নিকারি মানেই কি মুসলমান
মাছ ধরছে কয়েকজন জেলে - ছবি : সংগৃহীত
কেরী সাহেব বলছেন, নিকিরি হচ্ছে মুসলমানদের মধ্যে যারা মাছ বেচে খায়। জ্ঞানেন্দ্রমোহন বলছেন- মুসলমান মৎস্য-ব্যবসায়ী; কাবারি। হরিচরণ বলছেন- মৎস্যবিক্রেতা জাতিবিশেষ; মুসলমান বলেননি। ওদুদ বলছেন- মুসলমান মৎস্য-ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। আশুতোষ বলছেন- মৎস্যজীবী মুসলমান সম্প্রদায়। আঞ্চলিক বলছে- নিক্রে মানে মুসলমান জেলে। ছোটখাট বাকি সব অভিধান এদেরকেই টুকে বলছে মুসলমান জেলে।
তাহলে কী দাঁড়াল? নিকারি মানে কি মাছের ব্যবসায়ী, না মাছবিক্রেতা, না জেলে? আর নিকারি মানেই কি মুসলমান?
মুকুন্দরামে আছে- ধরিয়ে সাধুর ডিঙি লোনের নিকারি চিঙ্গি দিয়ে কেড়ে লয় সব ধন। সাধু মানে সাউ, লোনের মানে লবণের, চিঙ্গি মানে লাফ। তার মানে নুনেরও নিকারি হতো।
জ্ঞানেন্দ্রমোহন নিকারি এন্ট্রিতে বলছেন- মুসলমান মৎস্য-ব্যবসায়ী; কাবারি। আর কাবারি এন্ট্রিতে লিখছেন- মৎস্যবিক্রেতা জাতিবিঃ; নিকারি। ২. যারা ফলের বাগান জমা লইয়া ফল বিক্রয় করিয়া জীবিকানির্বাহ করে।
গাঙ্গেয় বাংলায় নিকিরি বলতে জ্ঞানেন্দ্রমোহনের এই ২ নম্বর মানেটাই চলে। বিশেষ করে সেইসব ব্যবসায়ী যারা কারো আমবাগান লিজ নেয়, পুরো বাগানের সে বছরের আমের থোক দাম ধরে দিয়ে। যেমন এখনো নদীয়ার তেহট্টে যারা ফলের বাগান কিনে ব্যবসা করে, তাদেরকে নিকারি বলে। এরা মুসলমান এবং সমাজে অন্ত্যবাসী।
তাহলে নিকারি কিসের ব্যাপারী– মাছ, না নুন, না আম? আসলে কোনো একটার না, সবকিছুরই। কারণ নিকারির শেষ মানে দাঁড়িয়েছিল পাইকার, হোলসেলার। আর নিকারির প্রাথমিক মানে ছিল কসাই। সেটা কী করে তা বুঝতে হলে অনেক গভীরে যেতে হবে। তাতে করে নিকারি বলতেই কেন কাবারি কথাটা চলে আসছে তাও বোঝা যাবে। কাবারী, নিকারী, কেওট, কৈবর্ত নিয়ে একটা লম্বা ইতিহাস পড়তে হবে।
কেওট, কৈবর্ত
ঋগ্বেদে জেলেদের বলতো কেৱট। নিরুক্ত মতে যারাই জলে যায় তারাই কেওট। এই কারণেই যে সাপ জলের ধারে থাকে আর মাছ খায় সে কেউটে, কেউটিয়া। কেওট, কেৱট সংস্কৃত করা হয়েছে কৈবর্ত। কে বর্ততে ইতি কৈবর্ত, ক- এর মানে জলে বাঁচে, তাই কৈবর্ত, কেৱট, কেওট। আর্যাবর্ত আসলে অসুরাবর্ত, যাদের সঙ্গে দ্রাবিড়রাও ছিল। মাছখেকো দ্রাবিড়রা ছিল কৈবর্ত। নৌকো নিয়ে মাছ ধরতে বহুদিন জলে কাটাতে হতো বলে আর্যরা ভাবত এরা জলেই থাকে।
কেওটরা মূলত দ্রাবিড়, নর্থের নৌকো এরাই চালাত। বেদে আর্যরা এ দেশের আদিবাসীদের ঘৃণা ছাড়া আর কিছু দেয়নি। সেই শিক্ষা থেকেই বাংলাতেও কৈবর্তরা অস্পৃশ্য। যে কৈবর্তদের ইতিহাস চার হাজার বছরেরও বেশি মানুষ তাদেরকে নীচ ইতর ছোটোলোক ভাবত।
