নিজেদের যেভাবে বদলে ফেলেছে তালেবান
তালেবানের কয়েকজন সদস্য - ছবি : সংগৃহীত
তালেবান তাদের আগেকার কট্টর অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে আসছে, বিশেষত নারীদের শিক্ষা ও কাজের ব্যাপারে। আমাদের অনেকের সীমাবদ্ধতাই এমন যে তালেবানের কৌশল যে আপডেটেড হয়েছে, সে বিষয়ে স্টাডি না করে আমরা তালেবান সম্পর্কে আগের ধারণাই বহাল রাখছি।
এটা সত্য যে মানুষের মধ্যে তালেবানভীতি রয়েছে, যা পশ্চিমা মিডিয়ার সুদীর্ঘ একতরফা প্রপাগান্ডার ফল। মিডিয়ার তালেবানভীতি ছড়ানো গত ২০ বছর ধরেই অব্যাহত ছিল। এখনো আছে। এই তালেবানভীতির রাজনীতির দিন সমাপ্ত হয়েছে পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে বিদ্যুত নিভিয়ে আফগানিস্তান থেকে তল্পিতল্পাসহ আমেরিকার প্রস্থানের মাধ্যমে।
যাই হোক, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রস্তুতি নিচ্ছে আসন্ন তালেবান সরকারের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য৷ ইতোমধ্যে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, 'তালেবান ক্ষমতায় এলে তাদের সাথে ব্রিটেন একসাথে কাজ করবে' (রয়টার্স, ১৪ জুলাই ২০২১)। এমনকি ভারতও ব্যাক-চ্যানেলে তালেবানের সাথে বৈঠক করতে তদবির করছে।
আফগানিস্তানে এখন তালেবানই ক্ষমতায় আসছে, যা অপ্রতিরোধ্য বলেই প্রতীয়মান। এটাই বাস্তবতা। এই বাস্তবতা মেনেই তালেবান সম্পর্কে আমাদের আগের প্রতিক্রিয়াশীল বিরূপ মনোভাব পরিবর্তন করা জরুরি মনে করি। আর যেহেতু ভারতও তালেবানের সাথে বৈঠকে বসার উদ্যোগ নিয়েছে, তাই আমাদের উচিত তালেবানফোবিয়ার চর্চা না করা এবং তালেবানের বর্তমান আপডেটেড চিন্তাভাবনা স্টাডি করে বাংলাদেশ সরকার কিভাবে সম্ভাব্য আফগান তালেবান সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করবে, সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা– যেমনটা এখন করছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। এটাও এখন লক্ষণীয় যে তালেবান কূটনৈতিক দক্ষতায় দূরদর্শিতা ও পারদর্শিতা দেখানো শুরু করেছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, পৃথিবীর সব জায়গায় ঢালাওভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি বা কামনা করাটা একটি গুরুতর ফ্যাসিস্ট মনোভাব, যেটা খোদ পশ্চিমা বিশ্ব লালন করে। এই ফ্যাসিস্ট চিন্তাপ্রসূত হয়েই তো আফগানিস্তানকে গণতান্ত্রিক দেশ বানানোর লক্ষ্যে আমেরিকাসহ গোটা পাশ্চাত্য শক্তি দেশটিতে আগ্রাসন চালিয়ে দুই দশক ধরে বোমা মেরে লক্ষ লক্ষ বেসামরিক নিরীহ মুসলমানদের হত্যা করেছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত ফলাফল কী দাঁড়াল? না পেরেছে তালেবানকে নির্মূল করতে, আর না পেরেছে আফগানিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে। বরং আজকে গোটা পাশ্চাত্য জোট তথা ন্যাটো বাহিনী পরাজয় মেনে পাততাড়ি গুটিয়ে আফগানিস্তান থেকে ভেগেছে।
যদি আমেরিকা আগ্রাসন না চালাত, তাহলে এই ২০ বছরের মধ্যে বিতর্কিত বিষয়গুলোতে কি তালেবানের কৌশলের পরিবর্তন আসত না? অবশ্যই আসত। যদি না আসত, তাহলে এখনো তো সেই পরিবর্তন আসত না। এমনকি আফগানিস্তানে মার্কিন হামলার আগে তৎকালীন ক্ষমতাসীন তালেবান সরকার শান্তি-আলোচনা করতে চেয়েছিল। কিন্তু ওই শান্তি-আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেই আমেরিকা আগ্রাসন চালিয়েছিল। কিন্তু ২০ বছর পর সেটার পরিণতি আজকে হাতেনাতে আমরা দেখতে পাচ্ছি। আধুনিকতা ও গণতন্ত্রের ধ্বজাধারীদের ফ্যাসিস্ট মনোভাব ও প্রত্যাখ্যানবাদিতাও কতটা সমস্যাজনক, তা বলা বাহুল্য।
