এরদোগানকে উৎখাতে ৩০০ কোটি ডলার দিয়েছিল আরব আমিরাত!
আরব আমিরাতের প্রধানমন্ত্রী ও দুবাইয়ের শাসক শেখ মুহাম্মাদ বিন রশিদ আল-মাখতুম, ইনসেটে এরদোগান - ছবি : সংগৃহীত
গত ২০১৬ সালের জুলাই মাসে তুরস্কে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটোনোর জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাত ৩০০ কোটি ডলার অর্থ ব্যয় করেছিল। তুরস্কের দৈনিক ‘ইয়েনি সাফাক’ পত্রিকায় কলামিস্ট মেহমেত আসেত ২০১৭ সালের ১২ জুন তার নিজের কলামে এ তথ্য প্রকাশ করেছিলেন।
তিনি বলেছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত চাভুসওগ্লু সম্প্রতি বলেছেন যে, “২০১৬ সালের জুলাই মাসে একটি মুসলিম দেশ কোটি কোটি ডলার খরচ করেছে তুরস্কের সরকার উৎখাতের জন্য। এ কথা দিয়ে তিনি আসলে সংযুক্ত আরব আমিরাতের কথা বলেছেন।”
পরে তুরস্কের গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে আসেত তার দাবিকে সম্পর্কে আরো বিস্তৃত বলেছেন, তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, অভ্যুত্থান প্রচেষ্টার পেছনে ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত। দৈনিক সাবাহ পত্রিকাকে তিনি বলেন, “মন্ত্রী কোনো দেশের নাম বলেন নি তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, দেশটি ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাত।”
আরো কয়েকটি সূত্র বলেছে, ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থান সংঘটিত হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে আবুধাবি সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ এক ‘মিডিয়া ম্যাগনেট’ ওই বিপুল পরিমাণ অর্থ তুরস্কে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। সূত্রগুলো বলেছে, ফতেহউল্লাহ গুলেনের অনুসারিদের কাছে এ অর্থ পাঠানো হয়।
ওই ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর তুর্কি সরকার সরাসরি কোনো দেশকে দায়ী করে নি তবে চাভুসওগ্লু এমন সময় আমিরাতের জড়িত থাকার ইঙ্গিত দিয়েছেন যখন পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে মারাত্মক কূটনৈতিক সংকট চলছে। চলমান ঘটনায় তুরস্ক সরাসরি কাতারের পক্ষ নিয়েছে।
সূত্র : পার্স টুডে
যেভাবে ব্যর্থ হয়েছিল তুরস্কের সামরিক অভ্যুত্থান
২০১৬ সালের ১৫ জুলাই শুক্রবার রাতে যখন প্রথম তুরস্কে অভ্যুত্থানের খবর ছড়িয়ে পড়ে, তখন কয়েক ঘন্টা ধরে দেশটির নিয়ন্ত্রণ বিদ্রোহী সেনাদের হাতে বলেই মনে হচ্ছিল।
রাজধানী আংকারা আর সবচেয়ে বড় নগরী ইস্তাম্বুলের প্রধান স্থাপনাগুলোতে ছিল তাদের দৃশ্যমান উপস্থিতি। টেলিভিশন চ্যানেলগুলো দখল করে নেয় সেনাবাহিনী এবং তাদের সম্প্রচার বন্ধ করে দেয়া হয়।
এত ঘটনার মধ্যে কোনো খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যিপ এরদোগানের। অভ্যুত্থানকারীদের সেই মুহূর্তে দরকার ছিল সেনাবাহিনীর বেশিরভাগ অংশের এবং জনগণের সমর্থন।
কিন্তু অভ্যুত্থানের চেষ্টা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেল প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইলডিরিম তা প্রতিরোধের চেষ্টা শুরু করেছেন। তবে তুরস্কের বেশিরভাগ মানুষ জানে, প্রকৃত ক্ষমতা আসলে প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যিপ এরদোগানের হাতে, এবং কিছু করতে হলে তাকেই নেতৃত্ব দিতে হবে।
অভ্যুত্থান সফল হতে হলে প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে পুরো রাজনৈতিক দৃশ্যপট থেকে সরিয়ে দেয়ার দরকার ছিল। কিন্তু অভ্যুত্থানকারীদের সেই চেষ্টা সফল হয়নি।
কোনো কোনো খবরে বলা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট এরদোগান এক অবকাশ কেন্দ্রের যে হোটেলে ছিলেন সেখানে বোমা হামলা চালানো হয়েছিল। কিন্তু ততক্ষণে তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে যান। ফলে সৌভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে যান।
শুরুতে বোঝা যাচ্ছিল না প্রেসিডেন্ট এরদোগান কোথায় আছেন। কোনো কোনো খবরে বলা হচ্ছিল তিনি তুরস্কের একেবারে দক্ষিণ-পশ্চিমে এজিয়ান সাগর তীরের অবকাশ কেন্দ্র মারমারিসে আছেন।