এককালে বাঙালি সাউথ বলতেই কলিঙ্গ মানে ওড়িশা অন্ধ্রকে বুঝত। তাই বাংলায় কৈবর্তদের আগে কলিঙ্গী বলা হতো, কারণ এরা কলিঙ্গ থেকে এসেছে। যে কৈবর্তরা বিষহরি মনসা দেবীকে মানতো তারা আরো ডিপ সাউথের লোক। ব্রহ্মবৈবর্ত বলছে, কৈবর্তদের মধ্যে যারা কলিতে তিবর সংসর্গে আসে, তারা ধীবর হয়ে যায়। মৎস্যপুরাণে বলছে, ধীবররা কেলোকুলো রঙের হয় মাছ বেচে মাছ ধরে। সাউথে মাছকে বলে মীন। বাংলাদেশের কেওট, মীনারা সাউথের লোক। তামিল মালয়ালি লোকজন শুধু নৌকো নিয়েই কাঁহা কাঁহা মুল্লুকে যে গেছে, বাংলা তো তাদের কাছে বাড়ির চৌকাঠ। বুকানন বলছেন, বাংলার মল্লাহ মাল্লো মালোরা দ্রাবিড়, পশ্চিম থেকে আসা দ্রাবিড়। বুকানন আরো বলছেন, বল্লাল সেনের আমলে বাংলার কেওটদের ভদ্রকথায় কৈবর্ত নাম দেয়া হয়। মানে সাউথের রাজা এলে তবে কেওটদের জাতে তোলা হলো। বাংলার কিছু কৈবর্ত জেলে থেকে হেলে হয়। বাংলা কালীক্ষেত্র কিন্তু সাউথের লোকেরা বৈশ্য এদের দেবতা বিষ্ণু। মালোরা বৈষ্ণব।
এখন হিন্দিঅলারা নিষাদ, কেৱট বলতেই বোঝে পারানির মাঝি। মল্লাহ, মাল্লা, মালো। কেৱট মাঝি রাম, সীতা, লক্ষণকে নদী পার করে দিয়েছিল, রামচন্দ্রের পা ধুইয়ে দিয়েছিল- এই একটাই গল্প কুমিরছানার মতো করে শোনানো হয়।
কাবাড়ি
কর্ৱ মানে পাহাড়। কর্ৱট মানে পাহাড়ের ঢাল। কর্ৱট থেকে কৱ্ৱণ্ড, কওওড়, কাৱাড়। জৈনদের সিদ্ধান্তকোষ আর পুরাণকোষ বলছে, কাৱাড় মানে পাহাড়ের ঢালে বসা হাট, পাহাড় ঘেরা মাণ্ডি। মহাপুরাণ বলছে, ২০০টা গ্রাম নিয়ে একটা কর্বট হতো। এই কর্ৱট মনে হয় মৌজার মতো।
যে লোক কাবাড়-মাণ্ডিতে জিনিস বেচে, সে কাৱাড়ী, মানে হাটুরে। পরে হাটফেরতা মাল পাড়ায় পাড়ায় বেচা লোকেদেরও লোকে বলত কাৱাড়ী, কাৱাড়ি, কাবাড়ি, কাবারী, কাবারি। এটা উত্তর ভারতের ব্যাপার।
যোগেশ রায় শব্দকল্পদ্রুম টেনে কাবাড়ী মানে বলছেন– ক্রয়, বিক্রয় দ্বারা গ্রামে বা গ্রামের হাটে যে জীবিকা নির্বাহ করে। বাচস্পত্যও তাই বলছে। যোগেশ রায় কাবাড়ী এন্ট্রিতে আরো বলছেন– অধুনা প্রায়ই শাকপাতা-বিক্রেতা মুসলমান। স্ত্রী. কাবাড়নী। জ্ঞানেন্দ্রমোহন বলেছেন, হাটে মৎস্যবিক্রয়কারী, পরে মৎস্যজীবী জাতি। মুসলমান বলছেন না।
অভয়া হচ্ছে ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের বনদেবী, পরে একে চণ্ডীর সঙ্গে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। মুকুন্দ চক্রবর্তী অভয়ামঙ্গলে মানে চণ্ডীমঙ্গলে মুসলমানের জাতি-বিভাগ দেখাতে লিখেছেন-
বলদে বাহিয়া নাম বলায় মুকেরি।
পীঠা বেচিয়া নাম ধরাল্যা পীঠারি॥
মৎস্য বেচিয়া নাম ধরাল্য কাবারি।
নিরন্তর মিথ্যা কহে নাহি রাখে দাড়ি॥
অভয়ামঙ্গলেই আছে- যেমন কাবাড়ি ফিরে বাড়ি বাড়ি চাহিয়া কামৌষধ। মানে সে যুগে কাবাড়িরা পাড়ায় পাড়ায় ভায়াগ্রা বেচত, বেদেদের জড়িবুটির ভায়াগ্রা। কত মুক্তমনের সমাজ ছিল! দুয়ারে ভায়াগ্রা!
