আফগাননীতিতে মার্কিনিদের ভুল : অতঃপর খেসারত
আফগানিস্তানে মার্কিন সৈন্য - ছবি সংগৃহীত
পাকিস্তানের ঘাঁটি ব্যবহার করে আমেরিকা যখন প্রথমবারের মতো আফগানিস্তানে দখল কায়েম করে, তখন দম্ভভরে অপরিণামদর্শী সব বেপরোয়া আচরণ শুরু করেছিল। কোনো প্রাসঙ্গিকতা ছাড়াই আফগানিস্তানে টেনে এনেছিল পাকিস্তানের চিরবৈরীপ্রতীম দেশ হিন্দুত্ববাদী ভারতকে। পুতুল সরকার আশরাফ গনিকে ক্ষমতায় বসিয়ে তার সেনা প্রশিক্ষণের দায়িত্ব দেয় পাকবৈরী এই কট্টরপন্থী দেশটিকে। গুরুত্বপূর্ণ কৌশলে এ দেশটিতে পাকিস্তানের প্রভাব খর্ব হয়। পাকিস্তান বড় ধরনের হোঁচট খায়। কনস্যুলেট স্থাপনের ক্ষেত্রেও পাকিস্তানের গুরুত্ব দেয়া হয় কম। আফগানিস্তানের গভীরে পাকিস্তান কেবল চারটি কনস্যুলেট স্থাপনের সুযোগ পায়। ওদিকে আফগান-পাক সীমান্তে ভারতকে ২৪টি কনস্যুলেট স্থাপনের সুযোগ দেয়া হয়। এতে আফগান-পাক সীমান্ত ভারতের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। ভারত এই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে পাকিস্তানকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করে। আমেরিকার প্রতি তখন পাকিস্তানের প্রবল বিতৃষ্ণা সৃষ্টি হয়।
যুক্তরাষ্ট্র 'উগ্র জঙ্গিবাদ' দমনের নামে পাকিস্তানের অনেক ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের গুম করে। কাউকে পাকিস্তান বাহিনীর সামনেই হত্যা করে। নিরীহ মানুষেরও অনেক প্রাণনাশ ঘটে। পাকিস্তানের ভেতর প্রতিশোধের আগুন আরো প্রবলভাবে জ্বলে ওঠে। আমেরিকা যখন পাকঘাঁটি ব্যবহার করে আফগানিস্তানে হামলা চালায়, পাকিস্তানের ব্যয় করতে হয় ১.৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। আমেরিকা সাহায্যের নামে দেয় ২০ বিলিয়ন ডলার। বেপরোয়া এই উপহাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি পাকিস্তানের ক্ষুব্ধতা ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছে। পাকিস্তান মার্কিন বলয় থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করে। আমেরিকার প্রকাশ্য প্রতিবাদ করার মতো ক্ষমতা নেই। পাকিস্তান তাই কৌশলগত অবস্থান গ্রহণ করে। প্রকাশ্যে মার্কিন প্রীতি দেখালেও পর্দার অন্তরালে চলে ভিন্ন আয়োজন। 'কুফুরি' বিশ্বের শক্তিক্ষয়ে প্রবল প্রতিশোধ স্পৃহায় ভ্রাতৃত্বের আশ্রয়ে মিলিত হয় তালেবানের সাথে। নানা সহযোগিতায় পুষ্ট করে পাক-তালেবান সম্পর্ক। আফগান সীমান্তঘেঁষা পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসিত জেলাগুলোতে তালেবান কিছুটা নির্বিঘ্নে প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ পায়। সেখান থেকে সংগঠিত হয়ে তারা আফগানিস্তানে ফিরে যায়।
