তালেবান যে কারণে অপ্রতিরোধ্য

তালেবান প্রতিনিধিদল - ছবি সংগৃহীত
সামাজিক শক্তিই হচ্ছে তালেবানের সাফল্য ও অগ্রযাত্রার অন্যতম নিউক্লিয়াস। মসজিদ, মাদরাসা, খানকা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত তালেবানের অপ্রতিহত প্রভাব আছে সমাজের ওপর। আফগান সমাজের নারী-পুরুষ নিজস্ব ঐতিহ্য ও শরিয়তি বিধি-বিধান মেনে চলতে অভ্যস্ত। পশতু, তাজিক, হাজারা ও উজবেক জনগোষ্ঠী নিয়ে আফগান রাষ্ট্র গঠিত হলেও বিদেশী আগ্রাসী শক্তির প্রতিরোধে সবাই এক ও একতাবদ্ধ। ৯৯ শতাংশ মুসলমানের সবাই সুন্নি ও হানাফি মাজহাবের অনুসারী। তালেবানের বৃহত্তর অংশ দেওবন্দি ধারার মাদরাসায় শিক্ষাপ্রাপ্ত। গোত্রসর্দারদের কওমচেতনা (আসাবিয়াহ) ও চার লক্ষাধিক তালেবানের শক্তিমত্তার সমন্বয়ের ফলে এক অপ্রতিরোধ্য বিক্রম ও তেজস্বীতার জন্ম হয়েছে দেশটিতে।
আফগানিস্তান প্রাচীনকাল থেকেই এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। বহিরাক্রমণে এই দেশটি বারবার ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। সুপ্রাচীন কাল থেকে বহু বাণিজ্য কাফেলা আফগানিস্তানের ভেতর দিয়ে চলাচল করেছে এবং এদের মধ্যে কেউ কেউ এখানে বসতি স্থাপন করেছেন। জাতিগত ও ভাষাগত বৈচিত্র্য এই দেশের বৈশিষ্ট্য। ইতিহাস সাক্ষী, আফগান জনগণ বংশ পরম্পরায় বৈদেশিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছে। মহাবীর আলেকজান্ডার, ব্রিটিশ রাজকীয় বাহিনী, সোভিয়েত ইউনিয়ন সর্বশেষ ন্যাটো ও মার্কিন বাহিনী আফগানিস্তান দখল করে বেশি দিন ধরে রাখতে পারেনি। নিজ নিজ দেশে ফেরত যেতে বাধ্য হয়েছে ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে। রেখে গেছে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ও অনেক বেদনার স্মৃতিচিহ্ন। ১৮৪২ সালে প্রথম অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জন ডা. উইলিয়াম ব্রাইডনের ডায়েরি থেকে জানা যায়, চার হাজার ৫০০ সেনাসদস্য ও ১২ হাজারের মতো কর্মচারীর লাশ আফগানিস্তানে রেখে ব্রিটিশ বাহিনীকে কাবুল থেকে ১৪০ কিলোমিটার দূরে জালালাবাদ গ্যারিসনে ফিরে আসতে হয়। ডা. ব্রাইডন ছিলেন একমাত্র জীবিত সদস্য। বাকিগুলো বরফাচ্ছাদিত পার্বত্য গিরিপথে আফগান গেরিলাদের হাতে প্রাণ হারায়। তালেবান যোদ্ধারা ৩০ বছর লড়াই করেছে দুই পরাশক্তির আগ্রাসন মোকাবিলায়। ১০ বছর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ২০ বছর যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোভুক্ত ৩৬টি দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে তারা। কত তালেবান শহীদ হয়েছেন তার নির্ভরযোগ্য তথ্য না থাকলেও বিশ্লেষকদের অনুমান, তাদের সংখ্যা প্রায় ৫১ হাজারেরও বেশি। ১৯৭৯-৮৯ পর্যন্ত ১০ বছরে ১৫ হাজার সোভিয়েত সেনা তালেবানের হাতে প্রাণ হারিয়েছে এবং আহত হয়েছে ৩৫ হাজার সেনাসদস্য।
২০০৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থার তথ্যমতে, উত্তর আফগানিস্তানে গড়ে ২৯০ শত কোটি ব্যারেল অপরিশোধিত খনিজ তেল ও ১৫.৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদ আছে। আফগানিস্তানে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে লিথিয়াম রয়েছে। এ ছাড়াও দেশটিতে তামা, সোনা, কয়লা, লোহার আকরিক এবং অন্যান্য খনিজ পদার্থ রয়েছে। হেলমান্দ প্রদেশের খানাশিন এলাকার কার্বোনাটাইট শিলাতে এক কোটি টনের মতো দুর্লভ ধাতু রয়েছে। আফগানিস্তানের সরকারি কর্মকর্তারা অনুমান করেন, দেশটির ৩০ শতাংশ অব্যবহৃত খনিজ সম্পদের মূল্য কমপক্ষে এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার।
আফগানিস্তান থেকে বিদেশী সেনার বিদায় একটি বার্তা দিচ্ছে, তা হলো- আগ্রাসী শক্তি যতই প্রযুক্তিনির্ভর হোক, পরমাণুশক্তির মালিক হোক, সাহসী প্রতিরোধযোদ্ধাদের সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা, মানসিক প্রতাপ ও বিক্রম তাদের থাকে না। বন্দুকের জোরে কোনো দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি পাল্টে দেয়া সম্ভব নয়। তালেবানের বিজয় দেশে দেশে প্রতিরোধযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করবে। জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে স্থিতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত আক্রমণের ফলে পাকিস্তানে আশ্রিত বাস্তুহারা ৩০ লাখ ও ইরানে আশ্রিত ১৫ লাখ আফগান শরণার্থী স্বদেশে ফিরে জাতি পুনর্গঠনে অবদান রাখতে সক্ষম হবে।