প্রিয় বনফুল
বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় - ছবি সংগৃহীত
আজ ১৯ জুলাই। আমার খুব প্রিয় একজন লেখকের জন্মদিন। নাম : বনফুল। এই নামেই তিনি পরিচিত। আসল নাম বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সৈয়দ মুজতবা আলী, প্রমথ চৌধুরী ও বনফুল। এ চারজন- সাহিত্য এবং ব্যক্তিত্ব, দু' দিক থেকেই আমার অতি প্রিয়, আমার কাছে পূজনীয়। মানুষগুলোকে অন্তর থেকে ভালোবাসি, ওনাদের প্রায় লেখাই বলতে গেলে তরুণ বয়সে পড়া। এখনো সময় সুযোগ পেলে রবি ঠাকুরের কাব্যের কাছে ফিরে যাই, আলী সাহেবের রম্যের প্রাণখোলা হাসিতে নিজেকে ফিরে পাই, প্রমথের সহজ বুননের প্রবন্ধে পাই নির্ভার চিন্তার রসদ। সবশেষে আসে বলাইয়ের কথা। বনফুলের বাংলা ছোটগল্প ফরাসি মোপাসাঁ কিংবা রাশান চেকভের পাশে বাংলা সাহিত্যের এক হীরক-রত্ন।
প্রিয় লেখকদের মন থেকে স্মরণ করি। সম্মান করি। লেখায় স্মরণ করি। ওনাদের কাছ থেকে জীবন এবং সাহিত্যের যে বুঝটুকু পেয়েছি, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি।
মজার হলো, ইংরেজি ভাষাতে লিখে গেছেন এমন চারজনও অতি প্রিয় আছেন। ব্রান্ট্রান্ড রাসেল, ডি এইচ লরেন্স, ভি এস নাইপাল, এবং সিগমন্ড ফ্রয়েড। ওনাদের গল্প না হয় অন্যদিন বলব। আজ শুধু বনফুলের কথা।
বলাইচাঁদ থেকে বনফুল হলেন কেন? কেনই বা এই ছদ্মনাম বেছে নিলেন? ১৯১৫ সাল। বনফুল তখন ক্লাস টেনের ছাত্র। স্কুলের ম্যাগাজিনে, দেয়ালিকায়, পূজাবার্ষিকীতে লিখতেন। ভালোই লিখতেন। বন্ধুরা একদিন তার একটি কবিতা মালঞ্চ বলে একটা পত্রিকার সাহিত্য পাতায় বলাই নামে পাঠিয়ে দেন। যথাসময়ে ছাপা হলো কবিতা। সবাই প্রশংসা করল, একজন ছাড়া। স্কুলের প্রধান শিক্ষক। রেগে গিয়ে বললেন, পড়ালেখা ছেড়ে কবিতা! দেখাচ্ছি মজা! বলাইচাঁদ প্রমাদ গুণলেন। বনফুল নাম দিয়ে পত্রিকায় লিখতে লাগলেন কেবল হেডমাস্টারের চোখ এড়াতে।
সেই শুরু বনফুল। ১৮৯৯ সালের ১৯ জুলাই বিহারের পূর্ণিয়ায় জন্ম এবং বড় হওয়া বলাইচাঁদ ১৬ বছর বয়সে বনফুল নামে লিখে ১৯৭৯ সালে মারা যান। প্রায় ৮০ বছরের জীবনে ৫৮৬টি ছোটগল্প ছাড়াও ৬০টি উপন্যাস, বড়গল্প এবং হাজারখানেক কবিতা লিখেন।
বাবা নিজে ভালো ডাক্তার ছিলেন। বিহারে প্রাকটিস করতেন তিনি। বাবার পথে তিনিও ডাক্তার হলেন। প্রথমে ভর্তি হয়েছিলেন কলকাতা মেডিকেল কলেজে, পরে থার্ড ইয়ারে পাটনা মেডিকেল কলেজে চলে গিয়ে সেখান থেকে ১৯২৮ সালে ডিগ্রি লাভ করেন। বিহারের ভাগলপুরে একটি ল্যাব ক্লিনিক চালাতেন। ৪০ বছর পর্যন্ত ওখানেই প্যাথোলজিস্ট হিসাবে কাজ করে ১৯৬৮ থেকে কলকাতায় থাকতেন।
