হিং : দামি মসল্লা ও কার্যকরি ওষুধ
হিং - ছবি : সংগৃহীত
মরুভূমির গাছ, নাম হিং। একটি বিদেশী কোম্পানিতে নবীন কর্মকর্তা হিসাবে চাকরির সময় হিং’য়ের কারণে আমি পরিচিত হয়ে উঠেছিলাম এবং এক হিং’য়ের ঘটনায় প্রথম ও শেষবারের ওয়ার্নিং লেটার পেয়েছিলাম!
সবেমাত্র বিদেশী কোম্পানিতে জয়েন করেছি মাস দেড়েক হলো। অফিসের ভিতরের খুবই নিরিবিলি একটা জায়গায় আমার বসার স্থান হয়েছিল। এতে আমি খুশি হলেও অন্যরা মুখ টিপে হাসতেন! কয়েক দিন পরই বুঝলাম ব্যাপারখানা! কোম্পানির কমার্শিয়াল ম্যানেজার, সবচেয়ে প্রবীণ ও সম্মানিত ব্যক্তির পাশেই আমার সিট। ধরতে গেলে প্রায় তিন মিনিট অন্তর সারাদিন তিনি উদরস্থ বায়ু (পাঁদ) ছুড়তেন! না, কোনো দুর্গন্ধ নেই, তবুও তো পাঁদ! কতক্ষণ ধৈর্য ধরে সহ্য করা যায়! প্রশ্ন করে জানতে পারি তিনি দীর্ঘদিন ধরে পেটে গ্যাসের কষ্টে আছেন। বহু ডাক্তার দেখিয়েছেন, কোনো ফল পাননি।
তখন তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, দৈনিক মসুর ডালের সমপরিমাণ হিং খেলে ১০ দিনে ভালো হয়ে যাবেন। তিনি আমার কথায় আশ্বস্ত হলেন এবং বাজার থেকে ফ্রেশ এক ছটাক (প্রায় ৮০ গ্রাম) হিং নিয়ে অফিসে ঢুকে, সঠিক পণ্য কিনা নিশ্চিত হতে, আমাকে দেখাতে চাইলেন। এই মুহূর্তে হিংয়ের প্যাকেট না খুলতে নিষেধ করার সময় পাইনি, তিনি তা খুলে ফেললেন।
সারা অফিসে এসি মেশিনের হাওয়া চলছিল, ফলে মুহূর্তেই হিং’য়ের তীব্র কড়া গন্ধ সারা অফিসে ছড়িয়ে পড়ে। কোম্পানির প্রধান কর্মকর্তা অস্ট্রেলিয়ান বস মনের আনন্দে কফির পেয়ালায় সকালের প্রথম চুমুটি মারতে যাবেন, তখনই তার নাকেও ঢুকে যায় এই বিতিকিচ্ছিরি গন্ধ। গন্ধটি একেবারে বিশ্রী গন্ধ নয়, কিন্তু তীব্রতার কারণে অসহ্য মনে হয়। তা ছাড়া, ধনী অফিসারের যথাযথ তদারকির কারণে দোকানদার তাকে একেবারে ফ্রেশ হিং দিয়েছিল।
যাই হোক, হিং এ ধরণের বিপত্তি ঘটাবে কল্পনা করতে পারিনি। সমুদয় এয়ার ফ্রেশনার মেরেও যখন হিংয়ের গন্ধ দূর করা যাচ্ছিল না। তখন বসের সকল গোস্বা গিয়ে পড়ে আমার উপর। তিনি কৌশলে কর্মার্শিয়াল অফিসারকে রেহাই দিয়ে, আমার নামে ইস্যু করলেন ‘Last and first warning letter’ এবং বাকি কর্মকর্তাদের লক্ষ্য করে ইস্যু করলেন অফিসিয়াল মেমো। যাতে করে ভবিষ্যতে কেউ ‘হিং’ অথবা হিংয়ের মতো পরিবেশ বিপর্যয়কারী কোনো কিছু অফিসে না আনে। অন্যতায় কোম্পানি চাকরি বাতিল করতে বাধ্য হবে। মূলত এটি পরোক্ষভাবে কমার্শিয়াল অফিসারকে লক্ষ্য করে লিখা। ব্যাপারটি এতটুকুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলত।
