চীনের এশিয়া মিশন
চীনা প্রেসিডেন্ট - ছবি সংগৃহীত
মধ্য এশিয়ায় দেশ উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দ। এই তাসখন্দে গত ১৫-১৬ জুলাই এক বিশাল সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। সম্মেলনের নেপথ্যে ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন আর সামনে তাসখন্দ; যারা চেয়েছিল এশিয়ায় আফগানিস্তানের পরিবর্তনকে সামনে রেখে একটা আঞ্চলিক সম্মেলন। ‘মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া : আঞ্চলিক যোগাযোগ, চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক দু’দিনের এই আন্তর্জাতিক সম্মেলন গত বৃহস্পতিবার শুরু হয়েছে, এতে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড: একে আবদুল মোমেন। উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গানি আর বাংলাদেশ, ভারত ও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ প্রায় ৪০ দেশের প্রতিনিধি এতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এসব কিছুকে ছাপিয়ে আমাদের মিডিয়ায় যা হেডলাইন সেদিক তাকিয়ে যদি বলি তা হলো- ওই সম্মেলনের সাইড লাইনে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চীন ও ভারতের সাথে বৈঠকের খবর। যেমন কেউ শিরোনাম করেছেন ‘একই দিনে ভারত-চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে মোমেন’।
সাইড লাইনের আলাপ মুখ্য- এমন হওয়ার পেছনে অন্য কারণও ছিল। যেমন- গত কয়েক দিন ধরে দেশে আরেকটা খবর খুব আলোচ্য হয়ে উঠেছিল। যেমন বাংলা ভয়েজ অন আমেরিকায় ছাপানো এক রিপোর্ট- ‘বিকল্প সার্ক গঠন করতে উৎসাহী চীন’ অথবা টাইমস অব ইন্ডিয়ার তাদের ঈর্ষায় চোখ টাটানো ও আক্ষেপ করা নিউজ : ‘চীনা-সাউথ এশিয়ান টিকা কূটনীতির জোটের পরে এখন চীন দারিদ্র্য দূরীকরণের ‘উন্নয়ন কেন্দ্র’ আনতে চায়।’ উপরের এ দুই রিপোর্টে এরা আকার-ইঙ্গিতে বলেছে যে, চীনের নেতৃত্বে ভারতকে বাদ রেখে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও আফগানিস্তানকে নিয়ে এই জোট হতে যাচ্ছে যাকে কেউ চীনের ‘উন্নয়ন সেন্টার’ গঠন করা বলছেন।
এমনিতে বিভিন্ন সময় নানান আঞ্চলিক জোট গঠন হতে আমরা দেখে থাকি। সেসবের মধ্যে বাস্তবে খুবই সচল হতে দেখা যায় অল্প কিছু উদ্যোগকেই; বিশেষ করে যেখানে কিছু গঠন-শর্ত মেনে চলা হয়। যেমন জোটে একটা বড় অর্থনীতির দেশ, সাথে যার বিনিয়োগ দেয়ার ক্ষমতা থাকা অন্তত একটা দেশ থাকতে হয়। আর মেনে নিতে হয় এই জোটে সদস্য দেশগুলো যোগ দেবে তখনই যখন ছোট-বড় প্রত্যেকেরই বাণিজ্যিক লাভালাভের দিকটা খেয়াল রেখে তা সাজানো হবে। আর এমনটা বাস্তব করতে পারার কমন ফর্মুলা