একালের ভাষায় পাড়ার পাড়ায় গলিতে গলিতে যত রকম সবজিঅলা, ফলঅলা, মাছঅলা, শুকটিঅলা, হাঁড়ি-বাসন-প্লাস্টিকঅলা হেঁকে বেড়ায় সে যুগের ভাষায় তারা সবাই কাবাড়ি। আর এখন কলকাতায় কাবাড়ি মানে দাঁড়িয়েছে শুধু যারা পুরনো কাটকাটরা, লোহালক্কড়, টিউবলাইট, টিভি, হারমোনিয়াম, কম্পিউটার কিনতে আসে তারা।
কালকেতু
বনবাসী নিষাদরা ছিল ব্যাধ, পশুপাখি মেরে খেত। গরু, মোষ, শুওর, সাপ, গোসাপ, ইঁদুর, বাদুড়- সবই। বড় গরু মোষ শিকার হলে বা ভাগাড়ে পড়লে সেটা কেটে ছাড়িয়ে তার বাড়তি মাংস হাটে বেচত। এটা প্রায় পাঁচ হাজার বছর ধরে চলে আসছে। পাঁচ শ' বছর আগেও আমাদের মুকুন্দরাম এদের বারোমাস্যার নিখুঁত ছবি এঁকেছেন। তিনি তার অভয়ামঙ্গলের প্রথমাংশ আখেটিক খণ্ডে লিখেছেন নীলাম্বর ব্যাধের ছেলে কালকেতু আর তার বউ ফুল্লরার কথা। ব্যাধ কালকেতু বনে বনে পশু শিকার করে, আর বউ ফুল্লরা সেই পশুর মাংস হাটে বিক্রি করে। কালকেতু বন উজাড় করে পশুপাখি মেরে ফেলছিল বলে পশুদের অনুরোধে মা চণ্ডী স্বর্ণগোধিকা মানে গোসাপ হয়ে বনের পথে শুয়ে পড়ে। কালকেতু গোসাপটাকে ধনুকের ছিলায় বেঁধে ঘরে আনে। তারপর গোলাহাটে বাসি মাংস বেচতে যায়। মানে কালকেতু ফুল্লরা কত্তা-গিন্নি দুমানুষে কাবাড়ি কাবাড়নী।
নিকারি
নিকারণ মানে হত্যা কাটা জবাই। হটন বলেছেন, কিলিং স্লটার। যে নিকারণকারী সে নিকারী কসাই। যারা পশু, পাখি, মাছ, কুচ কাটে- তারা নিকারি। এই কাটার কসাই মানেতে নিকারি কথাটা আজও টিকে আছে ঢাকায়। ঢাকার মাছের বাজারে যারা বড় বটি নিয়ে বসে থাকে, পয়সা নিয়ে আপনার কেনা বড় মাছটা কুটে দিতে, ঢাকার লোকেরা সেই মাছের কসাইদের বলে নেকারি। সে হিন্দু হোক বা মুসলমান।
সে যুগে নিকারিরা মাছ, মাংস কেটে হাটে বেচতে যেত। তাই এরা কাবাড়ি। এই কারণে নিকারি বলতেই কাবাড়ি কথাটা চলে আসে। ব্যাধ কালকেতু একই অঙ্গে শিকারি নিকারি কাবারি। কালকেতুর বংশধররাই আদি নিকারী। বাংলায় এরা বাগদি, ডোম, হাড়ি, বাউড়ি নামে পরিচিত ছিল। বাগদি হচ্ছে মেছো নিকারি। হান্টার রিজ়লে দুজনেই বলে গেছেন মেছুড়ে আর নিকারিদের কত নিচু চোখে দেখা হতো। মানে মেছুড়ে আলাদা নিকারি আলাদা।
প্রাচীন যুগে লোকে শাক সবজি কিনে খেত না, শাক পাত পথের ধারে পেতো আর সবজি সব বাটীতে ফলাত। শুধু মাছ, মাংসটাই কিনে খেতে হতো। ছোট মাছ আনত জেলে-বউরা আর বড় মাছ ও মাংস আনত নিকারিরা। এখনও এ বাংলার কোনো কোনো মুসলমান গ্রামে গরুর কসাইরা সাইকেলে করে গোশত বেচতে আসে।
মুসলমান নিকারি
ছদ্মবেশী সিনেমার উত্তমকুমার পাঞ্জারী বাস-কন্ডাকটার দেখেননি। আমিও দেখিনি। তেমনি আমি এ বাংলায় একঘরও মুসলমান গয়লা দেখিনি। যদিও মুসলমানদেরকে গরু পালতে দেব না- এমন কথা এখনো কেউ বলেনি, এখন টিভিতে বলছে কিনা জানি না।
