সেইভ্রেস চুক্তির ভূরাজনৈতিক প্রভাব
সেইভ্রেস চুক্তির ভূরাজনৈতিক প্রভাব - ছবি : সংগৃহীত
বর্তমান বিশ্বে উদীয়মান পরাশক্তির দেশ তুরস্ক। এশিয়া ও ইউরোপ দুই মহাদেশজুড়ে অবস্থিত এই দেশটি বিশ্বজুড়ে ভূরাজনীতিতে ফেলছে ব্যাপক প্রভাব।
এই তুরস্কই ছিল উসমানীয় সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু। সাম্রাজ্যটি যখন সমৃদ্ধির চূড়ায় পৌঁছেছিল, তখন এর সীমানা ছিল পূর্বে পারস্য উপসাগর থেকে ইউরোপের বলকান অঞ্চল, উত্তরপূর্বে হাঙ্গেরি, উত্তর কৃষ্ণসাগর, রাশিয়া,ককেসাস, পশ্চিমে ইরান, মধ্যপ্রাচ্য, ইরাক, সিরিয়া, ফিলিস্তিন, লেবানন, জর্ডান, মক্কা-মদিনা এবং দক্ষিণে মিসর থেকে উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত। ৬০০ বছর ধরে চলে আসা উসমানীয় সালতানাতের পতন ঘটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর। যদিও বা এর আগেই অ্যন্তরীণভাবে ও বহির্বিশ্বের ইন্ধনে শুরু হয় উসমানীয় সাম্রাজ্যের ভাঙন প্রক্রিয়া। উত্থান ঘটে ইত্তেহাদ তেরেক্কি বা ইয়ং তুর্ক নামক দলের। বলা যায় সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সুলতান আব্দুল হামিদকে নির্বাসনে পাঠানোর মধ্য দিয়ে বিস্তৃত এই সালতানাতের অপমৃত্যু ঘটার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তি হিসেবে অংশ নিয়ে শোচনীয় পরাজয় ঘটে উসমানীয়দের। ফলে অন্যন্য পরাজিত দেশ বা সাম্রাজ্যের মতো উসমানীয় সাম্রাজ্যের সাথেও চুক্তি করে মিত্রশক্তি।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তি হিসেবে ছিল-
যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, রাশিয়া, বেলজিয়াম, সার্বিয়াসহ আরো অনেক দেশ। আর অক্ষশক্তির দেশগুলো হলো- উসমানীয় সাম্রাজ্য, জার্মান সাম্রাজ্য, অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য ও বুলগেরিয়া।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রশক্তি ও অক্ষশক্তির মধ্যে কয়েকটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। চুক্তিগুলো হলো :
১. Treaty of Versailles
২৮ জুন, ১৯১৯ সালে জার্মানির সাথে মিত্রশক্তি
এই চুক্তি করে।
২. Treaty of Saint - Germain - en - Laye
১০ সেপ্টেম্বর, ১৯১৯ মিত্রশক্তি অস্ট্রিয়ার সাথে
চুক্তিটি করে।
৩. Treaty of Neauilly- sur- Seine
২৭ নভেম্বর, ১৯১৯ সালে বুলগেরিয়ার সাথে এই
চুক্তি সম্পাদিত হয়।
৪. Treaty of Trianon
৪ জুন, ১৯২০ সালে হাঙ্গেরির সাথে সম্পাদিত হয়
এই চুক্তি।
৫. Treaty of Sevres
১০ আগস্ট, ১৯২০ সালে উসমানীয় সাম্রাজ্যের
সাথে এই চুক্তি করে মিত্রশক্তি।
সেইভ্রেস চুক্তি :
১৯২০ সালের ১০ আগস্ট ফ্রান্সের সেইভ্রেস শহরে সাক্ষরিত হয় এই চুক্তি। যার কারণে এটি সেইভ্রেস চুক্তি নামে পরিচিত। মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির কাছে হারার ফলে চুক্তির নামে উসমানীয় সাম্রাজ্যের উপর বেশ কিছু শর্ত চাপিয়ে দেয় মিত্রশক্তি। চুক্তির একপক্ষে ছিল উসমানীয় সাম্রাজ্য আর অপরপক্ষে ছিল মিত্রশক্তির দেশ ফ্রান্স, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, ইতালি ও জাপান। তবে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র মিত্রশক্তি হওয়া সত্ত্বেও এই চুক্তিতে ছিল না।
