তালেবানের উত্থানে ভারত কেন ভীত?
নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ। ইনসেটে আফগান নেতা - ছবি : সংগৃহীত
আফগানিস্তানে দীর্ঘ ২০ বছরের অসম যুদ্ধে আমেরিকার পরাজয় মেনে সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে তালেবান উত্থানের সমূহ সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তালেবানের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দেশের ৩৪টি প্রদেশের ৪২১টি জেলার ৮৫ ভাগ অঞ্চল এখন তাদের নিয়ন্ত্রণে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ন্যাটো জোটের সৈন্য প্রত্যাহার শেষ হলে কাবুল সরকারের পক্ষে এককভাবে তালেবানের প্রশিক্ষিত চার লক্ষাধিক চৌকস সেনার মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএর অনুসন্ধান মতে, ছয় মাসের মধ্যে তালেবান কাবুলের নিয়ন্ত্রণ ভার দখল করে বসবে। তখন আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে নতুন সমীকরণ যুক্ত হবে। শুরু হবে নতুন ব্যাকরণের নানা ধারাপাত।
তালেবানের উত্থানে সবচেয়ে বেশি শঙ্কা বোধ করছে ভারত। ৯/১১-এর পর থেকে তালেবানবিরোধী মার্কিনপন্থী সরকারের সমর্থনে দেশটির আধা-জল খেয়ে নামার ইতিহাস রয়েছে। ভারতের চিরবৈরী প্রতিবেশী পাকিস্তান ও প্রবল ক্ষমতাধর চীনের উপর প্রভাব সৃষ্টির লক্ষ্যে আফগানকে নিজেদের প্রভাব বলয়ে রাখা ভারতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব বিবেচনায় আফগান মধ্য এশিয়ার হৃদয়ভূমি। এশিয়া মাইনর, মধ্যপ্রাচ্য ও রাশিয়া নিয়ন্ত্রণের ভৌগলিক কৌশলে রাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় ভারত এশিয়ার হৃদয়খ্যাত এই আফগান-ভূমে সুদৃঢ় আসন গেঁড়ে বসে। ন্যাটো-সমর্থিত কাবুল সরকারের সামরিক বাহিনী, গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনকে নিজেদের মতো ঢেলে সাজিয়েছিল ভারত। কাবুল সরকারের উপর আস্থাশীল হয়ে ভারত পানি ও বিদ্যুৎ প্রকল্প, সড়ক নির্মাণ ও অবকাঠামো উন্নয়নসহ আরো বেশ কিছু খাতের চার শতাধিক প্রকল্পে ৩০০ কোটি ডলারের বিশাল বিনিয়োগ করে। দুই দশকের এই দীর্ঘ সময়ে আফগান সরকারের উপর ভারতের যে বিপুল প্রভাব সৃষ্টি হয়েছে, তালেবানের উত্থানে পুরোটাই ভণ্ডুল হয়ে যাবে। পানিতে যাবে আশাবাদের এই বিশাল ইনভেস্ট। দিল্লির তাই শঙ্কার শেষ নেই।
ভারতের ইচ্ছে ছিল, আফগান প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; পাক সীমান্ত ঘেঁষা কনস্যুলেটগুলোর মাধ্যমে পাকিস্তানকে কোণঠাসা করা; চীন সাগর ও ভারত মহাসাগরের মাঝে সংযোগ স্থাপনকারী মালাক্কা প্রণালীর ব্যাপক নজরদারিতে চীনের বাণিজ্য ব্যবস্থাকে বেকায়দায় ফেলা; নতুন রুট ব্যবহার করে মধ্য এশিয়ার 'স্তান' রাষ্ট্রগুলোর বিশাল বাজার দখল করা। কিন্তু তালেবানের উত্থানে ওই আশা চূড়ান্তভাবে ব্যাহত হয়েছে।
কারণ, পাকিস্তানের সাথে রয়েছে তালেবানের উষ্ণ সম্পর্ক। চীনের প্রতিও রয়েছে তাদের বন্ধুভাবাপন্ন মানসিকতা। তালেবানের উত্থান তাই আফগানে দেশ দুটির প্রভাব বৃদ্ধি করবে। ভারতকে করবে প্রভাবশূন্য। ভারত তখন আঞ্চলিক এই শক্তি দুটির চাপে কোণঠাসা হয়ে পড়বে। ওদিকে সুসম্পর্কের ভিত্তিতে সিপিইসিতে তালেবানকে যুক্ত করে আফগানের বুক চিরে চীন পাকিস্তান পৌঁছে যাবে মধ্য এশিয়ার 'স্তান' রাষ্ট্রগুলোর দোরগোড়ায়। তারা সহজেই 'স্তান রাষ্ট্র' কাজাখস্তান, কিরঘিজস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও তাজিকিস্তানের বিশাল বাজার অধিকার করে বসবে। সিপিইসি করিডোরের মাধ্যমে আফগান ও 'স্তান' রাষ্ট্রগুলোও সমুদ্রপথে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা মহাদেশে অবাধ যাতায়াত ও বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা গ্ৰহণ করতে পারবে। ফলে তারা অনেকটা পাকিস্তানমুখী হয়ে পড়বে। তাদের উপর পাকিস্তানের দীর্ঘসময় প্রভাব বজায় থাকবে। এতে 'স্তান' রাষ্ট্রগুলোতে পৌঁছার নতুন রুট প্রকল্পে ব্যর্থ ভারত নিশ্চয় খুশি হবে না।
