বিখ্যাত লোকেরা কতক্ষণ ঘুমান!
বিখ্যাত লোকেরা কতক্ষণ ঘুমান! - ছবি : সংগৃহীত
বিজ্ঞান থেকে দর্শন, মনোবিদ্যা থেকে সমাজতত্ত্ব- বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা একেক রকম ভাবে ঘুমকে দেখেছেন। এটুকু সকলেরই জানা যে ঘুমের অন্যতম কাজ ক্লান্তি দূর করা। শারীরিক বা মানসিক, দু’রকম ক্লান্তিই দূর করতে পারে ঘুম। কিন্তু একজন মানুষের দিনে কতক্ষণ ঘুম প্রয়োজন? সাধারণ ধারণায় সাত থেকে আট ঘণ্টা ঘুম একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দরকার। অথচ সভ্যতার ইতিহাসে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য মানুষের ঘুমের স্বভাব জানলে অবাক হতে হয়।
লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি : ইটালীয় নবজাগরণের অন্যতম পথিকৃৎ বহুমুখী প্রতিভাধর এই মানুষটির ঘুমের অভ্যাস ছিল অদ্ভুত। তিনি কখনো একটানা বেশিক্ষণ ঘুমোতেন না। ২০ মিনিট থেকে বড়জোর দু’ঘণ্টা তিনি টানা ঘুমাতেন। দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার তিনি এমন ঘুম দিতেন। দ্য ভিঞ্চি বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই বিচিত্র ঘুমের কারণে নাকি তার চিন্তাসূত্র বার বার ছিঁড়ে যেত। সেই জন্য তার অনেক কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
উইলিয়াম শেকসপিয়র : এই বিখ্যাত ইংরেজ কবি-নাট্যকারের জীবন রহস্যে পূর্ণ। খুব কম কথাই জানা যায় শেকসপিয়রের ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে। তার ২৭ সংখ্যক চতুর্দশপদীতে তিনি এমন কিছু ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, যা থেকে বোঝা যায়, শেকসপিয়র অনিদ্রায় ভুগতেন। এই অনিদ্রার কথা ছড়িয়ে রয়েছে তার অনেক নাটকের সংলাপেও।
নেপোলিয়ন বোনাপার্ট : ফরাসি সম্রাট, দিগ্বিজয়ী বীর নেপোলিয়নের ঘুম নিয়েও রয়েছে অনেক কাহিনি। জানা যায়, রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে তিনি সচরাচর পোশাক বদলাতেন না এবং পুরো রাতটাও ঘুমোতেন না। বরং দিনের কোনো কোনো সময়ে তিনি খানিকক্ষণ ঝিমিয়ে নিতেন। এমনকি যুদ্ধযাত্রার সময় ঘোড়ার পিঠে বসেও ঝিমিয়ে নিতে পারতেন তিনি। তবে কোনো অভিযান শেষ হলে নেপোলিয়ন টানা ১৮ ঘণ্টা ঘুমিয়েছেন, এমন নজিরও রয়েছে।
লুডভিগ ভন বিঠোভেন : এই বিখ্যাত জার্মান সুরস্রষ্টা এমনিতেই ছিলেন বেশ জটিল চরিত্রের মানুষ। অনেকগুলো শারীরিক সমস্যাও ছিল তার। এক সময়ে বধিরও হয়ে যান এই প্রতিভাধর। অনিদ্রা রোগে ভোগা মানুষদের স্নায়ুকে স্নিগ্ধ করার জন্য তার বেশ কিছু সঙ্গীত রয়েছে। আজও সেই সব সুর বহু মানুষের চোখে ঘুম নিয়ে আসে। তা হলে কি নিজেও অনিদ্রায় ভুগতেন বিবিধ যন্ত্রণায় দীর্ণ বিঠোভেন? তার জীবনীকাররা জানাচ্ছেন, একেবারেই তা নয়। ঘুমের ব্যাপারে বিঠোভেন ছিলেন একেবারেই স্বাভাবিক। প্রতি দিন রাত ১০টায় নিয়ম করে ঘুমোতে যেতেন তিনি। ঘুম ভাঙত কাঁটায় কাঁটায় ভোর ছ’টায়।
চার্লস ডিকেন্স : ১৯ শতকের এই ইংরেজ সাহিত্যিক ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই অনিদ্রা রোগী। ঘুম নিয়ে বিস্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষাও চালিয়েছিলেন ডিকেন্স। এক সময়ে তার ধারণা হয়, উত্তর দিকে মাথা করে শুলে বোধ হয় ঠিকঠাক ঘুম আসবে। সে কারণে তিনি বিছানায় একটা কম্পাসও রাখতেন। কিন্তু সে সবে কাজ না হওয়ায় অনিদ্রা বেড়ে যায়। রাত বিরেতে লন্ডনের পথে পথে ঘুরতে শুরু করেন তিনি। এমনই এক বিনিদ্র রাতে হাঁটতে হাঁটতে ডিকেন্স ৪৮ কিমি অতিক্রম করে রোচেস্টারে তার খামার বাড়ি পর্যন্ত চলে যান। জানা যায়, সূর্যোদয়ের পরেই নাকি ঘুমোতে পারতেন ডিকেন্স।
