তুরস্ককে কি তালেবান মেনে নেবে?
এরদোগান ও তালেবান নেতৃত্ব - ছবি : সংগৃহীত
বর্তমানে আফগানিস্তানে বাইরের রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে তুরস্কের অবস্থান কেমন হবে তা নিয়ে সবচেয়ে বেশি জল্পনা কল্পনা হচ্ছে। যদিও তুরস্কের সাথে আফগানিস্তানের সরাসরি সীমান্ত নেই, তারপরও নানা কারণে তুরস্কের জন্য আফগানিস্তান গুরুত্বপূর্ণ!
মার্কিন নেতৃত্বাধীন 'ন্যাটো' জোটের সদস্য হিসেবে প্রায় ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানে অবস্থান করছে কয়েক শ' তুর্কী সৈনিক। তুর্কি সৈনিকরা সরাসরি আফগান মিলিট্যান্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করলেও আফগানিস্তানের সরকারি বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দান এবং বিভিন্ন সরকারি অবকাঠামো নির্মাণের দায়িত্ব পালন করে আসছে।
দোহা চুক্তি অনুসারে, ন্যাটো তল্পিতল্পা গুটিয়ে আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা এই বছরের সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে৷ ওই হিসেবে তুরস্কের সৈন্যদেরও চলে যাওয়ারই কথা আফগানিস্তান ছেড়ে।
কিন্তু কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা দানের যুক্তি দেখিয়ে তুরস্ক কর্তৃক ন্যাটোকে প্রস্তাব দেয়া হয় তুর্কি সেনাদের আফগানিস্তানে রেখে যাওয়ার জন্য। সেই সাথে তুরস্ক আরো কিছু শর্ত জুড়ে দেয়। যেমন
* রাশিয়ান ডিফেন্স সিস্টেম এস-৪০০ কেনার জন্য যাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক তুরস্ককে অবরোধ না দেয়া হয়।
* তুরস্কের সহযোগী হিসেবে ন্যাটো রাষ্ট্র হাঙ্গেরি ও ন্যাটোর বাইরের রাষ্ট্র পাকিস্তানকে সাথে রাখবে তুরস্ক।
* আফগানিস্তানে তুরস্ককে আর্থিক, লজিস্টিক ও গোয়েন্দা সহায়তা করবে ন্যাটো।
তুরস্কের এমন প্রস্তাবে কিছুটা সবুজ সংকেত দিয়েছে মার্কিন প্রশাসন। অপরদিকে তুরস্কের এমন ভূমিকায় স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে আফগান যোদ্ধারা তথা তালেবান। পাকিস্তান সরাসরি সম্মতি জানায়নি এখন পর্যন্ত। কারণ এতে করে আফগানিস্তানে নিজেদের প্রভাব তুরস্কের সাথে ভাগাভাগি করতে হবে। আবার তুরস্ককে সরাসরি না বলার মনস্তাত্ত্বিক ক্ষমতাও নেই ইমরান সরকারের।
(নোট : তুর্কি সাইপ্রাসে তুরস্কের অবস্থান নিয়ে শুরু থেকেই বিরোধিতা করে আসছিল যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু আফগানিস্তানে মার্কিন স্বার্থের জন্য সহায়ক অবস্থান জানান দেয়ার মধ্যেই ১৯-২০ জুলাই তুর্কি সাইপ্রাস সফর করছে তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান। তুর্কি সাইপ্রাসে তুরস্কের অবস্থানের পক্ষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পেতে আফগান পরিস্থিতি নিয়ে কূটনৈতিক গেইম হলেও হতে পারে।)
মধ্য এশিয়ার 'স্তান' রাষ্ট্র তথা কাজাখস্তান, কিরঘিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও তাজিকিস্তানের মধ্যে একমাত্র তাজিকিস্তান বাদে আর বাকি চারটি রাষ্ট্র বৃহত্তর তুর্কি জনগোষ্ঠীর রাষ্ট্র। তুরস্কের তাই সর্বদা প্রচেষ্টা এই রাষ্ট্রগুলোতে নিজের প্রভাব বৃদ্ধি করতে। কিন্তু মধ্য এশিয়ার কোনো রাষ্ট্রের সাথেই তুরস্কের সীমান্ত।
তুর্কি জনগোষ্ঠীর আরেকটি রাষ্ট্র আজারবাইজানের সাথে সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কের সম্পর্ক খুব মধুর। কিন্তু সে তুলনায় মধ্য এশিয়ার তুর্কি রাষ্ট্রগুলোর সাথে সম্পর্ক ততটা গভীরতায় নিতে পারেনি তুরস্ক। আর তাই মধ্য এশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশ আফগানিস্তানেন প্রভাব তৈরির মাধ্যমে মধ্য এশিয়ার ভৌগোলিক এবং রাজনৈতিক ফিল্ডে আগমনের চেষ্টা রয়েছে তুরস্কের।
