কোরবানি, পশুপ্রেম ও জনদরদ

নজরুল ইসলাম টিপু | Jul 21, 2021 02:47 pm
কোরবানির গরু

কোরবানির গরু - ছবি : সংগৃহীত

 

প্রতিবছর কোরবানির ঈদের ঠিক আগ মুহূর্তে কিছু মানুষের পশুপ্রেম বেড়ে যায়! লক্ষণীয় যে পশুপ্রেমের তাগিদ বোঝাতে গরুর ছবি দিয়েই প্রচারণা করা হয়। পশুপ্রেম ইসলাম ধর্মের অত্যাবশ্যকীয় অংশ। যে ব্যক্তি পশুর প্রতি জঘন্য আচরণ করে সে জাহান্নামি। এ ধরনের যুগান্তকারী ঘোষণা একমাত্র ইসলাম ধর্মেই আছে। সকল পশুর প্রতি মহব্বত তারা ধর্মীয়ভাবেই প্রাপ্ত। পশু জবাই করার দৃশ্যটিকে উল্লেখ করে কৌশলে, মুসলমানদের প্রতি ইঙ্গিত করা হয় যে এরা আসলেই পশুর প্রতি নির্দয়, নিষ্ঠুর! অন্যান্য জায়গায় পশুর গোশত খাওয়ার জন্য ইলেকট্রিক শর্ক দিয়ে হত্যা, মাথায় পাথর মেরে হত্যা, বিরাট মাস্তুল দিয়ে হত্যাসহ জঘন্য সব নিয়ম আছে। কিন্তু জবাইয়ের মতো বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিকে নির্দয় আখ্যা দিয়ে, জবাই করা পশুর হাজার হাজার মণ কাঁচা গোশত, রান্না করা গোশত আত্মীয়-অনাত্মীয় সবার কাছে বণ্টন করার দৃশ্যটি পুরোপুরি গৌণ হয়ে যায়।

বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানকার মানুষ গরুর গোশত খায় বেশি। প্রতিবেশী দেশে গরু মর্যাদার প্রতীক। তার প্রতি অশ্রদ্ধা দেখাতে বাংলার মুসলমান গরু খায় না। তারাও গরুকে ভালোবাসে, প্রিয় প্রাণী হিসেবে যত্ন করে, গরুর মাধ্যমে অনেকেই সচ্ছলতা আনে। বাংলাদেশের জলবায়ু গরু-মহিষ পালনের জন্য দারুণ উপযোগী। ব্যবসায়িক মুনাফা তোলার জন্য ছাগল-ভেড়া পালনে আমাদের দেশ তেমন উপযোগী নয়। কম বৃষ্টিপাতের দেশে এগুলোর স্বাস্থ্য ভালো হয়। তাই অন্য দেশের মতো আমাদের দেশে এসব প্রাণীর শরীর তেমন একটা বাড়ে না। এমনকি ভারতের বহু জায়গাতেও বড় আকৃতির ছাগল-ভেড়া পালনের উপযোগী পরিবেশ রয়েছে। যার কারণে বাংলাদেশের মানুষের গরু-নির্ভরতা বেড়েছে। ফলে কোরবানিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গরু বাংলাদেশেই জবাই হয়। এই জলবায়ুতে এটার কোনো বিকল্প সৃষ্টি করাও সম্ভব নয়।

আরব দেশ থেকে শুরু করে, পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশের মুসলিমেরা ছাগল, ভেড়া, দুম্বা দিয়ে কোরবানি করে। এখানকার স্থানীয় আরবিদের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও, আমাদের দেশের মতো গরু দিয়ে কোরবানি করে না। কোনো আরবি বিশ, ত্রিশটা ছাগল কোরবানি দেয়। কিন্তু ওই আইটেমে একটিও গরু নেই! হজের সময়েই শুধু মক্কা নগরীতেই প্রতি বছর ২০ লাখের ওপর ছাগল-ভেড়া জবাই হয়। রাসুল সা. বিদায় হজের সময় নিজেই এক শ' উঠ কোরবানি দিয়েছিলেন! বিপরীত দিকের হিসেবে দেখা যায়, তিনি তাঁর সহধর্মীনিদের পক্ষ থেকে একটি গরুও কোরবানি করেছিলেন। এতে বোঝা যায়, ইসলাম ধর্ম কোরবানির ক্ষেত্রে ছাগল, ভেড়া, দুর্বার, উটের গুরুত্ব অন্তত গরুর চেয়ে বেশি। বাংলাদেশে ওসব প্রাণীর অপ্রাপ্যতা হেতু, গরুর উপরে ঝুঁকে পড়েছে। হাজার বছরের প্রবণতা এখন রক্তে-মাংসে মিশে গেছে।

যারা পশু প্রেম দেখিয়ে থাকেন, তারা কিন্তু ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, উট এসব প্রাণী নিধনে তেমন সরব থাকে না! উল্লেখ্য আরব দেশে অবস্থিত সকল প্রবাসীর পরিবার দেশের বাড়িতে কোরবানি করে। তাই বলে এসব প্রবাসী, প্রবাস জীবনে গোশত না খেয়ে ঘরে বসে থাকে! ব্যাপারটি এমন নয়। তারাও এখানকার স্থানীয় বাজার থেকে অন্য সময়ের চেয়ে বেশি গোশত কিনে খায়! আশ্চর্যের বিষয় হলো, কোরবানির এই মার্কেটকে লক্ষ্য করে, ভারত থেকে অগ্রিম হাজার হাজার টন গোশত নিয়ে বড় জাহাজগুলো এদেশের বন্দরে নোঙ্গর করে। পশু-প্রেমীরা ভারতের এই আচরণের বিরুদ্ধে কি কথা বলে?