রাশিয়ার চুক্তিতে না থাকার পেছনে কারণ হলো ১৯১৮ সালে রাশিয়া উসমানীয় সাম্রাজ্যের সাথে Brest - Litovsk চুক্তি করে।
আর যুক্তরাষ্ট্র জাতিপুঞ্জের অধীনে আর্মেনিয়ার ম্যান্ডেট নিতে চেয়ে বাঁধা পেয়েছিল তার দেশের উচ্চকক্ষ সিনেট হতে। তবে যুক্তরাষ্ট্র উসমানীয়দের কাছ থেকে সমরিক খরচ মেটাতে আর্থিক ক্ষতিপূরণ দাবি করে।
এই চুক্তিতে উসমানীয়দের হয়ে সাক্ষর করে রিজা তেভফিক, উজিরে আজম দামাত ফেরিদ পাশা, রাষ্ট্রদূত হাদি পাশা ও শিক্ষামন্ত্রী রশিদ হালিস।
চুক্তির বিষয় :
সেইভ্রেস চুক্তিতে মোট অনুচ্ছেদ ছিল ৪৩৩টি। এই চুক্তিতে উসমানীয়দের টুটি প্রায় চেপে ধরা হয়। উসমানীয়দেরকে অথনৈতিক, বাণিজ্যিক, সামরিক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও প্রণালীর নিয়ন্ত্রণের দিক থেকে প্রায় পঙ্গু করার ব্যবস্থা করা হয়।
অর্থনৈতিক বিষয় :
১. চুক্তিতে উসমানীয়দের সকল বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় মিত্রশক্তি।
২. মিত্রশক্তির দেশগুলো উসমানীয়দের বাজেট প্রণয়ন , অর্থ সম্পর্কিত নিয়ম-নীতি নির্ধারণ এবং ব্যাংক সম্পূর্ণভাবে নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে আসে।
৩. উসমানীয় সাম্রাজ্যের মধ্য দিয়ে বিদেশি মানুষ, পণ্য ও জাহাজ শুল্কবিহীন বা অবাধে চলাচলের সুব্যবস্থা করা হয়।
সামরিক বিধিনিষেধ :
১. চুক্তিতে বলা হয় উসমানীয়রা সর্বমোট ৫০, ৭০০ জন সেনা রাখতে পারবে।
২. উসমানীয়দের কর্তৃত্বে নৌ বাহিনীর মাত্র ৭ টি নৌ জাহাজ ও ৬ টি টর্পেডো বোট থাকবে।
৩. জোর করে উসমানীয়দের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত করা হয়।
বিচার
আর্মেনিয়ায় হত্যাকাণ্ডের জন্য উসমানীয়দের আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বিচারের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
প্রণালী :
তুরস্কের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছে বসফরাস ও দার্দানেলিস প্রণালী। ভৌগলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ এই প্রণালী দুইটি। যা তুরস্কের এশিয়া অংশকে ইউরোপ অংশ হতে পৃথক করেছে এবং কৃষ্ণ সাগরকে এজিয়ান সাগরের সাথে যুক্ত করে। যা পরে ভূমধ্য সাগরের সাথে মিশে। কৃষ্ণ সাগরীয় দেশগুলোর ভূমধ্য সাগরে যাওয়ার একমাত্র পথ হল বসফরাস ও দার্দানেলিস প্রণালী। চুক্তিতে এই প্রণালী দুটিকে যুদ্ধ ও স্বাভাবিক অবস্থায় সব দেশের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। এবং প্রণালীর নিয়ন্ত্রণ উসমানীয়দের হাত থেকে দিয়ে দেয়া হয় জাতিপুঞ্জের অধীনে।
ম্যান্ডেট ও দখল :