হলো- বড় অর্থনীতির দেশ বলতে ধরা যাক চীন যার অন্যকে শেয়ার দেয়ার মতো নিজের বড় বাজার (জনসংখ্যা ১৪৩ কোটি) আছে আর সাথে আছে অন্যকে বিপুল বিনিয়োগ দেবার সক্ষমতা- অবকাঠামো আর ‘ডাইরেক্ট বিদেশী শিল্প বিনিয়োগ’- দুটিই। ফলে শুরুতে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত ছোট অর্থনীতির সদস্য দেশগুলো চীনে রফতানির সুযোগ পাবে, সাথে চীনা বিনিয়োগও পাবে।
এতে পরের দিকে ক্রমশ হাই-এন্ড বা হাইটেকের পণ্য চীন থেকে আমদানি আর লো-এন্ড বা লো-টেক পণ্য চীনে রফতানি এই ভিত্তিতে ওই জোটের মধ্যে খুবই সক্রিয় একটা উভয়মুখী বাণিজ্য চালু হতে দেখা যেতে পারে। পরিকল্পনা মাফিক চললে, মূলকথা- সবারই এতে কিছু লাভের দিক থাকতে হবে যেদিকে খেয়াল রাখতে হবে; মানে সুযোগ পেলে অল্পতেই ‘লোভী’ হয়ে ওঠা যাবে না; লং টার্ম ভাবতে হবে। আর তাহলেই এটি মূলত এক গ্লোবাল বাণিজ্যের আঞ্চলিক ভার্সন হয়ে উঠতে পারে। ফলে এখানে অন্যকে বাজার যেমন ছাড়তে হবে তেমনি আবার অন্যের বাজারে ঢুকার সুযোগও নেয়া যাবে। এককথায় সবাইকেই নিজ নিজ বাজার অন্যের সাথে শেয়ার করতে রেডি থাকতে হবে। তাই নিয়মিত প্রচুর কথা বলতে হবে, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ম্যানেজমেন্ট ক্ষমতার কমিটি ও উপযুক্ত প্রফেশনাল লোকজন থাকতে হবে, যাদের সদস্য-দেশ পরস্পরের সুবিধা-অসুবিধার সমাধান করে দেয়ার রাস্তা বের করার যোগ্যতা থাকতে হবে। কোনোভাবে কোথাও একপক্ষীয় লাভের কথা ভেবে থাকলে এমন জোট দাঁড়াবেই না। আর বলাই বাহুল্য, জাতিবাদী রক্ষণশীল অর্থনীতির কোনো দেশ এর সদস্য থাকতে পারবে না। মানে ‘আমার সব ভোগ্যপণ্য আমি নিজেই উৎপাদন করে নেবো’ বা ‘বিদেশী পণ্য হারাম’ ধরনের জাতবাদী চিন্তা এখানে মনের গোপনে পুষে রাখাও নিষিদ্ধ। বরং বাজার দেবো আর বাজার নেবো- এটাই হবে এর নীতি।
ভারত অপ্রয়োজনীয়ভাবে নিজ বাজার সংরক্ষণবাদী এমন পুরনো চিন্তার কট্টর জাতিবাদী দেশ। আসলে এই জাতিবাদী চিন্তাটাই বলছে, ‘আমি কোনো বাণিজ্য জোটে বিশ্বাসী নই।’ কিন্তু ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারও বড় (১৩০ কোটির), তাই ভারত নিজের এই ১৩০ কোটির লোভ দেখিয়ে জোটে ঢুকতে চেয়ে থাকে। আর ভেতরে ঢুকে সে চেষ্টা করতে থাকে কেবল অন্যদের থেকে বাজার সুবিধা নিতে। এ কারণে ভারত যে জোটে থাকে সে জোট ক্রমশ নিষ্ক্রিয় হবেই। এর বিপরীতে এখনকার চীন বিকশিত বলে এর দেয়ার মতো সুবিধা ও সক্ষমতা বেশি। এটা চীনের উদারতা বলে বোঝা ভুল হবে, বরং এটা ওর অর্থনীতির শক্তি ও সক্ষমতা। সে অবলীলায় আমাদের মতো দেশকে বাজার ছাড় দিতে পারে, বিনিয়োগও দিতে পারে। এ ছাড়া ভ্যালু-অ্যাডিশন শেয়ার প্রডাক্টও- মানে সব সদস্যই কিছু শ্রম জোগাবে এমন শেয়ার করা ভ্যালু বা শ্রমে উৎপাদিত পণ্য- এমন উৎপাদন সম্পর্কও চালু করতে চীন সক্ষম। আর চীনের সে অফারের সুবিধা নিয়ে সবাই বাজারে প্রবেশ করতে চাইলে তাতে চীনসহ সবারই লাভ বলে তা দিতে আগ্রহী হয়।