বাবা ছিলেন বিহারের বিখ্যাত ডাক্তার সত্যনারায়ণ মুখোপাধ্যায়। ছোটভাই অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ও ডাক্তারি পড়া শুরু করেছিলেন। বেশি দিন ভালো লাগেনি। হাড়গোড় ছেড়ে শান্তিনিকেতনে চলে গেলেন অরবিন্দ। সেখানে ছিলেন সত্যজিৎ রায়ের সহপাঠী এবং রায়ের পরেই বাংলা মুভির সবচেয়ে জনপ্রিয় সিনেমা পরিচালক হলেন অরবিন্দ। বনফুলের শ্যালিকাও ছিলেন ওই সময়ে কলকাতার সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা সুপ্রিয়া দেবী। উত্তম সুচিত্রার জুটির চেয়ে ষাটের দশকে উত্তম সুপ্রিয়ার জুটি আরো বেশি জনপ্রিয় ছিল। যারা ওই সময়ের ফিল্মের কথা জানে, তারা এসব খবর ভালো রাখে। বিশেষত আমাদের বাবা-মায়েরা। মায়ের মুখে উত্তম সুপ্রিয়ার চৌরঙ্গীর কথা শুনেছি। ১৯৬৮ তে ছবিটি নির্মিত হয়েছিল। যদিও লেখক শংকরের বিখ্যাত চৌরঙ্গী উপন্যাসটি যা একই নামে ফিল্মও হয়েছিল, প্রথম পড়ি ১৯৮৯ সালে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই বাংলা সাহিত্যের অসাধারণ কিছু ছোটগল্প সৃষ্টি করলেও লেখক বনফুলের ছোটগল্পের অসম্ভব ভক্ত ছিলেন। একবার পত্রিকায় বনফুলের একটি গল্প পড়ে ঠাকুরজি অতি মুগ্ধ হয়ে বলাইচাঁদ'কে চিঠি লিখলেন। বললেন, তুমি যা চাইবে, তাই দেবো। বনফুল রবি দাকে খুব শ্রদ্ধা করতেন। কলকাতায় এলে জোড়াসাঁকো কিংবা শান্তিনিকেতনে চলে যেতেন কবির সাথে গল্প করতে। বনফুল তেমন কিছু চাইলেন না। উনি জানতেন, কবির খুব প্রিয় একটি ড্রেস ছিল লম্বা এক জোব্বা। সেটি চাইলেন। রবি ঠাকুর সেটা পাঠিয়ে দিলেন। বন্ধু এবং শ্রদ্ধার প্রিয় লেখকের ড্রেসটি বনফুল সারাজীবন যত্ন করে রেখেছিলেন। গুণীর কদর গুণ'ই জানে।
বনফুল খুব ভোজনরসিক ছিলেন। শরীরও দেখতে কুস্তিগীরের মতো। খুব ভালো রান্না করতেন। একসময় প্রচুর ব্যঙ্গ লেখা লিখতেন। ৫টি নাটকও লিখেছেন। ওনার সব লেখা ২২ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে পরে। খুব ভালো বক্তৃতা করতেন। একবার এক ঘরোয়া সভায় অনেক গণ্যমান্য উপস্থিত। মধ্যমনি রবীন্দ্রনাথ। বনফুলও সেখানে। অনেকে বক্তৃতা করলেন। বনফুলও বললেন। সবাই বনফুলের বক্তৃতার খুব প্রশংসা করলেন। রবীন্দ্রনাথ মজা করে বললেন,
আরে, তোমরা ওর খুব প্রশংসা করছো ! ওর কাজ'ই তো বলা, মানে বলাই, ওর নামও তো বলাই!
সবাই হো হো হো করে হেসে উঠল।
শুভ জন্মদিন প্রিয় লেখক।
বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়।
বনফুল।
লেখক : চিকিৎসক, কথাসাহিত্যিক ও বিজ্ঞান লেখক । জন্ম বাংলাদেশ, বসবাস ইংল্যান্ড । গ্রন্থ ৮। উল্লেখযোগ্য বই : অনুকথা, জীবন গদ্য, ভাইরাস ও শরীর