তুরস্ককে আফগানিস্তান ছাড়তেই হবে?
তুরস্ককে আফগানিস্তান ছাড়তেই হবে? - ছবি : সংগৃহীত
প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথেও তালেবান সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। আফগানের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী পাকিস্তান সম্পর্কে তালেবান মুখপাত্র জবিহুল্লাহ মুজাহিদ বলেন, 'পাকিস্তান আমাদের দ্বিতীয় আবাস। আফগান লাখ লাখ শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়ায় আমরা তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ।' এতে একদিকে যেমন পাকিস্তানের প্রতি তালেবানের কৃতজ্ঞতা ফুটে ওঠে, আবার আগামীতে পাক-তালেবান সুসম্পর্ক গড়ার প্রতিও অনুচ্চারিত আগ্ৰহ প্রকাশ পায়। এজন্য দেখা যায়, পাকিস্তানের প্রস্তাবে তালেবান কাবুল সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক সংলাপে বসতে সম্মত হয়েছে। তালেবানের কৃতজ্ঞতার স্থান থেকে বোঝা যায়, আগামীতে তালেবান ইসলামাবাদের নিরাপত্তা গুরুত্বের সহিত বিবেচনা করবে। তালেবান মুখপাত্র জবিহুল্লাহ মুজাহিদ বিষয়টি খোলামেলা আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, 'পাকিস্তানের নিরাপত্তা আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।'
প্রতিবেশী দেশ ইরানের সাথেও দূরত্ব কমিয়ে আনছে তালেবান। কঠোর শিয়া বিরোধিতার মানস থেকে ১৯৯৮ সালে মাজার-ই-শরিফ শহরে হামলা চালিয়ে ইরানি দূতাবাসের নয়জন কূটনীতিককে হত্যা করে। কিন্তু ভৌগোলিক গুরুত্ব বিবেচনায় এবার শিয়াবিরোধী কঠোর মনোভাব থেকে সরে এসেছে তালেবান। অপর দিকে পুরনো শত্রুতা চাপা দিয়ে তালেবানের সক্ষমতা স্বীকার করে ইরানও তালেবানের সাথে কৌশলগত মিত্রতা গড়তে আগ্রহী। এরই অংশ হিসেবে তালেবান ও কাবুল সরকারের মাঝে সংলাপের ব্যবস্থা গ্ৰহণ করে দেশটি। শিয়া-সুন্নি মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব পাশ কাটিয়ে এই সম্পর্কে তালেবান কতটুকু লাভবান হতে পারবে, ভবিষ্যতই তা বলে দিবে। তবে অভ্যন্তরীণ রাজনীতির স্থিতিশীলতার জন্য যাপিত সময়ে এই সম্পর্ক গড়া তালেবানের জন্য ছিলো নেহায়েত জরুরি।
প্রতিবেশী চীনের সাথেও রয়েছে তালেবানের উষ্ণ সম্পর্ক। ২০১৯ সালের শেষ দিকে বেইজিংয়ে তালেবান ও চীনা কর্মকর্তাদের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তালেবান মুখপাত্র সোহেল শাহিন তখন বলেন, "চীন আফগানের 'বন্ধু'। এবং বেইজিং পুনর্নির্মাণ কাজে বিনিয়োগ বিষয়ে তালেবানের সাথে কথা বলবে বলে আশাবাদী।'' চীনও তখন তালেবানকে সমর্থন করে। মার্কিন বাহিনীর সঙ্গে তাদের শান্তিচুক্তিকে স্বাগত জানায়। আফগান-ভূমে বিনিয়োগ প্রস্তাবে সন্তোষ প্রকাশ করে। চীন-পাকিস্তান করিডোরে আফগানকে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে দেখতে চায় চীন। এতে সমুদ্র বিহীন আফগান যেভাবে সমুদ্র ব্যবহারের সুযোগ পাবে, চীনও আফগানের বুক চিরে 'স্তান' রাষ্ট্রগুলোর বিশাল বাজার ধরতে পারবে। তাছাড়া খনিজ সম্পদ উত্তোলনেও চীনের সহযোগিতার আগ্ৰহ রয়েছে প্রচুর। তবে তালেবান স্পষ্ট করে দিয়েছে, চীনের সাথে তাদের সম্পর্ক হবে কেবলই সহযোগিতামূলক। অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের সুযোগ দেয়া হবে না। চীনও অ-হস্তক্ষেপের নীতি অবলম্বনের প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। তবে উইঘুর ইস্যুতে চীন আশঙ্কা প্রকাশ করলে তালেবান মুখপাত্র বলেন, 'আফগানে যেকোনো