টাইমস অব ইন্ডিয়া চীনের এই জোট বা ‘উন্নয়ন কেন্দ্র’ গঠনের ব্যাপারটিকে মুখস্তের মতো পাল্টা ‘ভারতের সবই ভালো বা আমরাই শ্রেষ্ঠ বা আমরা বিরাট কিছু’- টাইপের মন্তব্য ঢুকিয়েছে তাদের রিপোর্টে। যেমন সে লিখেছে ‘এই অঞ্চলে ভারতীয় আধিপত্য আছে’। চীন সেটা নষ্ট করতেই এ কাজে এসেছে। এ ছাড়া আরো বলেছে, ভারত এই ছয় দেশের সবার সাথে আগে থেকেই ‘টপ উন্নয়ন পার্টনার হয়েই আছে’। ফলে ভারত তাদেরকে ‘বিপুল অনুদান’ তো বটেই সাথে অবকাঠামো ‘সফট লোনও’ দিয়ে থাকে। এরা এমনই স্বপ্নের পোলাও খাওয়া লোক, এরা খেতে থাকুক্ অসুবিধা কী! কিন্তু বাস্তবত ভারতের না নিজ বাজার ছাড় দেয়ার সক্ষমতা আছে, না অবকাঠামো ঋণ বা বিনিয়োগ দেয়ার সক্ষমতা। বরং বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা বলছে, সে আমেরিকার কোলে চড়ে বসে ওয়্যার অন টেররের উসিলায় আর সর্বোপরি, আমেরিকার ‘চায়না ঠেকানো’ ঠিকা নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। এই সুযোগে সে বিনা পয়সায় সমস্ত করিডোর সুবিধা ভোগ করা শুরু করেছে। আর ‘সমস্ত করিডোর’ বলতে মাটির নিচে পাইপ লাইনে, মাটির উপরে সড়কপথে, আকাশে ও পানিপথ ও বন্দরে, সব কিছুতে এবং তা বিনাপয়সায়। এই হলো বাস্তবতা। এক কোভিডের ‘দ্বিতীয় ঢেউ’য়ে সে যে পরিমাণ অক্ষম ও উদাম, তা উন্মোচিত হয়ে গেছে। নিজ মানুষদের সবার জন্য যার টিকা উৎপাদন ক্ষমতাই নেই, বা অর্থের সংস্থান ক্ষমতা নেই, সে বাংলাদেশেসহ সারা দক্ষিণ এশিয়ায় টিকা সরবরাহকারী টিকা কূটনীতিক হওয়ার সক্ষমতা দাবি করে এসেছে। আর এখন খোদ আমেরিকার কাছে হাত পেতেছে। সেখান থেকে ভিক্ষা অনুদানে প্রায় এক বিলিয়ন ডলার মূল্যের ফ্রি টিকা ও স্বাস্থ্য উপকরণ লাভ করেছে।
টাইমস অব ইন্ডিয়ার বাংলাদেশবিরোধী রিপোর্ট নিয়মিত লিখে চলেছেন এর রিপোর্টার দীপাঞ্জন রায় চৌধুরী। অনুষ্ঠানিকভাবে তিনি নাকি ওই পত্রিকার ডিপ্লোম্যাটিক এডিটর, এটা তার দাবি। তার লেখার কোয়ালিটি তা বলে না। যা হোক, এর আগে তখনো এক কোম্পানির প্ররোচনা প্রলোভনে পা-দিয়ে ভারতে উৎপাদিত অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কেনার কমিশনের লোভ দেখানো শুরু হয়নি- কিন্তু আমরা চীনা টিকার তৃতীয় পর্যায়ের টেস্টে অংশগ্রহণের অফার পেয়েছি আর ওই টেস্ট সফল হলে যার বিনিময়ে আমরা নিজেরা টিকা উৎপাদনের লাইসেন্স পাবো। সে সময় এই দীপাঞ্জন লিখেছিলেন ‘চীন বাংলাদেশকে গিনিপিগ বানাতে চায় বলে ওই টিকা নিয়ে আসছে।’ অথচ টিকা পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রথম দু-পর্যায় হলো ওর আসল পরীক্ষা। ওই দুটি পার হওয়ার পরই রথ্যানডম ব্যবহার বা গ্রহণকারীদের উপর এর প্রয়োগ প্রতিক্রিয়া জানার ও প্রয়োজনীয় কারেকশনের জন্য তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষার স্তরে যাওয়া হয়। অর্থাৎ তথ্য-প্রমাণ কিছু না হাজির করে মিথ্যা প্রপাগান্ডা করাই দীপাঞ্জনদের ‘যোগ্যতা’, যেটা জার্নালিজমই নয়। অথচ তারা সে কাজই করে চলেছেন।
চীন কী করতে চায় তা অস্পষ্ট
গত এপ্রিলে দক্ষিণ এশিয়ার পাঁচটি দেশ- বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও আফগানিস্তান আর সাথে চীনসহ মোট ছয়টি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই প্রথম এই জোট গঠনের ধারণাটি তুলে ধরেন। বিশেষ করে ভারত যখন টাকা নিয়েও আমাদের দেশের পাওনা টিকা দেয়া বন্ধ করে দিলো আর অতি কষ্টে হাসিনা সরকার ফিরে চীনকে আমাদের টিকা সরবরাহের উৎস হতে রাজি করাতে পেরেছিল তখনই চীন এই জোটের ধারণাটা হাজির করেছিল। বলেছিল, চীন দক্ষিণ এশিয়ায় একটি কমন টিকা স্টোরেজ গঠন করতে চায় যেখান থেকে এ অঞ্চলে সবাই টিকা সংগ্রহ করতে পারবে। আরো এগিয়ে গত এপ্রিলে একে জোটের ধারণা দেয়া। এখন সেই ধারণাটিকে আরো একটু বিস্তার করে বলা হয়েছে, ‘চায়না-সাউথ এশিয়ান কান্ট্রিজ প্রভার্টি অ্যালিভিয়েশন অ্যান্ড কো-অপারেটিভ ডেভেলপমেন্ট সেন্টার’ তারা গড়তে চায়।
এখানে তিনটি শব্দ- প্রভার্টি অ্যালিভিয়েশন, কো-অপারেটিভ, ডেভেলপমেন্ট সেন্টার; এই তিন শব্দ প্রতিষ্ঠানটার যে বৈশিষ্ট্য ব্যক্ত করেছে তাতে এটা কোনো বাণিজ্য জোট নয়, তাই বলছে। তবে মতিউর রহমান চৌধুরী বাংলা-ভোয়া-তে প্রথম বাক্যে লিখেছেন, ‘অবিকল সার্ক নয়। তবে এর আদলে ‘বিকল্প সার্ক’ গঠন করতে যাচ্ছে চীন। এতে ভারত ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ থাকবে’। এ কথাগুলোর সাথে চীনের কথার মিল নেই।
কারণ, ওই তিন শব্দের কো-অপারেটিভ- এটি যদিও আদি কমিউনিস্টদের শব্দ; তবে চীন এটি এনেছে সম্ভবত ‘সদস্যদের সবার’ বা চীনের একার স্বার্থের সংগঠন নয়, এটা বুঝাতে। কিন্তু এটা খুবই অপ্রয়োজনীয়। ঠিক যে কারণে কিছু রাষ্ট্রের বাণিজ্য জোটের নামে দুনিয়ার কোথাও কো-অপারেটিভ শব্দটা ব্যবহার করা হয়নি। বিভিন্ন রাষ্ট্রের মানে যেখানে সবাই সমান মর্যাদার, সে কারণে এখানে কো-অপারেটিভ খুবই বেমানান ও অপ্রয়োজনীয় শব্দ।
ওদিকে বাকি যে দুই শব্দ প্রভার্টি অ্যালিভিয়েশন (দারিদ্র্য দূরীকরণ) ও ডেভেলপমেন্ট সেন্টার- এ দুই শব্দ নিজেই পরিষ্কার বলছে এটি উন্নয়নবাচক। কিন্তু ‘উন্নয়ন’ মানে কী?