আমেরিকা তখনো আত্মতৃপ্তি ও অহঙ্কারে ভাসছে। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বুশ যুদ্ধের শুরুতেই দম্ভভরে ঘোষণা দেন, 'আফগানিস্তান দখল করা মার্কিন বাহিনীর সপ্তাহখানেকের ব্যাপারমাত্র।' অবশ্য সপ্তাহখানেকের মধ্যেই দখল করা সম্ভব হয়নি। এর জন্য তাদের কর্মক্লান্ত যুদ্ধ করতে হয়েছে দীর্ঘ ৬০ দিন। খোয়াতে হয়েছে ৩.৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের একটি বি-৫২ বোমারু বিমান। হারাতে হয়েছে চারজন আমেরিকান সৈন্য। তবুও সাময়িক এই বিজয় তাদের অসম্ভব উচ্ছ্বাসিত করে। তালেবান প্রতিরোধে তাই মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল্ড রামসফেল্ড বিশেষ বিনিয়োগের প্রয়োজন বোধ করেন না। শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠনেও তার আগ্রহ দেখা যায় না। এজন্যই দেখা যায়, ২০০২ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত আফগান প্রশাসনের প্রশিক্ষিত বাহিনীর সদস্য ছিলো ছয় হাজার। ন্যাটো জোটের সদস্য ছিলো তিন হাজার। এই নয় হাজার সদস্যের বাহিনী নিয়েই পরাশক্তির কবরস্থান খ্যাত আফগানের প্রাণের স্পন্দন তালেবানের বিরুদ্ধে সামরিক আগ্রাসনবিলাস শুরু করে। অপরদিকে তালেবান তখন ১০ হাজার সক্রিয় সদস্য নিয়ে এর মোকাবেলায় নামে। প্রশিক্ষণ শেষে দল ভারী করে আরো অনেকে। তালেবান যোদ্ধারা আশ্রয় গ্রহণ করে গহীন অরণ্যে। মার্কিন বাহিনীকে টেনে নেয় নিজেদের উপযুক্ত সমরে। সংখ্যার কৃচ্ছতা ও সমরের অনুপযুক্ততা মার্কিন বাহিনীকে বেকায়দায় ফেলে দেয়। মার্কিনিদের তখনই ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে যায়।
কাবুল সরকারের অবাধ লুটপাট ও নানা অনাচার আফগানদের আশাহত করে। মার্কিন তোষণ করে আরো বীতশ্রদ্ধ। তালেবানের দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের দারুণ নাজরানা তাদের মনমুকুরে স্থায়ী আসন তৈরি করে নেয়। ফলে আফগান সরকার কার্যত জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ওদিকে তালেবানের শেকড় পৌঁছে যায় আফগানীদের হৃদয়ের গভীরে। গেরিলা অপারেশনে তালেবান তাই নানা সুবিধা ভোগ করে। সরকার বা মার্কিন বাহিনীর পোহাতে হয় বাড়তি ঝামেলা। সামরিক উপায়ে তাই তালেবানকে পরাস্ত করা দুরূহ হয়ে ওঠে। আমেরিকার বিজয় হয়ে যায় সুদূর পরাহত।
আফগান সমরে তখনো বিজয় নিশ্চিত হয়নি। আমেরিকা আবার নতুন সমরে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। তালেবানকে সঠিক পরিমাপ করতে ব্যর্থ হয়। গণবিধ্বংসী অবৈধ অস্ত্র মজুদের অভিযোগ তুলে ইরাকের উপর আগ্রাসন শুরু করে। সশস্ত্র নানা বাহিনীর সাথে আইএসের উত্থানে সেখানেও আমেরিকা বেকায়দায় পড়ে। এসময় তালেবান আগের চেয়ে বহুগুণ শক্তি সঞ্চার করে। ফলে তালেবানকে আর কখনো পিছু হটতে হয়নি। তাছাড়া তখন তালেবানের বৈশ্বিক সমর্থন, বিশেষ করে আমেরিকা যাদের শত্রু জ্ঞান করে, চীন, রাশিয়া ও ইরানের স্ট্রাটেজিক কূটনৈতিক সম্পর্কও মার্কিন বাহিনীকে প্রচণ্ড চাপের মুখে ফেলে। নানাভাবে আমেরিকার পরাজয় সুনিশ্চিত হয়ে ওঠে।