শরণার্থী ভারে জর্জরিত তুরস্ক। তুরস্কে প্রায় তিন মিলিয়ন সিরিয়ান শরণার্থীর বসবাস। সিরিয়ান শরণার্থীর পরে সবচেয়ে বেশি যে দেশের শরণার্থী তুরস্কে অবস্থান করে তা হলো আফগানিস্তানের শরণার্থী। বর্তমানে প্রায় দেড় লাখ নিবন্ধিত আফগান শরণার্থী রয়েছে তুরস্কে। অনিবন্ধিত শরণার্থী আরো বহু সংখ্যক রয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ের পর আফগানিস্তানে যদি বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে নতুন করে সংঘাত শুরু হয়, সেক্ষেত্রে শরণার্থী ঢল নতুন করে নামবে। আর তখন এই শরণার্থীদের বড় একটা অংশ তুরস্কে আশ্রয় নেয়ার উদ্দেশ্যে তুরস্কে গমন করবে ইরান হয়ে। (যদিও বেশিরভাগই ইউরোপ যেতে সক্ষম হবে না। কারণ তুর্কি ও ইউরোপ সীমান্ত এখন মোটামুটি সিলগালা।) আর তাই আফগানে নতুন করে সংঘাত তৈরি হলে শরণার্থীর ঢল বাড়বে তুরস্কে।
আফগান শরণার্থীদের বেশিরভাগই বর্তমানে পাকিস্তান ও ইরানে থাকে। মূলত পশতুন ও হাজারা জনগোষ্ঠীর রিফিউজিরা পাকিস্তান ও ইরানে আশ্রয় নিয়েছে। আফগানে নতুন করে সংঘাত তৈরি হলে আফগানের উত্তরাঞ্চলে বসবাসকারী তুর্কি জনগোষ্ঠী সবচেয়ে বেশি বাস্তুচ্যুত হবে এবং এদের বড় অংশের গন্তব্য হবে তুরস্ক।
বলকান, ককেশাস, উত্তর আফ্রিকা, পূর্ব আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে সামরিক উপস্থিতি বজায় রাখতে পারলেও মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ায় তুরস্কের সামরিক উপস্থিতি নেই।
আফগানিস্তানে সৈন্য রাখার মাধ্যমে নিজেদের পাওয়ার বাড়ানোর প্রচেষ্টা ও রয়েছে তুরস্কের।
উপরিউক্ত কারণগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তুরস্কের জন্য কৌশলগত কারণে আফগানিস্তান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
তুরস্কের এমন অবস্থান আফগান গোষ্ঠীগুলো কেমন দৃষ্টিতে দেখছে?
আফগানিস্তানের সরকার পক্ষ (আশরা গানি সরকার) তুরস্কের এমন অবস্থানে বাহ্যিকভাবে আনন্দিত। কারণ তুর্কি সেনার কাবুলে অবস্থান তার ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য প্রাথমিকভাবে সহায়ক হবে।
অপরদিকে আফগান যোদ্ধারা [তালেবান] তুরস্কের এমন অবস্থানের নিন্দা জানিয়ে আসছে প্রথম থেকে। আফগান যোদ্ধারা একটা শক্তিশালী মুসলিম দেশ হিসেবে তুরস্কের প্রশংসা করলেও আফগান ভূখণ্ডে ন্যাটোর ছত্রছায়ায় তুর্কি সৈন্য অবস্থানের বিরুদ্ধে রয়েছে সবসময়।
আফগানিস্তান কার্যত এখন দুই অংশে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। দেশটির ৬০ ভাগের অধিক এলাকা আফগান যোদ্ধারা নিয়ন্ত্রণ করলেও কাবুলসহ গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর নিয়ন্ত্রণ এখনো গানি সরকারের হাতে। দুই পক্ষ রাজনৈতিক সমঝোতায় আসার জন্য ইরান, কাতারে কয়েকবার বৈঠকে বসলেও কার্যত কোনো ফল আসেনি। আর এতে ধারণা করা হচ্ছে, ন্যাটোর বিদায়ের পর সামরিক সংঘাতের মাধ্যমে তালেবান পুরা আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ আনার প্রচেষ্টা চলাবে।
তুরস্ক বর্তমানে গানি সরকার ও তালেবানের মধ্যে সমঝোতা করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে (যদিও রাজনৈতিক সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম )। তবে তুরস্ককে মধ্যস্ততাকারী হিসেবে গানি সরকার মেনে নিলেও আফগান যোদ্ধারা এখন পর্যন্ত মানেনি। এতে করে তুরস্কের মধ্যস্ততাকারী থাকার চেষ্টা ভণ্ডুল হতে পারে।
তুরস্ক কি আফগানে সামরিক সংঘাতে জড়াবে?
