুরস্ক ন্যাটোতে সর্ববৃহৎ সেনাবাহিনীর দেশ। দুই, অন্য কোনো ন্যাটো সদস্য দেশ আফগানিস্তানের বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে রাজি নয়।

আফগানিস্তানের বিমানবন্দর নিরাপত্তা আমেরিকা, চীন, রাশিয়াসহ সকলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমেরিকা ও পশ্চিমা শক্তির জন্য। যদি নিরাপত্তা না থাকে বিমানবন্দরের তাহলে কোনো আন্তর্জাতিক ফ্লাইট বিমানবন্দরে আসবে না। ফলে আফগানিস্তান সারা পৃথিবী থেকে প্রায় বিছিন্ন হয়ে যাবে। আর আমেরিকা আফগানিস্তান ছেড়ে গেলেও আমেরিকানরা এখনো যায়নি। আমেরিকার ডিফেন্স কন্ট্রাক্টর বা বেসরকারি ভাড়াটে সেনাবাহিনী এখনো সেখানে আছে। তাদের নিরাপদ যাতায়াতের জন্য কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা জরুরি।

তুরস্ক কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিতে চায় ছয়টি কারণে। এক. আমেরিকার সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন। দুই. এস-৪০০ ক্রয়ের ব্যাপারে আমেরিকার ছাড়পত্রের জন্য। তিন. অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার। চার. কুর্দি বিছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর ওপর থেকে আমেরিকার সমর্থন প্রত্যাহার। পাঁচ. বিমানবন্দরের নিরাপত্তার প্রয়োজনে আমেরিকার দেয়া অত্যাধুনিক অস্ত্র নিজেদের হাতে পাওয়া। ছয়. মধ্য এশিয়া ও আফগানিস্তানে তুরস্কের প্রভাব বিস্তার।

ইতিমধ্যে আমেরিকা বিমানবন্দরের নিরাপত্তার জন্য তুরস্কের প্রায় সকল দাবি মেনে নেয়ার আভাস দিয়েছে। আর তুরস্ক আমেরিকার আধুনিক অস্ত্র বিমানবন্দরের নিরাপত্তার জন্য চেয়ে পাঠিয়েছে। এখানে তালেবান ঘোর বিরোধিতা করছে। তালেবান বলছে ১১ সেপ্টেম্বরের পর আমরা কোনো বিদেশী সেনাকে আফগানিস্তানে দেখতে চাই না।

প্রশ্ন হলো, তুরস্ক কেন আমেরিকার কথায় তালেবানের বিরুদ্ধে যাচ্ছে? মনে রাখতে হবে, তুরস্ক নিজের স্বার্থে আফগানিস্তান থাকতে চায়। এতে তুরস্ক আরো শক্তিশালী হবে এবং তার কিছু সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে। তুরস্কের নিজের স্বার্থ রক্ষার অধিকার অবশ্যই আছে। আর মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ তুরস্ক আরো শক্তিশালী হয়ে উঠলে তা মুসলিম বিশ্বেরই লাভ। আর তালেবান তুরস্কের উপস্থিতি ন্যাটোভুক্ত দেশ হিসেবে চাচ্ছে না, এটাও ঠিক।

তবে তালেবান তুরস্কের উপস্থিতির বিরোধিতা করছে রাশিয়া ও চীনের কথায়। রাশিয়া মনে করে, তুরস্ক আফগানিস্তানে সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখলে মধ্য এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোতে তুর্কি প্রভাব বৃদ্ধি পাবে, যা রাশিয়ার জন্য হুমকি। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে পড়ার পরও মধ্য এশিয়ার তিনটি দেশে এখনো রাশিয়ার প্রভাব প্রবল। এই তিনটি দেশ হলো কাজাখিস্তান, কিরগিস্তান ও তাজিকিস্তান। আর এই তিনটি দেশ রাশিয়ার প্রতিরক্ষা জোট সিএসটিওয়ের সদস্য৷ উজবেকিস্তান ও তুর্কিমেনিস্তানে তুরস্কের প্রভাব রয়েছে। তাই রাশিয়া ঐতিহাসিক শত্রুতা ও কৌশলগত কারণে আফগানিস্তানে তুরস্কের সামরিক উপস্থিতি চায় না। রাশিয়া অধিকন্তু আমেরিকা তুরস্ক ও রাশিয়ার এই দ্বন্দ্বকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে চায়।

তুরস্ক ও চীনের সম্পর্ক মোটামোটি ভালো। কিন্তু তবুও তুরস্কই একমাত্র মুসলিম দেশ যে উইঘুর মুসলিমদের ব্যাপারে আন্তর্জাতিকভাবে এবং চীনের সামনে কথা বলে। এজন্য তুরস্ককে চীন সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে। তাই চীনও জিনজিয়াংয়ের পার্শ্ববর্তী আফগানিস্তানে তুরস্কের সামরিক উপস্থিতি চায় না। আর তাই চীন ও রাশিয়া উভয়ই তালেবানকে তুরস্কের সামরিক উপস্থিতির বিরোধিতা করতে চাপ দিচ্ছে। তালেবান তুরস্ককে সাবধান করার পর অনেকটা ক্রুদ্ধ হয়ে এরদোগান তালেবানকে আফগানিস্তানের দখলদার বলেছে। এরপর তালেবান বলেছে, তারা তুরস্কের সাথে আলোচনা করতে চায়।

চীন ও রাশিয়ার মতো ইরানও আফগানিস্তানে তুরস্কের উপস্থিতি চায় না। ইরান ও তুরস্কের মধ্যেও ঐতিহাসিক শত্রুতা রয়েছে। তুরস্কের উপস্থিতিতে রাশিদ দোস্তামের ইস্যু ছাড়া তালেবানের অন্য কোনো সমস্যা নেই। তবে তুরস্কের উপস্থিতির বিরুদ্ধে তালেবানের কঠোর বিরোধিতা রাশিয়া, চীন ও ইরানের চাপ কাজ করছে। তালেবান কখনোই মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ তুরস্কের সাথে সরাসরি সংঘর্ষে জড়াবে না। তবে রাশিয়া, চীন ও ইরানের চাপে তালেবান কতটুকু তুরস্কের বিরোধিতা করবে সেটা ভবিষ্যৎই বলে দেবে।

লেখক : সাবেক শিক্ষার্থী, আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়, তুরস্ক


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us