আমি কাজ করি হেড অফিসে। কিন্তু এই কোম্পানির আরো শাখা অফিস আছে। ইস্যুকৃত এই মেমো সকল অফিসে চলে যায়। আগা-মাথাহীন এ ধরণের মেমোর লক্ষ্য কী, তা জানতে ব্রাঞ্চ অফিস থেকে ফোন আসতে থাকে এবং ওই সব ফোন কলের উত্তর আমাকে দিতে বাধ্য করা হয়। অফিসারদের শাস্তি দেবার এটা এক ধরনের যুতসই ব্যবস্থা। ফোনের মাধ্যমে সবাই হিং সম্পর্কে জানতে গিয়ে, স্বচক্ষে হিং কেমন তা দেখার জন্য উল্টা তাদের কৌতূহল বেড়ে গেল। আর আমিও নতুন যোগ দেয়া ব্যক্তি হিসেবে সবার কাছে পরিচিত ও সমাদৃত হয়ে গেলাম।
পাঠক, হিংয়ের ওষুধি গুণের সাথে আমার পরিচয় কিভাবে হলো সে কথা বলা হয়নি। আমার দাদি স্বপ্নের মাধ্যমে একটি ওষুধ পেয়েছিলেন। ১৮টি ওষুধি গাছের সমন্বয়ে বড়ি বানানো হতো। গর্ভবতী মায়েদের শিশু যাতে সুস্থ থাকে এবং বিনা অপারেশনে প্রসব হয়, সে লক্ষ্যে এই বড়ি গর্ভের শুরুতে খাওয়া শুরু করে বাচ্চাকে দুধ ছাড়ানো পর্যন্ত মায়েরা খেত।
এই বড়ির প্রসিদ্ধি দূর দূরান্তে ছড়িয়েছিল। বিগত ৮০ বছর ধরে এই বড়ি এখনো মানুষের কাছে সমাদৃত। শাশুড়ি তার পুত্রবধূদের এটা শিখিয়ে যান, সে হিসেবে আমার মা দেখতেন, এখন আমার মেঝ ভাই এই কঠিন কাজটি আঞ্জাম দিয়ে থাকে। আমি যখন গ্রামে ফিরে যাব, তখন না হয় আমিই সে কাজের সেবা করে যাবো!
যাই হোক সেই স্বপ্ন প্রাপ্ত বড়ির একটি উপাদান হলো এই ‘হিং’। পেটের ব্যথা ও বায়ু নাশ করতে ডাল পরিমাণ হিং খেয়ে নিলেই কর্ম সাবাড় হতো। এসব দুর্লভ ওষুধি গাছের সবগুলো বাংলাদেশে জন্মে না। আমি এসব যোগাড় করে দিতাম এবং কিছু গাছ স্ব-উদ্যোগে নিজেদের খামারে রোপণ করেছিলাম। ফলে মানুষ চুরি করা শুরু করল। এতে করে খামারের অন্যান্য জিনিসও চুরির আওতায় চলে গেল। অধিক কৌতূহলী চোর ঈদ-কোরবানির ছুটিতে গাছের গোরার মাটিসহ চুরি করে সব নষ্ট করে দিত।
যাই হোক, হিংয়ের পরিচিতই বলা হলো না। হিং’য়ের ইংরেজি নাম Asafoetida. এটি মসল্লা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। পেঁয়াজ, রসুন ও আদার সম্মিলিত কাজ এই একটি মসল্লায় করে থাকে। এই মসল্লার ক্ষমতা বোঝার জন্য যদি উপমা দেয়া হয় তাহলে বলা যাবে, ১০০ গ্রাম সমতুল্যের হিং দিয়ে একটি হাতি রান্না করা যাবে! ভারতের