সাকিব : স্বপ্নের রাজকুমার
সাকিব আল হাসান - ছবি সংগৃহীত
ছোটবেলার প্রিয় আবদারের মাঝে রূপকথার গল্প ছিল নিঃসন্দেহে সবার ওপরে। কী ছিল না ওই রূপকথার গল্পের রসায়নে? সত্য-মিথ্যের মিশেলে রম্যের আড়ালে অসম্ভব সম্ভব হয়ে যেত এক মুহূর্তে। জাদুর ছোঁয়াতে চোখের পলকে পরিবর্তন হয়ে দৃশ্যপট। বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে বাস্তবতা রুখে দিয়ে যেসব গল্পে জন্ম নিত নানা অনিশ্চয়তার। তবে সব অনিশ্চয়তা দূরে ঠেলে গল্পটাকে পূর্ণতা দিতে উদয়ন ঘটে একজনের; একজন রাজকুমারের।
রাক্ষস কিংবা খারাপ জাদুকরের হাতে বন্দী রাজকন্যাকে ফিরে পেতে, কিংবা কখনো বিপক্ষ দুষ্ট রাজার হাতে বিপদে পড়া রাজকুমারীকে উদ্ধার করতেই রাজকুমারের আগমন ঘটত। অতঃপর সব বাধা পেরিয়ে, সব শর্ত পূরণ করে, কখনো রাক্ষসের সাথে লড়াই করে, কখনো জাদুকরকে বোকা বানিয়ে, কখনো দুষ্টু রাজার সাথে যুদ্ধ করে কখনো বা শাপমোচন করে রক্ষা করা হতো প্রিয়তমা রাজকুমারীকে।
রূপকথার তেমনই এক রাজকুমার আমাদের গল্পেও আছেন। যদিও সময়ের বিবর্তনে তিনি এখন রাজমুকুট শিরে নিয়ে রাজার পদেই সমাসীন বলা চলে। কিন্তু ভূমিকাটা পাল্টায়নি। বিপদে পড়া রাজকুমারীকে উদ্ধার করতে তরবারি আর তীর-ধনুক হাতে হাতে প্রায়ই ময়দানে সমাসীন হতে হয় তাকে। কখনো সৈন্য পাশে পেলেও কখনো লড়াই করতে হয় একা হাতে। প্রায়ই জিতেও যান, উড়ান জয়ের নিশান। উদ্ধার করেন রাজকুমারীকে। তবে কখনো ঘায়েল হন, হেরে যান, নিজ রাজত্বেই ভর্ৎসনার শিকার হতে হয় তখন তাকে।
কে সেই রাজাবেশী রাজকুমার, খুঁজে পেয়েছেন কী তাকে? হ্যাঁ, এর পরও কি আর বুঝতে বাকি থাকে? রাজকুমারী উপমা পাওয়া আমাদের ক্রিকেট দলটাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করতে তীর-ধনুক রূপের বল আর তরবারি নামক উইলো হাতে যিনি রক্ষা করেন তিনিও তো আমাদের সেই স্বপ্নের রাজকুমার। লাল-সবুজের এই মানচিত্র হাজারো বিনিদ্র রাত্রি শেষে, দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহর গুণে ২২ জানুয়ারি ২০০৯-এ যাকে খুঁজে পেয়েছে। যাকে খুঁজে পেয়েছে আইসিসির র্যাংকিংয়ে ব্যাটে-বলে সমতালে সবার উপরে!
দুশ্চিন্তার ভাঁজ সরিয়ে তৃপ্তির হাসি ফোটানোই যেন রাজকুমারের নিত্যকার অভ্যাস। জুটি ক্রমশ বড় হচ্ছে, ম্যাচটা ক্ষণে ক্ষণে হাত থেকে ফসকে যাচ্ছে। কাপ্তানের দেহে বিন্দু ঘামের সৃজন, কোচের কপালে ভাঁজ। ড্রেসিংরুমে ছটফট, স্টেডিয়াম চত্বরে বসা সমর্থকদের উদ্বেগ, পর্দা আর টিভি সেটের সামনে নিষ্পলক তাকিয়ে অসংখ্য চোখ, মনে প্রার্থনা কী হয় কী হয়, কী হবে হায়? কিংবা ব্যাটিংয়ে নেমে প্রতিপক্ষের গোপন কৌশলে হঠাৎ-ই হোঁচট; তীব্র গতির অগ্নিগোলার আঘাতে বা মায়াবি স্পিনের নীল বিষে মুহূর্তে ধ্বংসস্তূপ ব্যাটিং অর্ডার। কী হবে এবার, কে আছে আর? তবে কি তীরে এসে তরী ডুবতে চলেছে? জাতীয় কবি নজরুলের ভাষ্যে—
'দুলিতেছে তরী ফুলিতেছে জল ভুলিতেছে মাঝি পথ,
ছিঁড়িয়াছে পাল, কে ধরিবে হাল, আছে কার হিম্মত!'
