লিটন ও ক্রিকেটের দ্য ভিঞ্চি হওয়ার স্বপ্ন
লিটন দাস - ছবি সংগৃহীত
দ্য ভিঞ্চির মতো তিনি কাগজের ক্যানভাসে মোনালিসা আঁকেন না, তবে তার কাগজে আঁকার হাত যে খুব একটা মন্দ তা বলার উপায়ও রাখে না। তাঁর আঁকা কিছু ছবি তো আজও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ঘুরে বেড়ায়। যাহোক, কাগজ থেকে তিনি ভালো আঁকতে পারেন ব্যাট হাতে ক্রিকেট মাঠে, বলা চলে ২২ গজের সবুজ ক্যানভাসে। ওই সবুজ ক্যানভাসে যখন ছবি আঁকেন তিনি, সদ্য তারুণ্যে পা রাখা চঞ্চল ছোকরা হতে চোখে ঝাপসা দেখা বুড়ো পর্যন্ত অপার বিস্ময়ে মুগ্ধতা ছড়ানো পলকহীন দৃষ্টিতে তখন তার দিকে তাকিয়ে থাকতে বাধ্য তীব্র আকর্ষণে। যেন উইলোর তুলি হাতে ছয় আউন্সের চর্কগোলকটার রঙে রংধনুর মতো রাঙিয়ে তোলেন মাঠ নামক ওই সবুজে ক্যানভাসটা আপনমনে। সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে উইকেটের চারপাশে কব্জির মুচড়ে দৃষ্টিনন্দন যে শটগুলো খেলেন তিনি, তার উপমাতে নিশ্চয়ই ২২ গজের দ্য ভিঞ্চি আখ্যাতে দ্বিতীয়বার ভাবার প্রয়োজন আছে কি?
কতটা ভালো ছবি আঁকতে জানেন ব্যাট হাতে তার জানান দিয়েছিলেন ২০১৮ এশিয়া কাপ ফাইনালে, ভারতের বিপক্ষে। অতঃপর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রায় সময়েরর মুখোমুখিতেই বলা চলে। বিশ্বকাপের সেই ৯৪* তো আজও চোখে ভাসে। বাকি সবটাই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। সেই মহাকাব্যিক ১৭৮ রানের বাংলার ইতিহাসের সর্ব সেরা ইনিংসটাও তো তাদেরই বিপক্ষে। বলা চলে অন্য সবার মতো দুর্বল জিম্বাবুয়েকে পেলে তারও আত্মবিশ্বাস যেন ডানা মেলে উড়ে। তবে আজকের শতকটা সব থেকে ভিন্ন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আগেও দুটি শতকের দেখা মিললেও তা ছিলো ব্যক্তিগত প্রয়োজনে। কিন্তু আজকের শতকটা শুধুই দলের জন্য, দেশের জন্য নিঃসন্দেহে।
সেঞ্চুরি আগেও করেছেন, বড় ইনিংস খেলেছেন। ব্যাটিং সৌন্দর্যে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন। কিন্তু আজ ছিল তার উল্টো। দলের দ্রুত কিছু উইকেট না গেলে হয়তো তার আউট হবার জন্য প্রার্থনা শুরু করতেন। কারণ এমন লিটন দেখে তারা অভ্যস্ত নয়, বা লিটন থেকে তাদের চাওয়াটা এমন নয়। লিটন থেকে তাদের আরো অনেক বেশি চাওয়া। একদম ধীর সূচনা। তার এই ধীরলয় ব্যাটিং সমর্থক প্রাণে ভয়ের কম্পন দিচ্ছিল। এমন খেলতে থাকা লিটন টিকে যেতে পারবেন তো? পারবেন কি নিজের স্বরূপে দেখা দিতে!