ভারত একটি বিশাল দেশ। ওই দেশে গরু যত্নের সাথে পালিত হয়। কিন্তু গরুর গোশত সেখানে তেমন খাওয়া হয় না। প্রয়োজনে রাস্তায় ছেড়ে দেয়া হয়। কখনো তারা তলিয়ে দেখে কি? ফাইনালি এসব গরুর শেষ যাত্রা কোথায় হয়? বর্তমানে বাংলাদেশে নিজেদের উৎপাদিত গরু কোরবানি হচ্ছে। ভারত থেকে গরু আমদানি অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। তাহলে ভারতের না খাওয়া গরুগুলো কি হাওয়া হয়ে যায়? নাকি তাদের জন্য বায়বীয় শ্মশানের ব্যবস্থা আছে? এ সম্পর্কে আর মন্তব্য না করি।

কোরবানির উছিলায়, কোটি কোটি মানুষ নিজেদের প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করছে। গরীব অভাবী মানুষও এতে সুবিধা পাচ্ছে। ইসলাম ধর্মে যদি কোরবানি ওয়াজিব না করা হত। তাহলে, কোন মানুষই পারিবারিক গোশতের চাহিদা মিঠাতে, এভাবে আস্ত বৃহৎ প্রাণী জবাই করে খেত কিনা সন্দেহ আছে! এ টাকা ব্যাংকে রেখে দিত। হয়তবা কখনো বাজার থেকে দু-এক কেজি কিনে খেত।

পারিবারিক প্রোটিনের অভাব পূরণ, দেশীয় জনস্বাস্থ্য রক্ষা, মানবতার রক্ষাকল্পে, উচ্চমানের খাদ্য বিতরণ ও সুস্বাদু খাদ্যের ঘাটতি পূরণে কোরবানি একটি আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামত। এই সিস্টেম না থাকলে মানুষ যেভাবে নিজেদের ঘাটতি পূরণ করতে পারত না, সেভাবে প্রচুর মানুষের গরু-নির্ভর ব্যবসাও বন্ধ হয়ে যেত। কোরবানির দিন পশু লাগবে এই বিষয়টিকে কেন্দ্র করে, সারা দুনিয়ায় লক্ষ লক্ষ ফার্ম গড়ে উঠেছে, চামড়া শিল্পের সৃষ্টি হয়েছে। যা কোরবানির অপরিহার্যতার কারণেই হয়েছে। গ্রামে গঞ্জে কোটি কোটি মানুষ গরু-ছাগলের উপর জীবনকে নির্ভর করে রেখেছে এই চিন্তায় যে; সময় হলে কোরবানির বাজারে পশু বিক্রি করে মুনাফার টাকাটা দিয়ে নিজের সমস্যার সমাধান করবে।

হাল আমলে আরেকটি মতলবি প্রচারণা শুরু হয়েছে। কোরবানির টাকায় জনদরদি হয়ে যাওয়া। কোরবানির পশুর কেনার জন্য নির্ধারিত টাকায় পশু কোরবানি না করে গরিব, অসহায়কে দান করার আহবান করা হচ্ছে! মূলত এসব ব্যক্তি উপরোক্ত পশু দরদিদেরই আরেকটি টিম। পন্থাটা ভিন্ন। মূলত কোরবানির হচ্ছে ইসলামের নির্দেশ করা একটি বিধান যার দাবিই হচ্ছে জনদরদি হওয়া। এটা পালন করার জন্য অন্যতম শর্ত হলো প্রাণী হত্যা করে নিজে খাবে, অন্যকে খাওয়াবে। গরিব অসহায় মানুষের প্রথম প্রয়োজন হলো খাদ্য। আর কোরবানি শব্দের অর্থই হলো ত্যাগ, এই ত্যাগ তো গরিব অসহায়কে খাদ্যের মাধ্যমেই করা হয়। কোরবানি না করে, টাকা প্রদানের দাবিদার এসব মানুষ কোরবানিকে ঠুনকো অর্থে ব্যাখ্যা করে! যেন এটা মলত্যাগ, মূত্রত্যাগের মতোই তুচ্ছ বিষয়!

যাহোক কোরবানির অর্থ পশু কোরবানির মাধ্যমেই কাজে লাগাতে হবে। অন্যূন অতটুকু বেশি প্রচারণা চালানো যায় যে জবাই করা পশুর বেশির ভাগ গোশত দান করুন। ১০ লাখ টাকায় একটি গরু না কিনে ১০টি গরু কিনে বিতরণ করুন ইত্যাদি। বিষয়টি যেহেতু ধর্মীয় নির্দেশনার বিষয়, সেহেতু এক খাতের টাকাটা অন্য খাতে ঢুকিয়ে দেবার পরামর্শটাও বিভ্রান্তিকর। পশু কোরবানির পরীক্ষিত বিষয়টি হাল আমলের উদ্ভাবন নয়; সারা পৃথিবীতে এই নিয়ম চলে আসছে পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে।

 


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us