তুরস্কের সৈন্য বাহিনী আফগানে কোনো অবস্থাতেই সংঘাতে জড়াবে না। ২০২৩ সালে তুরস্কের জাতীয় নির্বাচনের আগে নতুন করে কোনো ফ্রন্ট খুলবে না তুরস্ক। আফগানিস্তানে রাজনৈতিক সমঝোতায় আসার প্রচেষ্টা যদি ব্যর্থ হয় সেক্ষেত্রে সামরিক সংঘাত শুরু হলেও তুর্কি সৈন্যরা কারো পক্ষে যুদ্ধে যোগ দিবে না।
আফগানিস্তানে সামরিক সংঘাত শুরু হলে তুরস্ক উভয় দিক থেকেই সংকটে পড়বে। আর তাই তুরস্ক ভিতরে-বাইরে চেষ্টা চালাচ্ছে, যাতে একটা রাজনৈতিক সমঝোতা আসে আফগানে।
একইসাথে পশ্চিমা গোষ্ঠী ও আফগান যোদ্ধাদের আস্থাশীল হতে পারবে কি তুরস্ক?
আফগানিস্তানে নিজেদের সৈন্য রাখার দুঃসাহসিক (যেখানে অন্য কোনো ন্যাটো দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ের পর একা থাকতে রাজি হচ্ছে না) ঘোষণা দিয়ে ইতোমধ্যেই পশ্চিমা জোটের আস্থাশীল হওয়ার পথে তুরস্ক। পাশাপাশি ইইউ ও ন্যাটো সদস্য হাঙ্গেরিকে আফগানিস্তানে থাকার ব্যাপারে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে পশ্চিম অক্ষে নিজেদের ইমেজ আরো বেড়েছে তুরস্কের।
(নোট : হাঙ্গেরির ক্রমবর্ধমান অস্ত্রের বাজার ধরাও তুরস্কের একটি লক্ষ্য। তুর্কি নেতৃত্বাধীন 'তার্কিক কাউন্সিলের' অন্যতম পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র হলো হাঙ্গেরি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন কর্তৃক তুরস্ককে অবরোধ আরোপ করার প্রস্তাবে সবসময় বিরোধিতা করে এসেছে হাঙ্গেরি)
কিন্তু ঐতিহাসিক কোনো প্রেক্ষাপট ছাড়া হঠাৎ করে আফগানিস্তানে সৈন্য রাখার ঘোষণা তালেবানের পাশাপাশি অনেক সাধারণ আফগান ও ভালো দৃষ্টিতে দেখছে না। এমতাবস্থায় তুরস্কের ইমেজ সংকটাপন্ন হওয়ার একটা ঝুঁকি থাকতে পারে।
তবে পাশাপাশি এটাও মাথায় রাখতে হবে, তুরস্কের বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোগান পপুলিজম রাজনীতির বাহক। নিজের জনপ্রিয়তা হ্রাস করে কোনো সিদ্ধান্ত অতীতে তিনি নেননি, হোক তা তুরস্কের অভ্যন্তরে বা বাইরে। সিরিয়া, লিবিয়া, আজারবাইজান, ইরাকসহ যেসব ফ্রন্টে তুর্কি সেনারা সংঘাতে জড়িয়েছে, মুসলিমবিশ্ব এবং ওই অঞ্চলের মেজরিটি অংশের সমর্থন পেয়েছে। আর তাই আফগানেও তিনি নিজের ইমেজ ক্ষুণ্ন করে কোনো প্রান্তিক সিদ্ধান্ত নেবেন না বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
(নোট : আজকে তুর্কি সাইপ্রাসে বিজয় দিবসের ভাষণ দেয়ার সময় এরদোগান বলেন, আমাদের এবং আফগান যোদ্ধাদের মধ্যে আদর্শগত কোনো বিরোধ নেই। তালেবানের সাথে সমঝোতা করেই আমরা আফগানিস্তানে থাকবো।)
পরিশেষে, আফগানিস্তানের অস্থিতিশীলতা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রভাব ফেলবে। আর তাই আফগানে আবারো শান্তি আসুক, এমন কামনাই করি।