আফগানিস্তানে ক্ষমতায় কে থাকবে বা আসবে, সেটা ওই দেশের জনগণই ঠিক করুক। বিষয়টি আফগান জনগণের ওপর ছেড়ে না দিয়ে ২০ বছর ধরে পশ্চিমা জোট বোমার জোরে আফগানিস্তানে পরিবর্তন আনতে চেয়েছিল, যা ছিল মহা ভুল।
আজকে ওই ভুল শোধরানোর সময় দোরগোড়ায়। আফগান জনগণই তাদের শাসকগোষ্ঠী ও শাসনব্যবস্থা ঠিক করুক। আফগান জনগণকে যারা নেতৃত্ব দিবে, তারাই মূলত ঠিক করবে সেটা।
এছাড়া, নব্বই দশকে নারীশিক্ষার ব্যাপারে তালেবানের প্রশ্নবিদ্ধ ভূমিকার কারণেই ভয় তৈরি হয়েছে যে আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় এলে সেখানকার মেয়েদের শিক্ষার অধিকার আবারও রুদ্ধ করবে কিনা এবং মেয়েদের ঘরবন্দি করবে কিনা। কিন্তু নারীশিক্ষার ব্যাপারে তালেবান এখন যথেষ্ট সচেতন ও সময়োপযোগী চিন্তাভাবনা করছে। এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে পরিবর্তনের লক্ষণ আগ থেকেই পরিষ্কার হচ্ছিল।
এক্ষেত্রে ফরেন অ্যাফেয়ার্সের একটা রিপোর্ট প্রণিধানযোগ্য, সেখান থেকে একটা উদ্ধৃতি দিচ্ছি :
For the last year, Habib-ur-Rahman has been running a small girls school in his own home in this remote area of rural Afghanistan, which is largely dominated by the Taliban. In a previous era, when the Taliban completely ruled the country before 9/11, that would have been impossible: The radical Islamist group forbade formal education for girls. But things are different this time, villagers say. Some of the girls at Rahman’s school are actually related to active Taliban members, and according to the villagers, the insurgents have assured them that they have no qualms with his girls’ school. “Some of my students are daughters, sisters, or nieces of Taliban fighters. Mostly, all of these men are not living in our village,” Rahman told Foreign Policy. “They are busy with fighting and hiding. But they encouraged their relatives to visit my school and get educated.” “My brother is a Taliban fighter. But he does not have any problems with the school. He wants me to seek wisdom and education,” said Latifa Khostai, one of Rahman’s students. (In Rural Afghanistan, Some Taliban Gingerly Welcome Girls Schools, 4 May, 2020, Foreign Affairs).
অন্যদিকে, আফগানিস্তানে মেয়েদের জন্য স্কুল করার ক্ষেত্রে আমেরিকা ব্যাপক আর্থিক সহযোগিতা দিয়েও চরম ব্যর্থ হয়েছে। এ বিষয়ে ফরেন অ্যাফেয়ার্সের উক্ত রিপোর্টে জানা যায়, আফগানিস্তানে স্কুল ও শ্রেণীকক্ষ গঠনসহ পাঠ্যবই তৈরির জন্য ২০০২ সাল থেকে আমেরিকা প্রায় এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে। কিন্তু বেশিরভাগ টাকাই যুদ্ধবাজ ও দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তাদের পকেটে চলে যায়। এর ফলে স্কুলগুলো পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে। ২০১৫ সালের মধ্যে আফগান শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত অন্তত ১ হাজারেরও বেশি স্কুলের কার্যক্রম একেবারেই শুরু করা যায়নি। পরে, এই স্কুলগুলো 'ভুতুড়ে স্কুল' হিসেবে পরিচিতি পায়। এছাড়া, সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা আমেরিকার কাছ থেকে আরো অর্থ-সহায়তা বাগানোর জন্য ওই স্কুলগুলোতে মেয়েদের উপস্থিতির সংখ্যাকে প্রায়ই অতিরিক্ত গণনা করে উপস্থাপন করত। ‘ভুতুড়ে স্কুল’খ্যাত পরিত্যাক্ত স্কুলগুলোতে প্রকৃতপক্ষে কোনো মেয়ে শিক্ষার্থীর উপস্থিতিই ছিল না। এই ভুতুড়ে স্কুলগুলোই সম্ভবত আফগানিস্তানে আমেরিকার ব্যর্থতার সবচেয়ে ন্যক্কারজনক নজির!