কিন্তু কয়েক ঘন্টার মধ্যেই তাকে দেখা গেল সিএনএনের তুর্কি ভাষার নিউজ চ্যানেলে। মোবাইল ফোনে ভিডিও সাক্ষাৎকারে তিনি জনগণকে রাস্তায় নেমে অভ্যুত্থান প্রতিহত করার ডাক দিলেন।
প্রেসিডেন্ট এরদোগান যখন ইস্তাম্বুলের কামাল আতাতুর্ক বিমানবন্দরে এসে নামেন, হাওয়া পুরো ঘুরে গেলো।
সেখানে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি কড়া ভাষায় অভ্যুত্থানকারীদের দেখে নেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিলেন, বললেন, তুরস্কের নিয়ন্ত্রণ তার হাতেই।
অনেকের কাছেই পরিস্কার হয়ে গেল যে, অভ্যুত্থানকারীরা ব্যর্থ হয়েছে, সিনিয়র সেনা অধিনায়করা সরকারের পক্ষেই আছে।
আংকারার নিয়ন্ত্রণ তখনো অভ্যুত্থানকারীদের হাতে। কিন্তু ইস্তাম্বুল তাদের হাতছাড়া হয়ে গেছে।
প্রেসিডেন্ট এরদোগানের ডাকে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার মানুষ তখন ইস্তাম্বুল আর আংকারার রাস্তায় নেমে এসেছে। বিমানবন্দরে যে সেনারা অবস্থান নিয়েছিল, তাদের ঘেরাও করে জনতা, পুরো বিমানবন্দর দখল করে নেয় তারা।
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন টিআরটি থেকে অভ্যুত্থানকারীরা বেশ কিছু ঘোষণা প্রচার করেছিল। তারা কারফিউ জারি করেছিল। কিন্তু সেটি কার্যকর করতে তারা ব্যর্থ হয়।
অভ্যুত্থানকারীদের নিয়ন্ত্রণ ক্রমশ শিথিল হতে থাকে।
অভ্যুত্থান সফল হওয়ার জন্য সেনাবাহিনীর মধ্যে ব্যাপক সমর্থনের দরকার ছিল। কয়েকটি বড় শহরে হয়তো অনেক সেনা সদস্য এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে ছিল।
অভ্যুত্থানকারীরা রাস্তায় অনেক ট্যাংক নামাতে পেরেছিল। তারা ইস্তাম্বুলের বসফোরাস প্রণালীর ওপরের ব্রিজ বন্ধ করে দিতে পেরেছিল।
কিন্তু সেনাপ্রধান জেনারেল গুল হুলুসি আকার এই অভ্যুত্থানের সঙ্গে ছিলেন না। সবচেয়ে বড় নগরী ইস্তাম্বুলে ছিল যে সেনা ডিভিশন, তার অধিনায়কও এই অভ্যুত্থান সমর্থন করেননি। নৌবাহিনী প্রধান এবং বিশেষ বাহিনীর প্রধানও অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করেন। এফ-সিক্সটিন জঙ্গি বিমান থেকে অভ্যুত্থানকারীদের অবস্থানে বিমান হামলাও চালানো হয়।
যুক্তরাজ্যের একটি থিংক ট্যাংক চ্যাথাম হাউজের ফাদি হাকুরা বলেন, এই অভ্যুত্থান আসলে শুরু হওয়ার আগেই ব্যর্থ হয়। এদের পেছনে না ছিল রাজনৈতিক সমর্থন, না ছিল জনগণের সমর্থন।
তুরস্কের প্রধান দলগুলো শুরুতেই জানিয়ে দেয়া তারা এর সঙ্গে নেই। ধর্মনিরপেক্ষ সিএইচপি, জাতীয়তাবাদী দল এমএইচপি সবাই সরকারকে সমর্থন জানায়।
বলা হচ্ছে, সেনাবাহিনীর একটি অংশ এই অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করে। ইস্তাম্বুলেই মূলত তাদের ঘাঁটি।
ফাদি হাকুরা মনে করেন, এরা সেনাবাহিনীর বিরাট অংশের প্রতিনিধিত্ব করে না। তাদের ব্যর্থতা এটাও প্রমাণ করে যে তুরস্কে সেনা অভ্যুত্থানের পক্ষে আর সমাজের বেশিরভাগ অংশের কোন সমর্থন নেই।
এরদোগান এর আগে বহুবার সেনা অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তার সরকার সেনাবাহিনীর মধ্যে অনেক শুদ্ধি অভিযানও চালিয়েছে।
অভ্যুত্থানের সাথে জড়িত বলে যার দিকে ইঙ্গিত করা হচ্ছে, তিনি হচ্ছে ফেতুল্লা গুলেন।
প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ মিত্র ফেতুল্লা গুলেন যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। তিনি একজন ধর্মীয় নেতা। তার হিজমেত আন্দোলনের বিরাট সমর্থন আছে তুরস্কে। এরা নানা ধরণের স্কুল, কলেজ, এনজিও এবং ব্যবসা পরিচালনা করে। তাদের আছে অনেক মিডিয়া প্রতিষ্ঠান।
কিন্তু ফেতুল্লা গুলেনের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট এরদোগানের সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে কয়েক বছর আগে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান কঠোর সব ব্যবস্থা নেন হিজমেত আন্দোলনের বিরুদ্ধে।
অভ্যুত্থানের পেছনে এদের হাত আছে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট এরদোগান এবং তার দলের নেতারা। তবে ফেতুল্লা গুলেন জোর গলায় তা অস্বীকার করেছেন।
সূত্র : বিবিসি