সাধারণ মারকাটারি ব্যাটিং করে চার ছক্কার উল্লাসে মাতিয়ে রাখেন তিনি, তবে আজ ছিলেন ভিন্ন। নিজ দায়িত্বটা বুঝে নিয়েছিলেন শুরু হতে। অধিনায়ক তামিম ইকবালের বিদায়ে ইনিংস বড় করার দায়িত্বটা তুলে নিয়েছিলেন নিজ হাতে। কিন্তু খাপ খাচ্ছিলনা খানিকটাও। সম্ভাবনা দেখিয়ে সাকিব, মিথুন আউট হয়েছেন ১৯ রানে। কিন্তু লিটনেরও সবার পথে হাঁটলে চলবে? তবে তিনি লিটনইনবা হবেন কী করে? ৭৪ রানে ৪ উইকেট হারালেও লিটন দাঁড়িয়ে ছিলেন স্বভাব বিরুদ্ধ ভঙ্গিতে।
ইংল্যান্ডের মাঠের মতো মেঘাচ্ছন্ন দিনে সাপের মতো ফনা তোলা সুইং ছিল না আজ। ছিল না নিউজিল্যান্ডের মতো তীব্র বাতাসও। তবে শীতের প্রকোপটা ভালোই আছে জিম্বাবুয়েতে। আর সেটাই শুরু থেকে ভুগিয়েছে বাংলাদেশকে। আর শীতের সকালে ব্যাট করা যে কি পরিমাণ কঠিন, তা কি কারো অজানা আছে? আর মুরজাবানির নেতৃত্বে জিম্বাবুয়ের বোলিং শক্তিটা যেন খানিকটা বেড়ে গেছে। টেস্ট সিরিজের মতো ওয়ানডে সিরিজেও তার দাপট অব্যাহত রেখেছে। যদিও বা আপনি বলেন ব্যাটসম্যানের ভুলে আউট হয়েছে। কিন্তু ব্যাটসম্যানকে ভুল করতে তো বোলাররাই প্রলুব্ধ করে৷
যাহোক, মাত্র ৭৪ রানে অভিজ্ঞদের বিদায়ে শেষ ভরসা মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে লিটন আজ সামলিয়েছেন শুরুর বিপর্যয়। যেন হঠাৎই তীব্র স্রোত নিয়ে গর্জে উঠা সমুদ্রের বুকে দুল্যমান এক ডিঙি নৌকাকে তীরে ভেড়ানোর চেষ্টায় নিজের সেরাটা দিয়ে লড়ে চলা এক মাঝি তিনি। এর আগেও এমন মুহূর্তের সাক্ষী হয়েছিলেন একবার, সেই ভারতের বিপক্ষে। কিন্তু সেবার খুব কাছে গিয়েও তীরে পৌঁছানো হয়নি। কিন্তু এবার যেন লিটন দৃঢ়প্রত্যয়ী। নিজের শতক তুলে যখন ১১৪ বলে ১০২ রানে আউট হলেন, তখন তার দায়িত্ব বলতে গেলে শেষ দিকে। তিনি পেরেছেন তার দায়িত্ব পূরণ করতে।
অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, লিটন কি শুধুই জিম্বাবুয়ের সাথেই পারেন? আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হলেও চিত্রটা কিন্তু পুরোই ভিন্ন। শেষ তিন সেঞ্চুরির ৩ টাই জিম্বাবুয়ে প্রতিপক্ষ হলেও বুঝতে হবে স্থান, কাল, পাত্র। কিন্তু জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দ্বিতীয় সেঞ্চুরির পর থেকে তৃতীয় সেঞ্চুরির আগ পর্যন্ত ওয়ানডেতে ৮ ইনিংসে লিটনের ব্যাট থেকে আসে মাত্র ১০১ রান। কিন্তু কেন, কি কারণ তার? তাও পরিষ্কার করেছেন লিটন দাস। বলেছেন সেরা সময়টায় বাধা ছিল করোনায় মাঠে নামতে না পারা। ধারাবাহিকতা ধরে রাখা কঠিন হয়ে গিয়েছিল তাই।
যাহোক, খারাপ সময় টেনে আর কি প্রয়োজন আছে আর? দায়িত্বশীল লিটনকেই তো চাওয়া সবার। তবে আরেকটু সাবলীল সুন্দরভাবে। সৌন্দর্যের সংমিশ্রণে ধারাবাহিকভাবে। যেন তার ব্যাটে লেখা হয় আরো শতাধিক জয়গাঁথা। বৈঠা হাতে তার লড়াইয়ে আরো বহুবার উত্তাল সমুদ্র পেড়িয়ে তীরে পৌঁছুক জয়ের নৌকা। আরো বহুবার তার তুলিতে ২২ গজের ক্যানভাসে আঁকা হোক মোনালিসা। আর সময়ের পরিক্রমায় তিনি হয়ে উঠুন বিশ্ব স্বীকৃত ক্রিকেটের দ্য ভিঞ্চি।