তালেবান কেন তুরস্কের উপস্থিতি চাচ্ছে না?
তালেবান কেন তুরস্কের উপস্থিতি চাচ্ছে না? - ছবি সংগৃহীত
আফগানিস্তান থেকে পাশ্চাত্যের সৈন্য প্রত্যাহারের পর কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব তুরস্ককে দিতে চেয়েছিল ন্যাটো। তুরস্ক তেমন কোনো আপত্তি না করে কিছু শর্ত জুড়ে দেয়। আর এতেই তালেবানের সাথে তুরস্কের বিরোধ প্রকাশ্যে আসতে থাকে। মুসলিম দেশ হয়েও তুরস্ক ন্যাটোর সদস্য। মুসলিম দেশগুলোতে পশ্চিমাসহ আমেরিকার করা সকল অন্যায় যা বিগত ঠাণ্ডা যুদ্ধের পর থেকে তাড়া করে আসছে। তাদের কোথাও সহযোগিতা যেমন করেছে, তেমনি কোথাও নীরব দর্শকের ভূমিকা নিয়েছে মুসলিম বিশ্বের শেষ খেলাফতের উত্তরাধিকার দেশটি।
তালেবানের সাথে তুরস্কের বিরোধ আজকের নয়। সেই তালেবান আন্দোলনের শুরু থেকেই চলমান। গৃহযুদ্ধের ধ্বংসস্তুপের উপর তালেবান যখন কাবুলের ক্ষমতা দখল করে, তখন থেকে। তখন উত্তর আফগানিস্তানে জেনারেল রশিদ দোস্তামের নেতৃত্বে নর্দার্ন এলায়েন্স বেশ কিছু দিন শক্ত অবস্থানে টিকে ছিল। যার পিছনে তুরস্কের বিরাট অবদান ছিল বলে মনে করা হয় । আল কায়েদার প্রত্যক্ষ সহযোগিতা নিয়ে তালেবান যখন নর্দার্ন এলায়েন্সকে পরাজিত করে, তখন জেনারেল দোস্তম তুরস্কে গিয়ে আশ্রয় নেন। সাম্প্রতিক সময়ে দোস্তমের জেলা তালেবান দখলে নিলে দোস্তম আবার তুরস্কে পালিয়ে যান। এখনো সেখানে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদায় অবস্থান করছে। ২০০১ সালে আমেরিকান আগ্রাসনের প্রাক্কালে দেশে ফিরে নর্দার্ন এলায়েন্সকে সংগঠিত করে তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করতে, স্থল অভিযানে আমেরিকার গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ছিল এই তালেবানবিদ্বেষী জেনারেল। ওই সময়ে পশতুনদের উপর গণহত্যার নেতৃত্ব দেন এই কুখ্যাত ওয়ারলর্ড। যার বিরুদ্ধে নিজের স্ত্রীকে হত্যাসহ যুদ্ধাপরাধের অসংখ্য অভিযোগ পাওয়া যায়। এর মধ্যে তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের গুম, হত্যা, শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগও রয়েছে। বিচারের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কায় তিনি ২০০৮ সালে আবার তুরস্কে পালিয়ে যায়। পরে তাকে এসব অভিযোগ থেকে দায়মুক্তি দিয়ে আশরাফ গনি সরকারের ভাইস প্রেসিডেন্ট করা হয়। জাতিতে উজবেক এবং প্যান তুর্কিজমের একনিষ্ঠ সমর্থক হওয়ায় তুরস্ক তাকে কখনো সঙ্গহীন করেনি।
আধুনিক তুরস্কের জন্মই হয় তুর্কি জাতীয়তাবাদ চেতনাকে পুঁজি করে।এছাড়া তুরস্কের কিছু পলিসি রয়েছে যা সব ক্ষমতাসীন সরকার মেনে চলার চেষ্টা করে।
⛔ আমেরিকা এবং রাশিয়ার সাথে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখা।
⛔ গ্রিসকে চিরশত্রু আর পাকিস্তানকে পরমবন্ধু জ্ঞান করা।
⛔ বিশ্বব্যাপি তুর্কি জাতির স্বার্থ রক্ষা করা।
⛔ তুর্কি বলয়ের রাষ্ট্রগুলোর উপর নিজের প্রভাব, কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা।
সর্বশেষ এরদোয়ান এই তালিকায় যুক্ত করে সৌদি নেতৃত্ববিমুখ মুসলিম অধ্যুষিত সুন্নি দেশগুলোর উপর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রভাব বিস্তার করে তুরস্ককে নেতৃত্বের আসনে প্রতিষ্ঠিত করা।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, আফগানিস্তানের পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে আঙ্কারা কিভাবে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে?