সাপ, গোসাপ কাটা নিকারিরা ব্যাধ আর মাছ কাটা কেওটা, নিকারিরা কলিঙ্গী, করালী, জেলে। তখন ভাবা হতো, এরা ছোট জাত, এদের কাজ ঘৃণ্য। তাই কোনো মুসলমান নিকারি হতো না।
কেরালার মোপলারা কেওটা, কিন্তু জাতে মুসলমান। এরা মাছে খায়, মাছ ধরে, মাছ কাটে, মাছ বেচে। সুদূর অতীতে মাছের খোঁজে এরা বাংলায় আসে, এসে বাংলার জোলে শোলে মাছের খিরখিট্টি দেখে মাছ কাটা, মাছ বেচার কাজে লেগে যায় এবং বাংলায় থেকে যায়। এরাই সেই নিকারি মুসলমান। এই কারণেই টাঙ্গাইলের লোকেরা মালয়ালী মোপলাদেরকে নিকারি বলে।
কিন্তু মুসলমানের নিকারি হওয়া খুব ছ্যা ছ্যা ব্যাপার। সেজন্য এই নিকারিদের সঙ্গে লোকাল মুসলমানরা মিশত না। মালাবারের মোপলারা মারকুটে ছিল। পর্তুগিজ হার্মাদদের এরাই ঠেঙিয়ে সোজা করে দিয়েছিল তাই অদূর অতীতেও বাংলার হার্মাদদের ঠ্যাঙাতে এদেরকে ডাকা হয়েছিল। এরাও বাংলায় থেকে যায়।
নিকারি মুসলমানরা মাছের হোলসেল বিজনেসটা ভালো ধরে। এরা নৌকোয় দক্ষ বলে মাছ আর শুকটির চালানির ব্যবসাটা এরাই শুরু করে। এতে লোকাল বাঙালির কোনো সাজাবাজা ছিল না। কিন্তু পাইকার নিকারিরা দ্রাবিড় কেওট আর এরাদাড়ি রাখে না ঝুড়ি ঝুরি মিথ্যে কথা বলে।তাই এদের সঙ্গে ওঠবোস চলত না।কিন্তু বড়লোক বিজনেসম্যান বলে এদের সঙ্গে লোকালদের সরানড়া হতে বেশি দেরি হয়নি। বাংলাদেশের যশোর, ঝিনাইদহ, পাবনা, সিরাজগঞ্জ অঞ্চলে বেশির ভাগ নিকারি মুসলমানের বাস।
মাছের হোলসেলার নিকারি দেখার পর বাঙালি অন্য হোলসেলারদেরকেও নিকারি বলতে শিখল। এই করেই নুনের নিকারি ফলের নিকারি কথাটা এসেছে। এমনকি নওগাঁ, বাদলগাছি এলাকায় অল্প পুঁজির কাঁচামাল ব্যবসায়ী আর শাকসবজির কাবাড়িদেরকেও নেকারি বলে।
সে যুগে এখানকার জেলেরা নৌকো ভর্তি করে মাছ আনলে পাইকার নিকারি পুরো নৌকোর মাছ দেখে থোক দামে কিনে নিত। এমনকি আগেই মাছের দাম দাদনে দিয়ে সাগরে নৌকো পাঠাত। একে বলে নিকারি নৌকো। এখনো ইলিশের ট্রলার এভাবেই বুক্ড্ হয়। ট্রলারের জেলেরা ট্রলার থেকে একটা মাছও বাড়ি নিয়ে যেতে পারে না। তেমনি নিকারি কোনো আমবাগান বায়না করে নিলে পাড়ার বাচ্চাকাচ্চাদের বাগানের ধারে কাছে যেতে দেয় না, একটা ঝরাপড়া আমও কুড়াতে দেয় না। মাছের নিকারি আমের নিকারি এদের এত আছে, তাও একটাও নিতে দেয় না। এই কারণে চামার, ফকিন্নি, ভিখিরি বোঝাতে নিকিরি কথাটা চলে। যদিও নিকারিরা ভিখারি হতো না। লোকাল জাইল্যা মানে জেলের পরিশ্রমের ফসল বেচে তারা ফুলে ফেঁপে উঠত। সেজন্যই এই প্রবাদগুলোর জন্ম হয়েছে-
নিকারির কানে সোনা জাইল্যার পরনে ত্যানা।
নিকারির বউয়ের লাল শাড়ি জাইল্যার নাই ঘর বাড়ি।
নিকারি বেটির কী বাহার জাইল্যা বেটির হাহাকার।
লেখক : ভাষাচাষা। বাংলা কথার ঠিক-ঠিকানা সন্ধানী
ykyusufkhan@gmail.com