আবার প্রকল্পটি আজাদ কাশ্মির ভেদ করে যাবে। পাকিস্তান নিয়ন্ত্রণ করলেও আজাদ কাশ্মিরকে ভারত এখনো নিজেদের ভাবে। এই করিডোর বাস্তবায়ন হলে তাদের আজাদ কাশ্মির ফিরে পাওয়ার আশা হবে সুদূর পরাহত। এজন্যও ভারতের মর্মজ্বালা কম নয়।
ওদিকে সিপিইসির অবদানে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আর চীনকে কেবলই মালাক্কা প্রণালী নির্ভর হয়ে থাকতে হবে না। চীনের বাণিজ্যকে বেকায়দায় ফেলার এই মহাসুযোগ হাতছাড়া হওয়াও তো ভারতের জন্য কম অস্বস্তিকর নয়।
তাছাড়া ভারতের বিরুদ্ধে রয়েছে তালেবানের প্রতিশোধ আক্রোশ। আফগানের যুব প্রজন্মের চরিত্রনাশকল্পে ভারত সরবরাহ করেছিল হিন্দি সিনেমার হাজারো রেকর্ড। যখন পেটমোটা টিভি ছিল ধনীদের আয়েশবিলাস, ভারত তখন আফগানের মোড়ে মোড়ে বসায় উন্নত প্রযুক্তির টিভির স্ক্রিন। উঠতি প্রজন্ম জটলা পাকিয়ে তাতে হিন্দি সিরিয়াল দেখত। দিনশেষে ভারতীয় স্টাইলে হিরো সাজার চেষ্টা করত। সাংস্কৃতিক এই আগ্ৰাসনে তালেবান যোদ্ধারা যারপরনাই শঙ্কিত ছিল।
তারা বিশ্বাস করত, আফগানদের হৃদয় থেকে ইসলামের প্রভাব কমানোর দীর্ঘ ফন্দি হিসেবে ভারতীয় থিংক ট্যাংক এমন কাজের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। কিন্তু ওই প্রেক্ষাপটে হৃদয় চৌচির আহ্ উচ্চারণ ছাড়া তাদের কিছুই করার ছিল না। দুই দশক যুদ্ধের পর যখন বিজয়মাল্যে তাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়, তালেবানের পক্ষ থেকে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ওই প্রতিশোধ আক্রোশের শঙ্কা প্রবলভাবে দেখা দিয়েছে। আফগানে তাই ভারতীয় কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এজন্য যেখানে তালেবানের নিয়ন্ত্রণ সুপ্রতিষ্ঠিত হয়, ভারতীয় কর্মকর্তারা সেখান থেকেই খুব দ্রুত সটকে পড়ে। পরিস্থিতি এমন যে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও সাথে নিতে পারে না।
আফগানিস্তানে ভারতের প্রভাব কমে গেলে ভারতীয় ভূমি, বিশেষ করে কাশ্মিরের উপর পাকিস্তানের নজরদারি বৃদ্ধি পাবে। এতে ভারতের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। তাছাড়া তালেবানের উত্থানে কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামীরাও অনুপ্রাণিত হবে। স্বাধীনতার জন্য আরো জানবাজি রেখে লড়াই করবে। কাশ্মিরের স্বাধীনতাকামী মানুষদের প্রতি তালেবানেরও যথেষ্ট সহানুভূতি রয়েছে। এজন্য পাকিস্তান ও চীনের মিত্রতার দাবিতে তালেবানের ভারতবিরোধী নীতি অবলম্বন অবাককর কিছু নয়। তখন কাশ্মিরও হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। কাশ্মিরকে বিশেষ মর্যাদা ফিরিয়ে দেয়ার যে আশ্বাস মোদি সরকার দিয়েছে, তাতে স্বাধীনতাকামীদের আস্থা অর্জন সম্ভবপর হবে বলে মনে হয় না। অদূর ভবিষ্যতে যে স্বাধীনতার সোনার হরিণ ধরা দিবে, সে আশায় এই টোপ গিলতে চাইবে না।
মোটকথা তালেবানের উত্থানে ভারতের বিপর্যয়ের শেষ থাকবে না। এজন্য আমেরিকার শান্তিচুক্তির কঠোর বিরোধিতা করে ভারত। নানাভাবে চেষ্টা করেও যখন আমেরিকাকে নিরত রাখা সম্ভব হয় না, শেষের দিকে এসে ভারত নতুন পথে হাঁটতে শুরু করে। বিভিন্ন মাধ্যমে তালেবানের সাথে যোগাযোগের (পারলে সম্পর্ক স্থাপনের) চেষ্টা করে। কাতার, ইরান ও রাশিয়ায় গিয়ে ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের প্রতিনিধি দল তিন দফায় তালেবান নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনায় বসে। যদিও এটা ভারতের চিরায়ত পররাষ্ট্রনীতির স্পষ্ট লঙ্ঘন। কারণ, ভারত কখনো আফগানের গেরিলা বাহিনীকে সমর্থন দেয়নি। বরং বরাবরই ন্যাটোসমর্থিত কাবুল সরকারের জোরালো সমর্থক। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চিরস্থায়ী বন্ধু বা শত্রু বলতে কিছু নেই। দেশের স্বার্থই এখানে পরম আরাধ্য। নীতি পরিবর্তন করে ভারত তাই তালেবানের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য কাজ করছে। তবে এতে কতটুকু সফলতা আসবে, এ নিয়ে স্বয়ং ভারতীয় কর্মকর্তারাও দ্বিধান্বিত। তালেবান যদিও বলছে, অন্য দেশের বিষয়ে তারা নাক গলাবে না। কিন্তু এতটুকু আশ্বাসবানীতেই কি দুশ্চিন্তার ঘোর কেটে যায়?