প্রথমত বলা যায়, রাশিয়ার সাথে অতি মাখামাখিতে পশ্চিমাসহ আমেরিকার সাথে সম্পর্কের যে ফাটল ধরেছে। তা মেরামত করার জন্য এরদোগান আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিকে কাজে লাগাতে চাচ্ছে ন। বিশেষ করে এস-৪০০ মিসাইল সিস্টেম ক্রয় এবং সিরিয়া যুদ্ধে রাশিয়ার নেতৃত্বে ৪+১ (রাশিয়া ইরান ইরাক+হিজবুল্লাহ) জোটের সাথে আইএসসহ কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টিকে দমনে আমেরিকাসহ পশ্চিমাদের সাথে সিরিয়া ইস্যুতে বিরোধে জড়িয়ে পড়ে। যার কারণে আমেরিকা অর্থনৈতিক অবরোধসহ এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান প্রকল্প থেকে তুরস্কের অংশীদার বাতিল করে। অর্থনৈতিক অবরোধে লিরার মান অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে ডলারের বিপরীতে। যা দেশের অর্থনৈতিক অর্জনগুলোকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। ডলারের পরিবর্তে লিরার মান আশঙ্কাজনক কমে যাওয়ায় অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে এরদোগানকে বিরোধীদের সমালোচনার মুখে ফেলেছে।
এছাড়া কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টিকে কালো তালিকাভুক্ত করে এরদোগানের অফেন্সিভ ওয়াশিংটন ভালোভাবে নেয়নি। কারণ ওয়াশিংটন পিকেকে সন্ত্রাসী সংগঠন মনে করে না।
সম্পর্কে এই টানাপোড়ন বাইডেন প্রশাসনের সাথে কমাতেই মূলত এরদোগান আফগানিস্তানে কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে আগ্রহী। যদিও তুরস্কের দেয়া শর্ত আমেরিকার মেনে নেবে এমন আলামতের কোনো সম্ভাবনা নেই। তবুও একে কেন্দ্র করে ন্যাটো সম্মেলনে বাইডেন প্রশাসনের সাথে ইতিবাচক সম্পর্কের যাত্রা শুরু করলেন এরদোগান।
দ্বিতীয় কারণটি তুরস্ক নিজেকে তুর্কি জাতির অভিভাবক মনে করে। যেমনটি ইরান নিজেকে মনে করে শিয়া জনগোষ্ঠীর অভিভাবক। আফগানিস্তানের ১০ শতাংশ জনগণ উজবেক। এদের ভাষাও তুর্কি। যাদের ভৌগোলিক অবস্থান উত্তর আফগানিস্তানে জেল গুলোতে। এছাড়াও উল্লেখ্যযোগ্য তুর্কমেন রয়েছে তুর্কমেনিস্তান সীমান্ত এলাকায়। আছে তুর্কি জনগোষ্ঠীর তাজিকরা। যারা আফগানিস্তানের জনসংখ্যায় প্রায় ১৫-২০ শতাংশ।
তালেবান যেহেতু বিদেশি সেনাপ্রত্যাহারের প্রথম দিকেই উত্তরাঞ্চলের দখল নিতে সক্ষম হয়েছে। তাই ভবিষ্যত তালেবান সরকারে উজবেক, তাজিকদের ক্ষমতা কতটুকু সংরক্ষণ থাকবে তা নিয়ে তুরস্কের দুশ্চিন্তার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। যদিও তালেবান বলছে, সরকার কাঠামোয় সব পক্ষের অংশগ্রহণ তারা নিশ্চিত করবে। কিন্ত প্রশ্ন হলো, তুরস্কের পরম মিত্র কুখ্যাত ওয়ারলর্ড রশিদ দোস্তমের কপালে কী জুটবে?