উন্নয়ন বা ইংরেজিতে ডেভেলপমেন্ট- এগুলো আমেরিকার প্রায় প্যাটেন্ট করা শব্দ। আমেরিকার হাতেই এই কনসেপ্টের জন্ম এবং এর ব্যবহার শুরু ও এখনো চালু রয়েছে। যেমন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অথবা আমেরিকান নেতৃত্বের দুনিয়া শুরুর আগে উন্নয়ন বলে কোনো শব্দ ও ধারণা ছিল না। মানে তা অন্য অর্থে ব্যবহৃত হতো।
অ্যাকচুয়ালি ডেভেলপমেন্ট- এই পুরো পরিভাষার আসল অর্থ হলো- ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট। বাংলায়, অবকাঠামো উন্নয়ন। এখন এটা অনেক বড় বলে সংক্ষেপে শুধু ‘উন্নয়ন’ বলা শুরু হয়েছিল। তাহলে এর আসল গুরুত্বের শব্দটা হলো অবকাঠামো, ফলে অবকাঠামোর উন্নতি। ‘অবকাঠামো’ মানে কী তাহলে?
এদিকে ‘বিনিয়োগ’ মানে পুঁজি বিনিয়োগ কথাটা ক্যাপিটালিজমের সমান পুরনো। কারখানা বা ব্যবসা শুরু করতে গেলে বিনিয়োগ লাগে। কিন্তু ১৯৪৪ সালে বিনিয়োগ শব্দটিকে দুভাগ করে নেয়া হয়েছিল। একটি প্রি-বিনিয়োগ আর অপরটি সাধারণ (যেমন- আগে বলতাম সেই) বিনিয়োগ। প্রি-বিনিয়োগ মানে বোঝাই যাচ্ছে, বিনিয়োগেরও আগেই এক বিনিয়োগ এটি। মানে কারখানা বা ব্যবসায় মূল বিনিয়োগ শুরু করার আগে ‘বিনিয়োগ পরিবেশ’ তৈরির জন্য একটা বিনিয়োগ করা। যেমন যেখানে কারখানা-বিনিয়োগ এসে বসবে সেই দেশ-স্থান-শহরের ভূখণ্ডটি জলাভূমি থেকে শুরু; মাটি ফেলা বা ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির সুব্যবস্থা, রাস্তাঘাট, এয়ারপোর্ট, বন্দর পর্যন্ত, দক্ষ প্রশাসন ইত্যাদি যদি সেখানে না থাকে তবে বিনিয়োগ আসবে না। পুঁজি সেখান থেকে চলে যাবে। যার প্রধানমন্ত্রী/মেয়র বুদ্ধিমান শাসক তাই তিনি এসব ব্যবস্থা আগেই করে ফেলেছেন। আর দেশের লোক না খেয়ে মরবে।
এখন যেটাকে বিনিয়োগের আগেই বিনিয়োগ বলছি এটাকে এ জন্য অবকাঠামো-বিনিয়োগ বলে। তবে মূল কথা, অবকাঠামো-বিনিয়োগে সুদের হার সবচেয়ে কম, প্রায় ‘নাই’ করে রাখতে হবে যাতে কারখানা বিনিয়োগের উপরে এর চাপ-প্রভাব খুবই কম হয়।
এই কম সুদের হারের অবকাঠামো-বিনিয়োগের পুঁজি- এটাই ধার দেয়ার সংগঠন হলো বিশ্বব্যাংক। ১৯৪৪ সালে জন্ম নেয়া বিশ্বব্যাংক সংক্ষিপ্ত করে নেয়া নাম। মূল নাম ওইজউ; ইন্টারন্যাশনাল ব্যাঙ্ক ফর রিকনস্ট্র্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট যার উদ্দেশ্য কম সুদে বা ‘না’ সুদে প্রি-বিনিয়োগ বা অবকাঠামো গড়তে লোন দেয়া যাতে এরপর সহজেই বাণিজ্যিক (কারখানা) বিনিয়োগ এসে হাজির হয়।
অবকাঠামো বিনিয়োগ দু’ধরনের হতে পারে। ফিজিক্যাল বা বস্তুগত অবকাঠামো যেটা উপরে বলেছি মানে গ্যাস, বিদ্যুৎ,পানি, রাস্তাঘাট সুব্যবস্থা ইত্যাদি। অপরটি হলো- হিউম্যান বা শ্রমের অবকাঠামো। সাধারণত কারখানা খুললে যেন ভালো এডুকেটেড স্কিল বা নন-এডুকেটেড স্বাস্থ্যবান শ্রমিক পাওয়া যায়। তাই সাধারণত শিক্ষা আর ন্যূনতম স্বাস্থ্য ও সামাজিক খাতে এই অবকাঠামো ব্যয়টা করা হয়।
দুনিয়াতে ১৯৪৪ সালের আগে এই ‘অবকাঠামো উন্নয়ন’ বলে কোনো ধারণাই ছিল না। অর্থাৎ কলোনি আমলে অবকাঠামো বলে কিছু নেই। অবকাঠামো বলে এর ভালো-মন্দসহ যা কিছু দুনিয়াতে হয়েছে এর দায় গ্লোবাল নেতা আমেরিকার।
এখন দুনিয়ায় গ্লোবাল নেতার পালাবদলের এই কালে চীন কি কেবল আমেরিকাকে কপি করবে? নাকি উন্নয়নের চেয়ে খারাপ কিছু অবশ্যই না, বেটার কিছু কনসেপ্ট আনবে?’