মেরি শেলি : ইংরেজ কবি পি বি শেলির পত্নী তার যুগান্তকারী উপন্যাস ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’-এর সূত্রই পেয়েছিলেন আধো ঘুমে-আধো জাগরণে দেখা এক স্বপ্নে। পরে এই ঘটনাকে অনেক বিশেষজ্ঞ ‘স্লিপ প্যারালিসিস’ বলে চিহ্নিত করেছেন। এই অবস্থায় মন পূর্ণ মাত্রায় জাগ্রত থাকে, কিন্তু দেহ সাময়িকভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। এমন অবস্থাতেই নাকি এক ভয়ানক স্বপ্ন দেখেন মেরি আর সেই স্বপ্নের কথা জানান স্বামী ও তার বন্ধুদের। এই আড্ডা থেকেই উঠে আসে ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন অর দ্য মডার্ন প্রমিথিউস’ নামের উপন্যাস।
চার্লস ডারউইন : ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত তার গ্রন্থ ‘অন দি অরিজিন অব স্পিসিজ’ আমূল বদলে দিয়েছিল মানুষের ধারণার জগৎ। বিবর্তনবাদের জনকের ঘুমের বিষয়টি কিন্তু খুব সুবিধের ছিল না। তার ছেলে ফ্রান্সিস ডারউইন লিখেছেন, তার বাবার দিন শুরু হতো সকাল ৭টায়। দুপুর ৩টার সময় তিনি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতেন এবং রাত ১০টায় ঘুমাতে যেতেন। এত নিয়মানুবর্তিতা সত্ত্বেও ডারউইন সাহেবের ঘুম খুব শান্তির ছিল না। আসলে তিনি বিভিন্ন অসুখে ভুগতেন। ওই সব অসুখের অনিবার্য পরিণতি ছিল অনিদ্রা। সারা জীবন ডারউইন অনিদ্রার সাথে লড়াই করেছেন।
মারি ক্যুরি : জীবনে দু’বার নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন এই বিজ্ঞানী। মানুষ তাকে কাজ-পাগল বলেই জানত। সত্যিই খুব কম সময় তিনি বরাদ্দ রাখতেন ঘুমের জন্য। আসলে যে পরীক্ষাগারে তিনি কাজ করতেন, তার তাপমাত্রা এতটাই শীতল থাকত যে তিনি সেখানে ঘুমাতে পারতেন না। ক্যুরির গবেষণা ছিল পদার্থের বিকিরণ সংক্রান্ত বিষয়ে। যে কারণে তাকে এমন সব পদার্থের মধ্যে দিন কাটাতে হতো, যাদের বিকিরণ ক্ষমতা তীব্র। শোনা যায়, তিনি নাকি তার বিছানার পাশে একটি কাচের পাত্রে রেডিয়াম রেখে দিতেন।
সালভাদোর দালি : সু্ররিয়াল বা স্বপ্নবাস্তব চিত্রকলার অন্যতম পথিকৃৎ সালভাদোর দালির অন্যতম বিখ্যাত ছবির নাম ‘স্লিপ’ বা ঘুম। দালির ছবির ভুবনটিই নাকি স্বপ্নের। স্বপ্ন সত্যিই দালির ছবির মতো হয় কি না, তা নিয়ে বিস্তর তর্ক রয়েছে রসিক মহলে। কিন্তু অনেকেরই কৌতূহল দালি নিজে ঘুম সম্পর্কে কী ভাবতেন বা তার নিজের ঘুমের কোনও বৈশিষ্ট্য ছিল কি না। জানা যায়, দালি অনেক সময় একটা ক্যানভাস পাশে নিয়ে ঘুমোতেন, যাতে স্বপ্ন থেকে জেগে উঠেই সেটা এঁকে ফেলা যায়। কিন্তু দালি নিজেই আবার ঘুমানোকে বাজে সময় নষ্ট বলতেন, তার সাক্ষ্যও রয়েছে।
দালির ঘুম নিয়ে এক আশ্চর্য তথ্য দেয় বিজ্ঞান পত্রিকা ‘নিউ সায়েন্টিস্ট’। দালি নাকি একটা চাবি এক হাতে নিয়ে মাটিতে পাতা একটা ধাতব পাতের উপর ঘুমাতে যেতেন। ঘুম গভীর হলে হাত থেকে চাবিটি পড়ে যেত ধাতব পাতটির উপর। আর তার শব্দে দালি জেগে উঠে আঁকতে বসে যেতেন।
অ্যালবার্ট আইনস্টাইন : কিংবদন্তিপ্রতিম প্রতিভাধর বিজ্ঞানী নিয়ম করে ১০ ঘণ্টা ঘুমাতেন প্রতি রাতে। সাধারণ মানুষের চেয়ে কিছুটা বেশিই। অসামান্য মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দেয়ার জন্যই কি এই অতিরিক্ত সময়? এ নিয়ে রসিকতা আজও চালু রয়েছে।
নিকোলা টেসলা : সার্বিয়ান-আমেরিকান এই নিখ্যাত প্রযুক্তিবিদ-আবিষ্কারক অল্টারনেটিভ কারেন্ট (এসি)-এর উদ্ভাবক। বিভিন্ন জিনিস আবিষ্কারের কারণে তার নামে ৩০০-রও বেশি পেটেন্ট ছিল। কিন্তু আশ্চর্য ঘুমের কারণেও টেসলা এক উদাহরণ হয়ে রয়েছেন। তিনি নাকি প্রতি রাতে দু’ঘণ্টার বেশি ঘুমাতেন না। কিন্তু দিনের বিভিন্ন সময়ে তিনি সুবিধে বুঝে খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নিতেন। একে টেসলা বলতেন ‘রিচার্জিং দ্য ব্যাটারি’। টেসলা বাল্যকাল থেকে দুঃস্বপ্ন দেখতেন। তাই কি ঘুমকে ভয় পেতেন এই প্রতিভাধর? উত্তর অধরা।
সূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা