কাহলিল জিবরান : জানা-অজানায়
কাহলিল জিবরান : ৬ জানুয়ারি ১৮৮৩-১০ এপ্রিল ১৯৩১ - ছবি : সংগৃহীত
কোনো এক দ্বীপদেশের এক অগ্রগামী অগ্রদূত দেশ ছেড়ে অনেক দূরে প্রবাসে থাকেন - স্বপ্ননগরী ‘ওরফালেস’-এ। অগ্রদূত এক মহাপুরুষ। তিনি তার প্রভূর প্রিয়পাত্র এবং সঠিক সত্যপথের অনুসারী। তার নাম আল্-মুস্তাফা। আল্-মুস্তাফা, ওরফালেসে এসে যখন সত্য প্রচার শুরু করেন তখন যে ব্যক্তি প্রথম তার কথায় আস্থা রেখে তার ভক্তঅনুসারী হন, তিনি একজন নারী। তার নাম আল্-মিত্রা। প্রবাসজীবনে আল্-মুস্তাফা, ওরফালেস মহানগরে সাধারণ মানুষদের সাথে অতি সাধারণ জীবনযাপন করেন। তাদের সুখ-দুঃখ নিজের সাথে ভাগাভাগি করে নেন, সময় সময় তাদের বুদ্ধি-পরামর্শ দেন এবং এভাবে অল্প দিনেই তিনি অসংখ্য গণমানুষের হৃদয়ে নিজের স্থান চিরস্থায়ী করে নেন।
ওরফালেসে বারো বছর বসবাসের পর স্বদেশে ফিরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে আল্-মুস্তাফা যেদিন জাহাজে উঠতে যাবেন, সেদিন তার অনুসারী লক্ষ লক্ষ নগরবাসী তাকে বিদায় জানাতে দলে দলে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। সকাল থেকে দুপুর গড়িয়ে বিকেল পর্যন্ত সাগরপাড়ের ধর্মশালার সামনে জনমানুষের জমায়েত রূপ নেয় এক জনসমুদ্রে। বিদায়বেলায় প্রাণপুরুষকে কাছে পেয়ে নগরবাসী একে একে উত্থাপন করে রহস্যময় জীবন-জিজ্ঞাসার নানা প্রসঙ্গ। আর তিনি উদাহরণ ও গল্পের ছলে তাদেরকে বোঝান অর্থপূর্ণ মানবজীবনের বিভিন্ন দিক। প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে আলোচনায় ওঠে আসে ভালোবাসা ও ঘরসংসারের কথা। ব্যবসাবাণিজ্য, কাজকর্ম, ছেলেমেয়ে, খাওয়াপরার কথা। সমাজ, ন্যায়-অন্যায়, আইনকানুন, বিচারসালিশের কথা। সৌন্দর্য, আনন্দ, জীবন-মৃত্যু, ধর্ম ও প্রভূর কথা। আলোচনা শেষে আল্-মুস্তাফা ধীরে ধীরে গিয়ে জাহাজে ওঠেন। জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে অপেক্ষমান জনতার মুখোমুখি হয়ে তাদের উদ্দেশ্যে উঁচুস্বরে তিনি তার বিদায়বেলার শেষ বয়ান রাখছেন। জাহাজ আস্তে আস্তে সমুদ্রতীর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আল্-মুস্তাফার কণ্ঠস্বর বাতাসে ভেসে আসছে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণ হয়ে। ততক্ষণে অরফালেসবাসী যার যার বাড়িঘরে ফিরে গেছে। আল্-মিত্রা একা দাঁড়িয়ে আছেন সাগরপারে। তিনি পলকহীন চোখে তাকিয়ে থাকেন সীমাহীন জলরাশির দিকে। তারই অশ্রুবাষ্পে আবছা হয়ে যাওয়া জাহাজ ধীরে ধীরে দৃষ্টিসীমার বাইরে গিয়ে দিগন্তরেখার সাথে মিলিয়ে যায়! আল্-মিত্রা ভাবতে থাকেন, আল্-মুস্তাফার কথা - ‘কে তিনি? কেন এলেন? কেন ফিরে গেলেন? আর কোথায়ই-বা তার দেশ?’
এ কাহিনি বর্ণিত আছে, বিখ্যাত ‘দি প্রফেট’ গ্রন্থে। এতে আছে ২৬টি কাব্যিক প্রবন্ধ। বইটির প্রথম প্রকাশ ১৯২৩ সালে, কিন্তু এটা প্রথমবারের মতো আমেরিকার কলেজ ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে অনেক পরে, ১৯৬০-এর দশকে। তারপর দুনিয়াব্যাপী বইটির চাহিদা এতই বেড়ে যায় যে আজ অবধি পৃথিবীর ৪০টি ভাষায় এটি অনূদিত হয়েছে। বইটি কখনোই ‘আউট অফ প্রিন্ট’ হয়নি। এই বইয়ের লেখক একজন প্রতিভাবান ক্ষণজন্মা পুরুষ। তিনি জন্ম নিয়েছিলেন মানব সভ্যতাকে তার জ্ঞানভাণ্ডার থেকে সবকিছু উজাড় করে দিয়ে যেতে এবং দিয়েও গেছেন। প্রতিদানে তিনি কিছুই চাননি, পাননি, নেনওনি। উপরন্তু তার অফুরন্ত সেই ভাণ্ডার শেষ হওয়ার আগেই সবাইকে ফাঁকি দিয়ে তিনি চলে গেলেন লোকচক্ষুর অন্তরালে! তিনি আর কেউ নন- চিন্তাবিদ, দার্শনিক, চিত্রশিল্পী ও কবি কাহলিল জিবরান।
অনেক ভেবেচিন্তেও আমি জিবরানের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত বই ‘দি প্রফেট’-এর একটি রহস্যের কোনো হদিস পাইনি। রহস্যটি হলো– জিবরান জন্মেছিলেন এবং বড় হয়েছিলেন আরবভাষী দেশ লেবাননে রক্ষণশীল খ্রিষ্টান পরিবেশে। ছোটবেলায় খ্রিষ্টধর্মে শিক্ষা নিয়েছেন পাদ্রীর কাছে। ‘মুস্তাফা’ ইসলামের শেষ নবী হজরত মুহাম্মদ স.-এর আরেক নাম। এটা কোনো অবস্থাতেই তার না জানার কথা নয়। তারপরও, একজন খ্রিষ্টান হয়ে, তিনি তার ‘দি প্রফেট’ গ্রন্থের মূল চরিত্রের নাম কেন ‘আল্-মুস্তাফা’ দিলেন, এ প্রশ্নের উত্তর আমি এখনো খুঁজছি। আমার সাম্প্রতিক বৈরুত সফরে এ বিষয়ে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল আমার এক লেবানিজ অধ্যাপক-বন্ধুর সাথে। তিনি বললেন, ‘বিবদমান খ্রিষ্টান ও মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ার তাগিদে জিবরান সচেতনভাবেই এ কাজটি করে গেছেন’।
আমার বন্ধু মাহবুব চৌধুরীর মতে, এ ব্যাখ্যা যথেষ্ট নয়। সে মনে করে, এ রহস্যের জট খুলতে গেলে আগে জানতে হবে জিবরানের ‘প্রফেট’ আসলে কে? জিবরানের ‘প্রফেট’ আর কেউ নন, তিনি নিজেই। তার কাব্যপ্রবন্ধের বই ‘দি প্রফেট’-এর মূল চরিত্র আল্-মুস্তাফার মুখ দিয়ে জিবরান প্রকৃতপক্ষে তার নিজের কথাগুলোই বলে গেছেন। জিবরান-গবেষকদের মধ্যে এ রকমের একটা ধারণা চালু আছে যে জিবরান নিজেকে একজন ‘প্রফেট’ মনে করতেন, যদিও এ-কথা তিনি কখনো মুখ ফুটে বলেননি। তার কারণ কী সেটা জানা যায় না, তবে তার চিন্তাভাবনার ব্যাপ্তি ও গভীরতা, তার জীবনবোধ ও জীবনধারণের নমুনা দেখলে তেমনটাই মনে হয়।
রক্ষণশীল খ্রিষ্টান পরিবারে জন্ম নিয়ে এবং খ্রিষ্টান পরিবেশে বড় হয়ে, নিজেকে ‘প্রফেট’ মনে করে জিবরান যেসব কথা বলেছেন তা নিঃসন্দেহে খ্রিষ্টধর্মের চৌহদ্দি পেরিয়ে গেছে। কারণ তার সৃষ্ট শ্রেষ্ঠ চরিত্র আল্-মুস্তাফা যিশু খ্রিষ্টের মতো শুধু ‘প্রেম-ভালোবাসা’র কথা বলেননি, ‘এক গালে চড় খেলে আরেক গাল পেতে দিতে’ও বলেননি। আল্-মুস্তাফা কঠিন-কঠোর বাস্তব জীবনের খুব কাছাকাছি ছিলেন। মানুষের প্রাত্যহিক জীবনসংগ্রামের সকল শাখা-প্রশাখায় তার বিচরণ ছিল সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ। তিনি মানুষের আধ্যাত্মিক ও বৈষয়িক জীবনের সকল সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা সমান গুরুত্ব দিয়ে অনুভব করেছেন এবং প্রচার করেছেন।
এখন প্রশ্ন হলো, মানব জীবনকে সার্বিকভাবে জানা, বোঝা, উপলব্ধি করা এবং সাহস ও আত্মপ্রত্যয়ের সাথে প্রচার করার এ অফুরন্ত শক্তি জিবরান কোথায় পেলেন? এ প্রসঙ্গে সহজেই এ কথা বলা যায় যে, তিনি এই ধারণা খ্রিষ্টীয় ইতিহাস কিংবা ঐতিহ্য থেকে পাননি। এটা হয়তো বা প্রকৃতি-প্রদত্তভাবে একান্তই তার নিজস্ব শক্তি, যা তিনি নিজেই ধারণ ও লালন করেছেন।
অথবা হতে পারে, তিনি মানবজীবনের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে জীবনকে সার্বিকভাবে দেখার দীক্ষা পেয়েছেন কোরআন পড়ে। আর তাই তো তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠতম সাহিত্যকীর্তি- ‘দি প্রফেট’-এর মূল চরিত্রের নাম ‘আল্-মুস্তাফা’ রেখে এ সত্যতারই একটা সরল স্বীকারোক্তি দিয়ে গেছেন। শুধু ইসলামই নয়, কিতাবপ্রাপ্ত অন্য দুই ধর্ম - যেমন ইহুদি ও খ্রিষ্ট ধর্মের প্রতিও জিবরানের গভীর অনুরাগ ছিল। এই তিনটি ধর্ম নিয়ে তিনি প্রচুর পড়াশোনা ও গভীর চিন্তাভাবনা করেছেন। তার লেখালেখি ও দর্শনে এর সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। এ ছাড়াও ইসলামের তাসাউফ শাস্ত্রের প্রতি তার আগ্রহ ও আকর্ষণ ছিল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
কাহলিল জিবরান ১৮৮৩ সালের ৬ জানুয়ারি বর্তমান লেবাননে অবস্থিত বির্শারি নামক পাহাড়ি পল্লীতে এক মেরোনাইট খ্রিষ্টান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ছিল খলিল জিবরান। তিনি নিজের নামেই ছেলের নাম রেখেছিলেন- খলিল জিবরান, সে নাম কী করে ‘কাহলিল জিবরান’ হলো সে কথায় আবার ফিরে আসব পরে। জিবরানের মায়ের নাম ছিল কামিলা রাহমাহ। কামিলার বাবা ছিলেন একজন পাদ্রি। জিবরান তার মা-বাবার তৃতীয় সন্তান। জিবরানের বাবা ছিলেন তার মায়ের তৃতীয় স্বামী। মূলত অভাব-অনটনের কারণে ছোটবেলায় জিবরানের স্কুলে যাওয়া হয়নি। একা একা তিনি পাহাড়ে-জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য গভীরভাবে অবলোকন ও উপভোগ করতেন! পরবর্তীকালে তার লেখায় এবং ছবি আঁকায়, পাহাড়, পর্বত ও প্রকৃতির প্রভাব স্পষ্ট লক্ষ করা যায়। জিবরানের মা কামিলা খ্রিষ্টান পরিবারে বেড়ে ওঠেন। তাই তাঁদের বাড়িতে ধর্মশিক্ষাদানের জন্য ঘন ঘন একজন পাদ্রির আনাগোনা ছিল। ঐ পাদ্রির কাছে ভাসা ভাসাভাবে জিবরান বাইবেলের সাথে ইতিহাস, বিজ্ঞান ও আরবি ভাষা শেখেন। দুষ্টু জিবরান দশ বছর বয়সে খাড়া পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে নিজ ঘাড়ের বাঁ দিকে মারাত্মক জখম করে ফেলেন। সময়তো সঠিক চিকিৎসার অভাবে আমৃত্যু তার ঘাড়ের বাম দিক স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসেনি।
জিবরানের বাবা প্রথম দিকে এক ওষুধ কারখানায় কাজ করতেন। তার জীবন ছিল খুবই ছন্নছাড়া ও অগোছালো। তিনি জুয়া খেলায় আসক্ত ছিলেন, যে কারণে সব সময় থাকতেন ঋণগ্রস্ত। পরে তিনি এক অ্যাটোমান আঞ্চলিক সরকারি কর্মকর্তার অধীনে কাজ নিয়েছিলেন। লেবানন তখন ছিল সিরিয়ার অঙ্গীভূত; আর সিরিয়া ছিল অ্যাটোমান সাম্রাজ্যের অংশ। জিবরানের জন্মের সময় তার মায়ের বয়স ছিল ৩০। জিবরানের বয়স যখন মাত্র আট, তখন কর ফাঁকির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে তার বাবাকে জেলে যেতে হয়েছিল। ওই মামলায় তার সমস্ত সম্পত্তি সরকার বাজেয়াপ্ত করে। ফলে কামিলা জিবরান, জিবরানের সৎভাই পিটার এবং দুই বোন মারিয়ানা ও সুলতানাকে নিয়ে গৃহহীন হয়ে পড়েন। কামিলা ঘুরেফিরে আত্মীয়স্বজনদের বাড়িতে থাকতে শুরু করেন। তখন জিবরানের এক মামা থাকতেন আমেরিকায়। ভাইয়ের পথ অনুসরণ করে ভাগ্য বদলের আশায় অনেক সাহস করে, কামিলা ১৮৯৫ সালের ২৫ জুন ছেলেমেয়েদের নিয়ে জাহাজযোগে বৈরুত থেকে আমেরিকার নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন। তার কিছুদিন আগে জিবরানের বাবা জেল থেকে ছাড়া পান বটে, কিন্তু সিদ্ধান্তহীনতার কারণে তিনি পরিবারের সাথে আমেরিকা না এসে লেবাননেই থেকে যান।
জিবরানের মা আমেরিকাতে এসে ম্যাসাচুসেট্স অঙ্গরাজ্যের ঐতিহাসিক বোস্টন শহরের দক্ষিণ প্রান্তে বসতি স্থাপন করেন। ওই সময় দক্ষিণ-বোস্টনে জিবরানের মামা-সহ আরবিভাষী অনেক সিরিয়ান ও লেবানিজ লোক থাকত। অন্যান্য সিরিয়ান মহিলাদের সাথে জিবরানের মা এক পোশাক তৈরির কারখানায় সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে লেইস ও লিনেন দ্রব্যাদি বিক্রি করতে থাকেন। আমেরিকা আসার দু’মাস পর ১৮৯৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ‘খলিল জিবরান’ গিয়ে স্কুলে ভর্তি হলেন। সে সময় ভুলবশত স্কুলের রেজিস্ট্রি বইয়ে তার নাম Khalil Jibran-এর বদলে Kahlil Jibran লেখা হলো। এভাবে তার বাবার দেয়া আসল নাম বিকৃত হয়ে গেল এবং জিবরানও পরে আর ওই নাম শুধরাবার কোনো তাগিদ অনুভব করেননি।
যেহেতু তার প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার কোনো রেকর্ড ছিল না, তাই অন্য সব অভিবাসী ছেলেমেয়েদের সাথে ইংরেজি শেখার জন্য তাকে একটি বিশেষ ক্লাসে ভর্তি করা হলো। ছোটবেলা থেকেই জিবরান নিখুঁত ছবি আঁকতে পারতেন। তার এই বিরল প্রতিভা অচিরেই শিক্ষকদের নজর কাড়ে। স্কুলের শিক্ষকদের সহায়তায় জিবরানের যোগাযোগ হয় তখনকার সময়ে বোস্টনের একজন বিখ্যাত ফটোগ্রাফার ‘ফ্রেড হল্যান্ড ডে’-র সাথে। ফ্রেড ডে জিবরানকে এতই পছন্দ করে ফেলেন যে, তিনি সাথে সাথে জিবরানের মেন্টরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ফ্রেড ডে, জিবরানকে বলতেন ‘ন্যাচার্যাল জিনিয়াস’। ফ্রেড ডে-র উৎসাহে এবং আনুকূল্যে জিবরান বইয়ের কাভার ডিজাইন, স্টোরি ইলাস্ট্রেশন এবং পোট্রেট আঁকার কাজ পেতে থাকলেন। এভাবে ছবিআঁকা ও চিত্রশিল্পের মহাজগতের সিংহদ্বার জিবরানের জন্য অতি সহজেই খুলে গেল!
জিবরানের সৃষ্টিশীল বোস্টনজীবনের শুরুতেই হঠাৎ একটা ছেদ পড়ে যায়। কী মনে করে বিশুদ্ধ আরবি শেখার জন্য তিনি ১৮৯৮ সালে ১৫ বছর বয়সে লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ফিরে গিয়ে ভর্তি হন ‘মাদ্রাসাতুল হিক্মায়’। সেখানে আরো কয়েকজন বন্ধুর সহযোগিতায় আরবি ভাষায় একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতে শুরু করেন। চার বছর পর আবার বোস্টনে ফিরে আসেন ১৯০২ সালের ১০ই মে। তার দু’সপ্তাহ আগে, তাঁর বোন সুলতানা ১৪ বছর বয়সে যক্ষ্মা রোগে মারা যান। পরের বছর তাঁর ভাই পিটারও মারা যান একই রোগে। একই বছর জিবরানের মাও মারা যান ক্যান্সারে। (লক্ষ করার বিষয়, এখানে আরবি কবি জিবরানের জীবনের সঙ্গে বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথের এক ধরনের একটা অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায়।) তারপর তার বোন মারিয়ানা সেলাইয়ের কাজ করে তাদের দু’জনের সংসার চালাতেন। বৈরুত থেকে ফিরে এসে জিবরান, ফ্রেড ডে-র সাথে পুরো উদ্যমে পেইন্টিংয়ের কাজ আবার শুরু করেন। ১৯০৪ সালে তার প্রথম চিত্রপ্রদর্শনী (of charcoal drawings) হয় বোস্টনে, ফ্রেড ডে-র স্টুডিওতে। এরপরই চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে চিত্রশিল্পী হিসেবে জিবরানের নামডাক।
এই প্রদর্শনীতে জিবরানের সাথে প্রথম সাক্ষাত ও পরিচয় হয় ‘মেরি এলিজাবেথ হ্যাস্কেল’-এর। মেরি হ্যাস্কেল ছিলেন স্থানীয় একটি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা। মেরির সাথে অচিরেই গড়ে ওঠে জিবরানের বন্ধুত্ব। মেরির আগ্রহে একসময় এই সম্পর্ক বন্ধুত্ব থেকে প্রেমে গড়ায়, তবে প্রেম ছিল অনেকটা একতরফা। মেরি বিভিন্ন সময়ে জিবরানকে বিয়ে করতে চেয়েছেন, কিন্তু বার বার জিবরান তাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন এই বলে, ‘আমি বিবাহযোগ্য নই’। তথাপি, মেরি হ্যাস্কেল নিজের টাকায় জিবরানকে দু’বছরের জন্য প্যারিস পাঠিয়েছিলেন বিশ্ববিখ্যাত ফরাসি ভাস্কর ও চিত্রশিল্পী, অগস্ত রোদ্যাঁ-র (১৮৪০-১৯১৭) সাথে থেকে আর্ট শেখার জন্য। জিবরানের শিল্পীজীবন ও তার সফলতার ওপর মেরি হ্যাস্কেলের অবদান ও প্রভাব খুবই বেশি। জিবরানের প্রতি মেরির প্রেম পরিণতি না পেলেও তাদের মধ্যকার গভীর বন্ধুত্ব নিখুঁতভাবেই বহাল ছিল জিবরানের মৃত্যু পর্যন্ত। সম্পর্কটি কেমন ছিল? পড়ে দেখুন, জিবরান নিজে কী বলছেন :
'When I am unhappy, dear Mary, I read your letters. When the mist overwhelms the “I” in me, I take two or three letters out of the little box and reread them. They remind me of my true self. They make me overlook all that is not high and beautiful in life. Each and every one of us, dear Mary, must have a resting place somewhere. The resting place of my soul is a beautiful grove where my knowledge of you live.'