যাই হোক, ফরেন অ্যাফেয়ার্সের উক্ত রিপোর্টে জানা যায়, আফগানিস্তানের বাদিখালে (তালেবান-নিয়ন্ত্রিত এলাকা) হাবিবুর রহমানের পরিচালিত মেয়েদের স্কুলটি ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। ফরেন অ্যাফেয়ার্সকে তিনি বলেছেন, 'আমাদের স্কুলটি জীবন্ত। পশ্চিমা ও কাবুল সরকারের লোকেরা আমাদের ব্যাপারে গ্রাহ্য করবে কিনা আমার সন্দেহ আছে।'
নারী অধিকারের ব্যাপারে সম্প্রতি দ্যা এসোশিয়েটেড প্রেস (এপি)-কে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তালেবানের মুখপাত্র সুহাইল শাহীন বলেছেন : আমাদের কাছে এবং অন্য আফগানদের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি নতুন সরকার গঠিত হলে মেয়েদের স্কুলে যেতে দেয়া হবে, কাজে যেতে দেওয়া হবে এবং রাজনীতিতে অংশগ্রহণও করতে দেওয়া হবে, তবে তাদেরকে অবশ্যই হিজাব পরতে হবে। তিনি আরো বলেছেন : নতুনভাবে দখলকৃত এলাকাগুলোতে তালেবান কমান্ডাররা স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয় ও মার্কেটগুলো আগের মতোই মেয়েদের অংশগ্রহণসহ চালু রাখার নির্দেশ দিয়েছে (To reach a peace deal, Taliban say Afghan president must go, 22 July 2021, AP)।
অন্যদিকে, আফগানিস্তানে ক্ষমতার পটপরিবর্তনপূর্বক তালেবান কেমন ধরনের নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায় সে ব্যাপারে উপরোক্ত সাক্ষাতকারে সুহাইল শাহীন খোলাখুলিভাবে বলেছেন যে, তারা একচেটিয়াভাবে ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণে বিশ্বাসী নয়; কারণ আফগানিস্তানে অতীতে একক ক্ষমতার অধিকারী এমন কোনো সরকারই সফল হয়নি (এই মূল্যায়নে অতীতে তালেবানের ৫ বছরের নিজস্ব শাসনও অন্তর্ভুক্ত বলে উল্লেখ করা হয়েছে)। তাই তারা অতীতের মতো একই 'ফর্মুলা'র পুনরাবৃত্তি করতে চায় না; বরং সংঘর্ষে জড়িত অন্য আফগান সহগোষ্ঠীদের সঙ্গে দেন-দরবারের ভিত্তিতে সব পক্ষের সম্মতিতে কাবুলে একটি অবিসংবাদিত সরকার গঠন করা ছাড়া আফগানিস্তানে শান্তি প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই বলে তারা মনে করে।
এছাড়া রাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে তালেবানের রাজনৈতিক ডেপুটি চিফ মোল্লা আবদুল ঘানি বারাদার এ বছরের জুনে ভয়েস অফ আমেরিকাকে এক সাক্ষাতকারে বলেছেন : We take it on ourselves as a commitment to accommodate all rights of citizens of our country, whether they are male or female, in the light of the rules of the glorious religion of Islam and the noble traditions of the Afghan society (20 June, 2021, VOA). (অর্থাৎ, প্রতিশ্রুতিস্বরূপ আমরা এটা দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছি যে আফগান সমাজের মূল ঐতিহ্য এবং মহান ধর্ম ইসলামের বিধি-বিধানের আলোকে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দেশের নাগরিকদের অধিকারগুলো আমরা সমন্বয় করব)।
তিনি ভয়েস অফ আমেরিকাকে আরো বলেছেন, তার দল (তালেবান) সংখ্যালঘুদের অধিকারসমূহ নিশ্চিত করবে এবং আফগানিস্তানে কর্মরত রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোকে নিরাপদ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য নিরাপত্তা প্রদান করবে।
সুতরাং, তালেবান এখন অনেক অগ্রসর ও সময়োপযোগী মানসিকতা লালন করছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। দূরদর্শিতার সাথে সমগ্র আফগান জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে তারা একটি সময়োপযোগী শাসনব্যবস্থা ও রাষ্ট্রকাঠামো দাঁড় করাতে সক্ষম হোক– এটাই কামনা করি।
বিশ্বের নাম্বার ওয়ান সুপার পাওয়ারের বিরুদ্ধে প্রায় দুই দশক টানা সামরিক যুদ্ধ করে স্বদেশকে দখলদারমুক্ত করেছে তালেবানই, তাই ক্ষমতা পাওয়ার হক তাদেরই সবচেয়ে বেশি৷ তারা মুক্তিযোদ্ধা; আফগানিস্তানের শ্রেষ্ঠ ভূমিপুত্র।