এটাই আমরা নিশ্চিত হতে চাই। চীন কি যথেষ্ট চিন্তা করে প্রভার্টি অ্যালিভিয়েশন বা ডেভেলপমেন্ট সেন্টার, শব্দগুলো ব্যবহার করেছে?
আরো বড় প্রশ্ন
তাহলে চীনের নতুন ‘ডেভেলপমেন্ট সেন্টার’-আমরা এখন নিশ্চিত, এটি মতিউর রহমান চৌধুরী যেভাবে কল্পনা করেছেন... ‘অবিকল সার্ক নয়, তবে এর আদলে বিকল্প সার্ক’-এ কথাটি ভিত্তিহীন। কারণ আমাদের বাস্তবের সার্ক ধরনের সংগঠন তো রাষ্ট্রজোট, কোনো অবকাঠামো-দাতা প্রতিষ্ঠান যেমন বিশ্বব্যাংক তা নয়। বিশ্বব্যাংক কোনো রাষ্ট্রজোট নয়।
তাহলে সমস্যা ঠিক কোথায়? খুব সম্ভবত সমস্যাটি চীনের নীতিনির্ধারকদের মাথায় যা অনেকটা বাঘের মতো হায়েনা চাওয়ার মতো!
চীনারা কি এশিয়ায় কোয়াডের মতো কিছু চান? বিকল্প বা প্রতিদ্বন্দ্বী?
প্রথমত, সেটা বুঝাতে তাহলে প্রভার্টি অ্যালিভিয়েশন, কো-অপারেটিভ, ডেভেলপমেন্ট সেন্টার এসব কথা ব্যবহার করছেন কেন? এই পুরোটাই ভুল ও অর্থহীন। তবে সবার উপরে কোয়াডের বিকল্প বা প্রতিদ্বন্দ্বী কিছু চাইলে সাথে সাথে সব দেশ ভেগে যাবে। কারণ তেমন জোট মানেই এটি সামরিক চরিত্রের দিকে টার্ন নেবে। আর এ মুহূর্তে আমেরিকা-চীনসহ কারোই যুদ্ধের প্রতি আগ্রহ নেই; যদি না বাইডেন জেনে বা না জেনে কোনো বোকামি করেন।
আবার চীন যদি আসলেই একটি বিকল্প সার্ক টাইপের জোট চায় তবে প্রভার্টি অ্যালিভিয়েশন, কো-অপারেটিভ, ডেভেলপমেন্ট সেন্টার এসব শব্দ ফেলে দিতে হবে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভারত বা অমুক রাষ্ট্রকে নেয়া যাবে না- এটি বলাই যাবে না। এমনকি দাওয়াতপত্রও ভারতকে পাঠাতে হবে। আর আস্থা রাখতে হবে যে, ভারত আসবে না। আবার ভারত এলেও চীনের লাভ না হলেও লাভ। কাজেই আগাম কে আসতে পারবে না তা বলার কোনোই প্রয়োজন নেই।
আপাতত এখানেই ইতি টানছি। তবে চীনকে অবশ্যই ভেবে পরিষ্কার করে বলতে পারতেই হবে যে, সে স্পষ্ট করে কী চায়? আর এই সাক্ষাতে চীন বাংলাদেশকে এক বড় স্তরের আস্থায় নিয়ে রেখেছে, এটা তাৎপর্যপূর্ণ।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
goutamdas1958@hotmail.com