সবার আস্থা তখন শুধুই ওই রাজকুমারে। ওই তো আসছে সে হেলে-দুলে, গ্যালারি মুখরিত তার মাতমে; ‘সাকিব সাকিব’ স্লোগানে। অতঃপর তার বাঁ হাতের মায়াবি ঘূর্ণি বিভ্রমে হতবিহ্বল সবে; ব্যাটসম্যান সাজঘরের পথে। ব্যাট হাতেও থাকেন অনবদ্য ভূমিকায়। দেখিয়ে দেন তার সক্ষমতা, বুঝিয়ে দেন নিজের নামটার মাহাত্ম্য! কখনো পথ খুঁজে পান কাউন্টার অ্যাটাকে, তখন বলকে সিদ্ধহস্তে পাঠিয়ে দেন সীমানার ওপারে। কখনো আবার দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে যান বাধা রুখতে; তীব্র স্রোতের বিপরীতে হয়ে উঠেন এক দুর্ভেদ্য প্রাচীর।
হারারে হতে যেই রূপ রোববার আবারো দেখেছে বিশ্ব। আরো একবার ত্রাতা হয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট নামক রাজকুমারীকে উদ্ধার করতে তীর-ধনুক আর তরবারি রূপক ব্যাট আর বল হাতে ওই রাজকুমারের ভূমিকায় সাকিব। ঠান্ডা মাথার এমন লড়াকু সাকিবকে এর আগে কোথায়, কতবার দেখেছে বিশ্ব। একপাশে ধ্স নামলেও অপর প্রান্তে চীনের প্রাচীর হয়ে যেন দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। যদিও মাত্র ৪ রানের জন্য শতকের স্বীকৃতি মেলেনি, কিন্তু তৃপ্ত দেশবাসী সবে, সাকিবও তৃপ্ত নিঃসন্দেহে। কারণ সাকিব এমনি। তার কাছে সেঞ্চুরি হতে পরিস্থিতি অনুপাতে তীব্র প্রয়োজনে খেলা ইনিংসটাই বরাবরই প্রিয় হয়েছে।
৯৬* রান করার পথে তিনি যদিও ছুটেছেন নিজের মতো করে, তাতে কি আর রেকর্ড বসে থাকে? তিনি ছুটেছেন আর ইতিহাসের পাতা উল্টেছে। যাতে লেখা হয়েছে নতুন সব কীর্তি, সংযোজন নতুন অর্জন। এই যেমন, জ্যাক ক্যালিসের পর দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১২০০০ রান এবং ৫০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ সাকিব আল হাসানের। আর তা এসেছে জ্যাক ক্যালিস থেকে ৭২ ম্যাচ কম সময়ে; মাত্র ২১৪ ম্যাচে। তবে আরো অসংখ্য রেকর্ড তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে, সময় হলেই না হয় তা প্রকাশ পাবে।
নিষেধাজ্ঞা পরবর্তী খারাপ সময়ে, ব্যর্থতার গ্লানিতে ক্লান্ত সবে, সমালোচনায় মুখর চারপাশ; তখন নার্ভ ধরে রেখে, হঠাৎই ধস নামা দলের এই ক্রান্তিলগ্নে শক্তহাতে দৃঢ় প্রত্যয়ী মনোভাবে যেভাবে আগলে রেখে দলকে জয়ের স্বাদ পাইয়েছেন কাল তা নিঃসন্দেহে স্যালুট যোগ্যই বটে। তবে সব কিছু দূরে রেখে একটা শিক্ষা পেলাম মনে, ‘সেরারা সঠিক সময়ে সেরাটা দিয়ে স্ব-রূপে জ্বলে উঠে, ওরা ফিরে আসে সেরা মঞ্চ তৈরী করে।'