যুক্তরাষ্ট্রের আরেক পরাজয়
যুক্তরাষ্ট্রের আরেক পরাজয় - ছবি সংগৃহীত
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার স্থল, নৌ ও বিমানসেনা এবং ন্যাটোর অধীন বহুজাতিক বাহিনী নিয়ে ২০০১ সালে আফগানিস্তানে ঝাঁপিয়ে পড়ে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’-এ ঠুনকো অজুহাতে। আমিরুল মুমিনিন মোল্লা ওমরের সরকারকে উৎখাত করে কাবুল দখল করে নেয়। সরকার থেকে উৎখাত হলেও তালেবানরা মাটি ও মানুষ থেকে উৎখাত হয়নি। জনগণকে সাথে নিয়ে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে। মার্কিন বাহিনী ও ন্যাটো ২০ বছর সর্বাত্মক যুদ্ধ করেও তালেবানের পরাজিত করা তো দূরের কথা, নিজেরাই হেরে গেল। পাকিস্তানের মধ্যস্থতায় কাতারে তালেবানের সাথে চুক্তি করে ৩১ আগস্টের মধ্যে সব সেনা আফগানিস্তান থেকে সরিয়ে নেয়ার চুক্তি করে মার্কিন প্রশাসন। তারই অংশ হিসেবে ২ জুলাই মধ্য এশিয়ার বৃহত্তর বাগরাম ঘাঁটি ছেড়ে চলে গেছে মার্কিন সেনারা। আলো নিভিয়ে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীকে না জানিয়ে অরক্ষিত অবস্থায় গভীর রাতে তারা ঘাঁটি ত্যাগ করে। ২০ বছরের যুদ্ধে আমেরিকা মূলত পরাজিত হয়েছে। তাদের প্রাপ্তি বেশি নেই, বরং ক্ষয় ও লয়ের তালিকা দীর্ঘ। বিজনেস ইনসাইডারের প্রতিবেদন মতে, দীর্ঘস্থায়ী আফগান যুদ্ধে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর খরচ হয়েছে ২.২৬ ট্রিলিয়ন ডলার। প্রাণ হারিয়েছে দুই হাজার ৫০০ সেনাসদস্য। আহত হয়েছে প্রায় ২০ হাজার। উপরন্তু এ যুদ্ধে এখন পর্যন্ত আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে ২ লাখ ৪১ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে।
ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় পরাজয়ের দুঃসহ স্মৃতির সাথে যুক্ত হলো আফগান ট্র্যাজেডি। ১৯৬৫-১৯৭৫ সালের মধ্যে ৫৮ হাজার ৩০০ মার্কিন সেনা ভিয়েতনামে মারা যাওয়ার পরও যুক্তরাষ্ট্রের বিদেশনীতিতে পরিবর্তন আসেনি। সরকার পরিবর্তন হলেও পরদেশে আগ্রাসন, গুপ্তহত্যা, সরকার উৎখাত ইত্যাদি কর্মকাণ্ড অব্যাহত রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ক্ষেপণাস্ত্র সরানোর পরিকল্পনা নিয়েছে পেন্টাগন। বিদেশী কূটনীতিক, তাদের পরিবার ও এনজিও কর্মীদের নিরাপত্তার জন্য ৭০০ সেনা কাবুলে রাখতে চেয়েছিল মার্কিন প্রশাসন কিন্তু তালেবানরা এতে সম্মত হয়নি। একদিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, পাকিস্তানের ভূখণ্ডে আমেরিকাকে কোনো ঘাঁটি করতে দেয়া হবে না। বারাক ওবামার আমলে ইসলামাবাদের সহায়তায় মার্কিন সেনারা খায়বার পাখতুনখা প্রদেশের ওয়াজিরিস্তানের পার্বত্যাঞ্চলে বিমান ও ড্রোন হামলা চালিয়ে তিন হাজার তালেবানসহ সামরিক ও বেসামারিক ৬৫ হাজার নাগরিককে হত্যা করে। এতে চার লাখ ৭০ হাজার বেসামরিক নাগরিক বাস্তুহারা হয়। এক লাখ উদ্বাস্তু আফগানিস্তানের খোস্ত প্রদেশে ঢুকে পড়ে। পাকিস্তানের সাথে তালেবানের সম্পর্ক আগে থেকেই মজবুত। অপরদিকে ইরান ও তালেবানের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলছে চীন। দীর্ঘ রেললাইন স্থাপনসহ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের অফার রয়েছে চীনের হাতে। খনিজ সম্পদ উত্তোলনে চীনের সাথে আফগানিস্তানের বেশ ক’টি চুক্তি আছে। চীন সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে। তালেবান যে চীনের বন্ধু হয়ে উঠবে, সেটাই স্বাভাবিক। আফগানিস্তান থেকে চলে আসার পেছনেও মার্কিনিদের অন্য পরিকল্পনা রয়েছে নিশ্চয়ই। আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, আমেরিকা এখন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে মনোযোগ নিবদ্ধ করতে পারে।
৩০ বছরের যুদ্ধে আফগানিস্তান প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে, অবকাঠামো ভেঙে পড়েছে। ব্যবসায়-বাণিজ্য, আমদানি-রফতানি, শিল্প-কারখানা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সব বন্ধ। এটি বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশে পরিণত হয়েছে। এডিবির তথ্য মতে, ৫৪.৪ শতাংশ আফগান দরিদ্র। প্রায় পৌনে চার কোটি মানুষের এই দেশে এখনো দৈনিক যাদের আয় ১ দশমিক ৯ ডলারের মতো। জাতিসঙ্ঘ শরণার্থী সংস্থার হিসাব মতে, চলতি সালে দেশটিতে দুই লাখ ৭০ হাজার মানুষ নতুন করে বাস্তুহারা হয়েছে। ৩৫ লাখ মানুষ এখন গৃহহীন। গত বছরের তুলনায় এ বছর বেসামরিক মানুষের মৃত্যু ২৯ শতাংশ বেড়েছে। আফগানিস্তান এখন মানবিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি। আশার খবর হচ্ছে, দেশটিতে যদি রাজনৈতিক অস্থিরতার অবসান ঘটে এবং সামাজিক শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা ফিরে আসে তবে তিন ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের উত্তোলনযোগ্য যে পরিমাণ প্রাকৃতিক সম্পদ রয়েছে এগুলোর প্রযুক্তিভিত্তিক সদ্ব্যবহার করা গেলে আফগানিস্তান অর্থনৈতিকভাবে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হবে। খনিজ সম্পদ আফগান অর্থনীতির মেরুদণ্ডে পরিণত হতে পারে আগামী দিনগুলোতে।