নিরামিষি হিন্দু ও জৈন’রা পেঁয়াজ রসুন খায় না। তারা বিকল্প হিসেবে এই হিং থেকে তৈরী করা একটি হলুদ বর্ণের একটি গুড়ো মসল্লা হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। ভারতের দাক্ষিণাত্যের চানাচুর বানাতে এই মসল্লা ব্যবহার করা হয়। এটা স্বাদে গন্ধে এত দারুণ, একবার যে খায় সে আর বাংলাদেশী মুড়মুড়ে চানাচুর পছন্দ করবে না। চানাচুরের মতো মুড়মুড়ে ঝাল খাবারের জন্য হিং হলো উৎকৃষ্ট মসল্লা। বর্তমানে ভারতের সর্বত্র রান্নায় হিংয়ের ব্যবহার প্রসিদ্ধি পেয়েছে।
হিং আফগানিস্তানের পাহাড়ে ও ইরানের মরুভূমিতে জন্মে থাকে। তারা এটাকে ‘বদিয়ান’ নামে ডাকে। বদিয়ানের অর্থ হলো গ্যাস। অর্থাৎ এটা পাকস্থলীর গ্যাস দূর করে। গাছটি দেখতে খুবই সুন্দর। ফুলগুলো দূর থেকে নজরে আসে। মা গাছ মাটির সাথে লেগে থাকে কিন্তু ফুল ফুটে অনেকটা উপরে উঠে। ঠিক বাঁধাকপি প্রজাতির মোঁ। মূলত গাছের এই অভ্যাস মরুভূমির গাছের ক্ষেত্রে দেখা যায়। এই গাছের কষ বের হয়ে জমাট হয়ে থাকে। এই গাছের কষের প্রতি কোোঁ আগ্রহ কীট পতঙ্গের নেই। রোদে শুকিয়ে গোবরের মোঁ আকার ধারণ করে। তাই এটিকে ‘শয়তানের গোবর’ বলে। এই গাছের কোনো শত্রু নেই, কেউ এর রস খেতে আগ্রহ দেখায় না, তাই এটিকে ‘শয়তানের খাদ্য’ও বলা হয়। মানুষ যখন এই গাছের রহস্য উদ্ধার করতে পারল তখন থেকে এটি একটি মূল্যবান ভেষজ হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে।
হিংয়ের ওষুধি গুণের তুলনা করা যায় না। শ্বাসকষ্ট, গলার সমস্যা, বদহজম, গ্যাস, মহিলাদের অনিয়মিত ঋতুর সমস্যা দূর ও শরীরের দুর্গন্ধ দূর করতে হিংয়ের ব্যবহার প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে। হিং রক্তের কোলেষ্টেরলের মাত্রা কমিয়ে দেয়। রক্তকে পাতলা করে। কোনো মহিলার শিশুর পেটে বদহজম হলে, আমার দাদির ওই ট্যাবলেট শিশুর মাকে খেতে দিত। শিশু মায়ের দুধ খেলে তার গুণ দুধের মাধ্যমে শিশুর পেটে যেত। এতে করে শিশুর পেটের সমস্যা চলে যেত। দীর্ঘ-বছর পরে আমি উদ্ধার করেছিলাম ওই বড়িতে যে হিং থাকত সেটার কল্যাণেই এই উপকার পেত। খাদ্যে হিং থাকলে কুকুর, বিড়াল ওটা খায় না। আচারে হিং থাকলে পোকার সংক্রমণ থেকে বেঁচে যায়। মূলত এখানে একটি গাছের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে।
এভাবে আল্লাহর প্রতিটি সৃষ্টিই বহুবিধ মানব কল্যাণে নিয়োজিত রয়েছে।