সেইভ্রেস চুক্তির মাধ্যমে চলে ভাগ বাটোয়ারা। উসমানীয়দের ভূমির বিভিন্ন অংশ মূলত বর্তমান তুরস্কের বিভিন্ন অংশ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় ইতালি, ফ্রান্স ও ব্রিটেন। আর কিছু অংশে প্রবর্তন করা হয় ম্যান্ডেট সিস্টেমের। এছাড়া বেশ কিছু স্বাধীন ভূখণ্ডেরও সৃষ্টি হয়।
ফ্রান্সের অধীনে চলে যায় বর্তমান তুরস্কের বেশ কিছু ভূখণ্ড। এগুলো হলো- আনাতোলিয়া, আন্তিপ, উরফা, মারদিন, চিলিসা, আদনা, দিয়ারবাকির, সিভাস এবং টোকট।
এই চুক্তিতে ১৯১১-১৯১২ সালের টার্কিশ-ইতালি যুদ্ধে ইতালির দখলকৃত অংশ ডোডেকানিজ দ্বীপ এর স্বীকৃতি দেয়া হয়। এর পাশাপাশি ইতালি পশ্চিম আনাতোলিয়াও পায়।
তুরস্কের পশ্চিম অঞ্চলে অবস্থিত দ্বীপ এবং বন্দরগুলোকে ফ্রী জোন বা সবার জন্য উন্মুক্ত ঘোষণা করা হয়। এছাড়া ইস্টার্ন থ্রেস অর্থাৎ বর্তমান ইস্তাম্বুল ও মারমারা সাগরের দ্বীপগুলো গ্রিসের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেয়া হয়।
বর্তমান আর্মেনিয়া রাষ্ট্রটি উসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে থাকলেও সেইভ্রেস চুক্তির মাধ্যমে আর্মেনিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এছাড়া বর্তমান ইরাকের গুরুত্বপূর্ণ শহর মোসল, কুর্দি অঞ্চল ও তুরস্কের কিছু অংশ নিয়ে নতুন দেশ কুর্দিস্তান করার পরিকল্পনা করা হয়।
সেইভ্রেস চুক্তির মাধ্যমে ম্যান্ডেট ব্যবস্থার প্রচলন করা হয়। এর মাধ্যমে জাতিপুঞ্জের অধীনে উসমানীয় সাম্রাজ্যের আরব অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ফ্রান্স ও ব্রিটেনের হাতে।
ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অন্তর্ভুক্ত হয়- বর্তমান স্বাধীন রাষ্ট্র ইরাক, ফিলিস্তিন ও ট্রান্সজর্ডান। আর এদিকে ফ্রান্স ম্যান্ডেটের অন্তর্ভুক্ত করা হয় সিরিয়া ও লেবাননকে। ম্যান্ডেট ভুক্ত দেশগুলো পরে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের কাছে থেকে স্বাধীন হয়। তবে আরব অধ্যুষিত বর্তমান সৌদি আরবের হেজাজ অঞ্চলকে ম্যান্ডেটের অধীন না করে স্বাধীন হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
এতসব ভাগ বাটোয়ারা করার ফলে ১৯১৪ সালে ১৫, ৮৯,৫৪০ বর্গ কিলোমিটার থেকে চুক্তির পর উসমানীয় সাম্রাজ্যের আয়তন হয়ে যায় ৪, ৫৩, ০০০ বর্গ কিলোমিটার। যা বর্তমান তুরস্কের আয়তনের প্রায় এক চতুর্থাংশ।
আর যুদ্ধে হারার ফল হিসেবে মিত্রশক্তির এমন একতরফা চুক্তি উসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতান মেনে নিলেও তা মেনে নেয়নি কামাল পাশার নেতৃত্বাধীন সরকার। যাদের নেতৃত্বে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পরই ১৯১৯ সালে শুরু হয় তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধ। যা চলে ১৯২৩ সালের ২৯ অক্টোবর পর্যন্ত।
যুদ্ধরত অবস্থায় এই চুক্তিকে অস্বীকার করে কামাল পাশার নেতৃত্বাধীন সরকার। ফলে এই চুক্তি সাফল্যের মুখ দেখতে পায়নি। এবং পরে মিত্রশক্তি আরো একটি চুক্তি করতে বাধ্য হয়।