জিবরানের প্রথম দিককার লেখা সবই আরবিতে। ইংরেজিতে তাঁর প্রথম বই ‘দি ম্যাড ম্যান’ বের হয় ১৯১৮ সালে। ১৯২০ সালে তিনি নিউ ইয়র্কে ‘সোসাইটি ফর এরাব রাইটারস’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে প্রথম বের হয় তার বিখ্যাত গ্রন্থ, ‘দি প্রফেট’। জিবরানের অন্যান্য বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো – ‘স্যান্ড অ্যান্ড ফোম’, ‘জিসাস, দি সান অফ ম্যান’, ইত্যাদি।
১৯১২ সাল থেকে জিবরান বোস্টন ছেড়ে নিউ ইয়র্ক শহরে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। ১৯৩১-এর ১০ই এপ্রিল লিভার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৪৮ বছর বয়সে নিউ ইয়র্কেই তাঁর জীবনাবসান ঘটে। জিবরানের শেষ ইচ্ছানুযায়ী তার লাশ লেবাননের বির্শারি-র নিভৃত পল্লীতে নিয়ে সমাহিত করা হয়। জিবরানের কথামতো, তার এপিটাফে লেখা আছে, 'A word I want to see written on my grave: I am alive like you, and I am standing beside you. Close your eyes and look around, you will see me in front of you.'
লেখক : আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক - টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি;
এডিটর : দি জার্নাল অফ ডেভোলাপিং এরিয়াজ
Email: wahid2569@gmail.com
পুনশ্চ :
এখানে আরেকটি ব্যাপার আপনাদেরকে না বলে পারছি না। এটা সরাসরি জিবরানের জীবন কিংবা জীবনীর সাথে সম্পর্কিত নয়, আবার এ লেখার জন্য একেবারে অপ্রাসঙ্গিক বলেও মনে করি না। লেখাটা শেষ করে আনার পর আমার ইংল্যান্ড প্রবাসী বন্ধু মাহবুব (শেফিল্ড শহরে থাকে) বলল, সে এক দিন শেফিল্ড সেন্ট্র্যাল পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে কাহ্লিল জিবরানের ‘দি প্রফেট’ বইটি খুঁজে পেয়েছে ওই শেল্ফে যেখানে রাখা হয় হজরত মুহাম্মদ স:-এর জীবনীগ্রন্থ। তারপর সে লাইব্রেরির কর্মচারিদের অগোচরে নিজেই কয়েকবার ‘দি প্রফেট’ অন্য শেল্ফে রেখে দেয়, এবং প্রতিবারই সে দেখতে পায় কিছু দিন পর বইখানা যথারীতি আবার জায়গা করে নেয় রসুলুল্লাহ স: জীবনীর পাশে; যদিও ইসলাম, ইসলামের ইতিহাস, হজরত মুহাম্মদ স: কিংবা তাঁর জীবনীর সাথে এর কোনোই যোগসূত্র নেই।
কৌতূহলবশত, আমিও আজ ন্যাসভিল পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখলাম, জিবরানের ‘দি প্রফেট’ শেল্ফে সাজনো হয়েছে অন্যভাবে। এখানে এটা রাখা হয়েছে জিবরানেরই অন্যান্য বই এবং আরো কিছু আরব লেখক - যেমন নাজিব মাহফুজ, আলা আল-আসওয়ানি, রাশেদ এল্-এনানি, হাফা জাঙ্গানা-র বইয়ের আশেপাশে। হজরত মুহাম্মদ স:-এর জীবনী, এর ধারেকাছেও নেই। মাহবুব ও আমার মতে, এটা হওয়াই স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত।
এখন আমাদের প্রশ্ন, শেফিল্ড পাবলিক লাইব্রেরি বইটিকে দর্শন, সাহিত্য, জিবরানের অন্য বই, অথবা সমসাময়িক অন্যান্য আরব লেখকদের বইএর সাথে না রেখে, রসুলুল্লাহ্ স:-এর জীবনীর সাথে কেন রাখে? এর কারণ যাই হোক না কেন, এখানে আমরা দুই বন্ধুর দৃষ্টিতে, শেফিল্ড লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষের একটি মহানুভবতা ও একটি বিশ্বাসের বিষয় ধরা পড়ে। প্রথমত, মহনুভবতা বলছি এজন্য যে, তাঁরা হজরত মুহাম্মদ স:-কে একজন প্রফেট-এর মর্যাদা দিয়েছেন বলেই জিবরানের ‘দি প্রফেট’-কে এভাবেই শেল্ফে রাখেন। দ্বিতীয়ত, জিসাস আ:-কে আমাদের মতো প্রফেট না মনে করে তারা ‘গড’ ভাবেন বলেই তার ওপর লেখা বইয়ের ধারেকাছে জিবরানের ‘দি প্রফেট’-এর জায়গা হয়নি। এটা নিতান্তই তাদের বিশ্বাসের বিষয়।