বিদ্রোহী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে সক্রিয় হতে দেবে না তালেবান। আমরা অঙ্গীকার করছি, কোনো দেশের নাগরিক বা গোত্র যদি আফগানকে চীনসহ অন্য কোনো দেশের উপর আক্রমণের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করতে চায়, আমরা তাদের প্রতিহত করব।' এতে চীনের প্রতি আশ্বাসবাণী থাকলেও বিশ্লেষকরা মনে করছেন, তথাপি চীন চিন্তা মুক্ত হতে পারবে না। কারণ, তালেবানের সাথে যোগ দিয়ে অনেক উইঘুর মুসলিম মার্কিনবিরোধী যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। তালেবান তাদের সহযোগিতা না করে পারবে না। তাছাড়া ইতোপূর্বে উইঘুরদের সহযোগিতা করার ইতিহাস রয়েছে তালেবানের।
রাশিয়ার সাথে সীমান্ত না থাকলেও নানা কারণে আফগান রাশিয়ার জন্য প্রাসঙ্গিক। এজন্য মস্কো তালেবানের সাথে সম্পর্ক গড়তে আগ্ৰহী। এরই অংশ হিসেবে পুরোনো মিত্র ভারতকে ছেড়ে তালেবানের ঘনিষ্ঠ মিত্র পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে। আয়োজন করেছে তালেবান ও কাবুল সরকারের মাঝে রাজনৈতিক সংলাপের।
তালেবানের সাথে কিছুটা দূরত্ব এখন তুরস্কের। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের পর আফগানে শান্তি প্রতিষ্ঠা, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর নিরাপত্তা বিধানকল্পে আমেরিকার প্রস্তাবে ন্যাটোজোটের শক্তিশালী অংশীদার তুরস্ক কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে ইচ্ছুক। তালেবানের নেতৃবৃন্দ কঠোরভাবে এর বিরোধিতা করেন। হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, 'ন্যাটোভুক্ত কোনো দেশ যে অজুহাতেই আফগানে অবস্থান করুক, আমরা তাদের দখলদার বিবেচনা করব। এবং তাদের সাথে দখলদারের মতোই আচরণ করা হবে।'
অর্থাৎ তালেবানের দাবি, তুরস্ক এখন ন্যাটো জোটের সাথেই ফিরে যাক। আফগানে স্বাধীন সরকার গঠিত হলে সহযোগিতামূলক বিষয় নিয়ে তখন আলোচনা করা যাবে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও এনজিও কর্মীদের নিরাপত্তা তারাই দেবে। ন্যাটো জোটের কাউকে অবস্থানের সুযোগ দিয়ে স্বাধীনতার নামে অধীনতা মানতে তারা নারাজ।
তালেবানের দোহাভিত্তিক মুখপাত্র সোহেল শাহিনের বক্তব্যেও এই আবেদন ফুটে ওঠে। তিনি বলেন, '২০ বছর ধরে তুরস্ক ন্যাটো জোটের অংশ হিসেবে আফগানে ছিল। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ২০২০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারিতে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুসারে আঙ্কারাকেও আফগান ছাড়তে হবে।'
এ থেকে বোঝা যায়, তুরস্কের অবস্থানকে তালেবান দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশি হস্তক্ষেপ বলেই গণ্য করবে। তালেবানের মুখপাত্র জবিহুল্লাহ মুজাহিদের বক্তব্যে বিষয়টি আরো স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, 'আফগানে কাবুল বিমানবন্দর ও কূটনীতিক মিশনের নিরাপত্তার দায়িত্ব আফগানদের হাতেই থাকতে হবে। এর পরিবর্তে যেকোনো তৎপরতাকে দেশটির অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশী হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করা হবে।'
তুরস্ক অবশ্য কিছু শর্ত সাপেক্ষে কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় থাকতে চায়। ন্যাটোজোটের সেগুলো মানার অভিপ্রায় এখনো স্পষ্ট নয়। তবে তুরস্ক বলেছে, শর্ত মেনে নেয়া হলেও তাদের আফগানে থাকা না থাকার সিদ্ধান্তে পুনর্বিবেচনা করার সুযোগ থাকবে।