ঐক্য আর স্বাধীনতার সংগ্রাম : কুর্দিস্তান
ঐক্য আর স্বাধীনতার সংগ্রাম : কুর্দিস্তান - ছবি : সংগৃহীত
সময়টা ১৯৪৭ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমর বিজয়ী ব্রিটিশ ও ফরাসি রাজশক্তি ওই যুদ্ধের ব্যয় ভার সামলাতে গিয়ে সাম্রাজ্যের ভিত নষ্ট করে ফেলে। ফলে বিশ্বব্যাপী ভেঙে পড়ে সামন্ততান্ত্রিক উপনিবেশিকতাবাদ। পৃথিবীর বুকে স্বাধীনতা পায় অনেক রাষ্ট্র। একইসাথে পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয় নতুন ধারণা আঞ্চলিক ও রাষ্ট্রভিত্তিক জাতীয়তাবাদ।
এই উপমহাদেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ দুটি অঞ্চল বাংলা আর পাঞ্জাব। ১৪ ও ১৫ আগষ্ট ব্রিটিশরাজ ভারতবর্ষ ত্যাগ করার সময় অঙ্গচ্ছেদ করে যায় এই দুই রাজ্যের। পূর্ব পশ্চিম এ দুটি নাম দিয়ে বিভক্ত এ দুই প্রদেশ পাকিস্তান আর ভারত ভাগ-যোগ করে নিয়ে নেয়। সেটা একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থা।
কিন্তু এই ব্যবচ্ছেদ প্রক্রিয়া বাংলা আর পাঞ্জাবের মাটি আর মানুষের যে ত্যাগ আর বঞ্চনা সহ্য করতে হয়েছে তাও ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। এ ভাগ বাঁটোয়ারার প্রভাব শুধুই কি রাজনৈতিক বা ভৌগোলিক? এর সাথে ভাগ বাঁটোয়ারা হয়ে গেছে আবেগ, স্মৃতি আর স্বপ্নের। কিন্তু পানির মতো অবিভাজ্য রয়ে গেছে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, মনন আর আত্মীয়তার বন্ধন। ভূ-রাজনৈতিক সীমানা কি তাকে বিভক্ত করে দিতে পারে?
তেমনি পৃথিবীর বহুজাতি-গোষ্ঠী আজ আমাদের বাঙালিদের মতো পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ নামে ভৌগোলিক ও রাজনৈতিকভাবে একাধিক ভাগে বিভক্ত। তাদের কেউ বা স্বাধীন কেউ বা পরাধীন অবস্থায় কোনো বৃহৎ রাজনৈতিক সার্বভৌমত্বের অধীন। তার মধ্যে সর্বাধিক আলোচিত (দক্ষিণ) আয়ারল্যান্ড, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া, পূর্ব তিমুর, (উত্তর) সুদান ও দক্ষিণ সুদানের মতো অনেক বিভক্ত জাতিগোষ্ঠী বিভক্তির মধ্যে ও নিজস্ব সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। আবার একসময় বিভক্ত জার্মান, ভিয়েতনাম, ইয়েমেনসহ অনেকে তাদের রাজনৈতিক বিভক্তি মুছে ফেলে আবার ঐক্য প্রতিষ্ঠা করেছে ।
তেমনই কিছু কিছু জাতি-গোষ্ঠী আবার রাজনৈতিক ভাবে বহুধা বিভক্ত থাকলেও কিন্তু তাদের কোনো রাজনৈতিক সার্বভৌম পরিচয় নেই। যারা দীর্ঘ সময় থেকে সংগ্রাম করে চলছে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য। এমন কয়েকটি জাতির একটি কুর্দি।
কুর্দিস্থান
মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম আলোচিত একটি ধারণা কুর্দিস্থান। তুরস্ক, সিরিয়া, ইরান আর ইরাকের মাঝে বিলুপ্ত প্রায় এই ঐতিহাসিক জাতি-গোষ্ঠীর অস্তিত্ব বর্তমান।
জাতিগত বিবেচনায় মধ্যপ্রাচ্যে আরব, পারসিক আর তুর্কিদের পর কুর্দিরাই বৃহত্তর জাতিগোষ্ঠী। যাদের জনসংখ্যা প্রায় তিন কোটি।
ভৌগোলিকভাবে কুর্দিস্তান অঞ্চলটি জগ্রোস পর্বতমালার উত্তর-পশ্চিম অংশ এবং তোরোস পর্বতমালার পূর্বাংশ নিয়ে গঠিত।
আধুনিককালে কুর্দিস্তান বলতে বোঝায়
* তুরস্কের পূর্বের কিছু অংশ (তুর্কি কুর্দিস্তান),
* উত্তর ইরাক (ইরাকি কুর্দিস্তান),
* দক্ষিণ-পশ্চিম ইরান (ইরানি কুর্দিস্তান)
* উত্তর সিরিয়ার (সিরীয় কুর্দিস্তান)
* আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার সামান্য কিছু এলাকাকেও বৃহত্তর কুর্দিস্তানের অন্তর্গত গণ্য করা হয়।
ইরাকি কুর্দিস্তান ১৯৭০ সালে ইরাকি সরকারের সাথে এক চুক্তির মাধ্যমে স্বায়ত্তশাসন লাভ করে। ২০০৫ সালে ইরাকের নতুন সংবিধানেও ইরাকি কুর্দিস্তানের এই স্বায়ত্তশাসন পুনরায় স্বীকৃতি পায়। ইরাকের প্রতিবেশী ইরানের কুর্দি-অধ্যুষিত এলাকাটিকে কোর্দেস্তন নামের একটি প্রদেশের অন্তর্গত করা হয়েছে। কিন্তু ইরানের এই প্রদেশটি কোনো স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ নয়।
অধীকৃত দখলদার রাষ্ট্রগুলোর জাতিগত অত্যাচার, নির্যাতন, দাবিয়ে রাখার প্রবণতার মধ্যেও মাথা উঁচু করে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিতে ব্যাকুল এই কুর্দি জাতি।
বিশ শতকে কুর্দি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। কিছু কুর্দি জাতীয়তাবাদী সংগঠন কুর্দিস্তান নামের একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে, যাতে কুর্দি-অধ্যুষিত সমস্ত এলাকা বা এর অংশবিশেষ অন্তর্ভুক্ত থাকবে। অন্যরা বর্তমান রাষ্ট্রীয় সীমানাগুলোর মধ্যেই কুর্দি অঞ্চলগুলোর স্বায়ত্বশাসনের পরিমাণ বাড়ানোর পক্ষপাতী।