সমরের তিক্ত বাস্তবতা অনুধাবন করে ২০০৮ সালে ন্যাটো জোটের শক্তিশালী অংশীদার ব্রিটিশ বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ এক সামরিক কমান্ডার মার্ক কার্লেটন স্মিথ বলেছিলেন, 'যুদ্ধের মাধ্যমে আফগান সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।' সমরের বাস্তব অভিজ্ঞতার কারণে তার গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর মন্তব্যটি ব্রিটিশ পত্রিকা সানডে টাইমস ফলাও করে প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশ করে। তৎকালীন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবার্ট গেটস বাস্তবতাকে পাশ কাটিয়ে স্মিথের প্রতি ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, 'স্মিথ তো পরাজিত মানসিকতার এক কাপুরুষ।'
ক্ষমতার অহঙ্কারে নভোচারী আমেরিকা তখনো সতর্ক হয়নি। ব্যর্থ প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে সময় আরো কিছু গড়ালে আমেরিকার পরাজয় অবধারিত হয়ে যায়। ২০১০ সালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান মিখাইল গর্বাচেভ তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে পরামর্শ দিয়ে বলেছিলেন, 'সামরিক উপায়ে আফগান সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। বরং রাজনৈতিক আলোচনার আয়োজন করে শান্তিচুক্তির মাধ্যমে সেনা প্রত্যাহারই শ্রেয় হবে।'
আমেরিকার তখনো বোধদয় হয়নি। দম্ভভরে সৈন্যসংখ্যা বাড়িয়ে ১ লাখ ৪০ হাজারে উন্নীত করে। জয়লাভের আশায় আরো মরিয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু সৈন্যক্ষয় ছাড়া আমেরিকার বিশেষ কিছু অর্জিত হয় না। বাস্তবতা কি আর উপেক্ষা করা চলে? ক্ষমতার পালাবদলে ট্রাম্প প্রশাসন ক্ষমতায় আসে। বাস্তবতা মেনে নিয়ে তারা রাজনৈতিক আলোচনার আয়োজন করে। শান্তিচুক্তির মাধ্যমে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পরবর্তী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও একই পথে হাঁটে।
তালেবান সরকারের পতনের পর ২০০২ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুশ অত্যন্ত দম্ভভরে স্টেস ইউনিয়নে দেয়া এক ভাষণে অপারেশন এনডিউরিং ফ্রিডম বা আফগান যুদ্ধের ব্যাপারে সাফাই গাইতে গিয়ে বলেন, 'আজ থেকে আফগান নারীরা সম্পূর্ণ স্বাধীন। তালেবানরা তাদের একঘরে করে রেখেছিলো। তাদের স্কুলমুখী হওয়ার সুযোগ ছিলো না। উচ্চস্বরে হাসার উপরও বিধিনিষেধ ছিলো। আজ আফগান নারীরা বুকভরে উন্মুক্ত প্রান্তরে নিঃশ্বাস নিতে পারবে।'
আজ ২০ বছর পর তারই উত্তরসূরী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আফগান যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘোষণা করে বলেন, 'আফগান নারীর স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আমি আর কোনো মার্কিন সৈন্যের রক্ত ঝরতে দিতে পারি না। আফগান সমস্যার সমাধান বহিরাশক্তির মধ্যস্থতায় মীমাংসা হবার নয়। আফগানদেরই তার সমাধানে পৌঁছতে হবে।'
পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছে, যেই স্টেস ইউনিয়নে দম্ভের সাথে একসময় আফগান যুদ্ধের সাফাই বিবৃত হয়েছে, আজ একই স্থান থেকে সে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘোষিত হচ্ছে। তবে আজ নেই কোন দম্ভোক্তি। আছে পতনশীল সাম্রাজ্যবাদি শক্তির অনিয়ন্ত্রণযোগ্য ভার, যাকে টেনে তুলতে নুয়ে পড়ছে বৃদ্ধ বাইডেন।