এছাড়া তালেবান ক্ষমতা গ্রহণে মধ্য এশিয়ায় তালেবান সরকারের আসন্ন বিপ্লব কী রকম প্রভাব ফেলবে তা নিয়েও তুরস্কের ভাবতে হবে। বর্তমান সরকারগুলো গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত এবং রাশিয়ামুখী হলেও তুরস্কের সাথেও যথেষ্ট ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলে। উজবেকিস্তানে হিজাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী। অর্থাৎ তালেবান ক্ষমতা গ্রহণে সফল হলে এসব দেশে তার প্রভাব অল্পবিস্তর পড়বে তা অনুমান করাই যায়। সরকারগুলোকে ধর্মীয় ব্যাপারে আরো ছাড় দিতে হবে। এছাড়া এইসব দেশের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর ব্যাপারে তালেবান কী রকম নীতি মেনে চলবে- এরকম বহু প্রশ্ন সামনে আসবে।
মডারেট ইসলাম বনাম ট্রাডিশনাল ইসলাম
খেলাফত পতনের পর দীর্ঘসময় তুরস্ক কামালিজমের সংস্কারের মাধ্যমে উগ্র-সেকুলার চিন্তাধারায় প্রভাবিত ছিল। যেখানে আরবিতে আজান দেয়াও নিষিদ্ধ ছিল। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও দীর্ঘদিন নানা অজুহাতে দমন-পীড়নের শিকার হয়েছে। এর প্রভাব তুর্কি জনসাধারণের ওপর যথেষ্ট রয়েছে। যদিও এরদোগান সেকুলার রাষ্ট্রকাঠামোর ভিতর থেকেই আমূল পরিবর্তনের দিকে অগ্রসর হয়েছেন ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই। যার ফলে তুরস্কে মডার্নিস্ট ইসলামি ভাবধারা বেশ শক্তিশালী হয়েছে। যার সাথে তালেবানের ট্রাডিশনাল ইসলামের বিরোধ রয়েছে। বিশেষ করে আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে মডারেট ও ট্রাডিশনাল ইসলামের বিরোধ রয়েছে। যা তালেবান ক্ষমতা গ্রহণে সফল হলে সামনের দিনগুলোতে আরো স্পষ্ট হবে।
আধুনিক ইসলামি রাষ্টচিন্তায় এর প্রভাব পড়বে এবং নেতৃত্বে প্রশ্নে তখন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো তিন ভাগে বিভক্তের শিকার হবে সৌদি নেতৃত্বে রাজতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা, তুরস্কের গণতান্ত্রিক ইসলামিক রাষ্ট্র কাঠামো আর তালেবান কর্তৃক ইসলামি ইমারাহ সরকার কাঠামো।
এইসব দিক বিবেচনায় তুরস্কের প্রয়োজন তালেবান সরকার কাঠামোয় নিজ প্রভাব বলয়ের কাউকে প্রবেশ করিয়ে ক্ষমতায় ভাগ বসানো, যাতে আফগানিস্তানে এককভাবে পাকিস্তান, চীন, রাশিয়ার প্রভাবের সাথে তুরস্কের কিছুটা অংশগ্রহণ থাকে। ন্যাটো সদস্য হিসেবে তুরস্কের এই কার্যকলাপ চীন ও রাশিয়া ভালোভাবে না নিলেও যুক্তরাষ্ট্রের এতে তেমন মাথাব্যথা নেই। আর তা দেশটির পুনর্গঠনে তুরস্কের বিনিয়োগে বিশেষ সুযোগ সুবিধা আদায়ে অবদান রাখবে।
কিন্তু সমস্যা হলো, তুরস্কের তালেবাননীতি যথেষ্ট নমনীয় পরিলক্ষিত হচ্ছে না, যেখানে চীন, রাশিয়া, ইরান তালেবানকে সমীহ করছে দেশটটির ভবিষ্যত সরকার গঠনে অপ্রতিদ্বন্দ্বী একক শক্তি মনে করছে। সেখানে তুরস্কের কাবুলপ্রীতি যেন কোনোমতেই কমছে না।
যেখানে রাশিয়া, চীন কোনো রাখঢাক ছাড়াই একাধিকবার তালেবান প্রতিনিধিদের আলোচনায় আমন্ত্রণ জানাচ্ছে, দেশের ভবিষ্যত কর্মপন্থায় তালেবানের সম্ভাব্য কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করছে, সেখানে তুরস্ককে তালেবানের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে এখনো তেমন কোন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। উল্টো কাবুল সরকারে বিভিন্ন প্রতিনিধিসহ গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথেই আঙ্কারার মনোযোগ বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যদিও অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা চলছে তালেবানের বিভিন্ন প্রতিনিধির সাথে। কিন্তু তা নিয়ে তালেবান যথেষ্ট নাখোশ। তারা দাবি করছে, আঙ্কারার উচিত রাষ্ট্রীয় প্রটোকলে আলোচনা করা। কারণ আফগানিস্তানের ভবিষ্যত শুধুই তালেবান, অন্যপক্ষের কোনো সম্ভাবনা তারা মেনে নেবে না।
তথ্যসূত্র
নিউজউইক, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ফরেন পলিসি ম্যাগাজিন, ওয়ার্ল্ড এথনিক রাইটস সোসাইটি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, রোর বাংলা
লেখক : শিক্ষার্থী, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
merajislam920@gmail.com