তুরস্কের ব্যর্থ অভ্যুত্থান ও ভূ-রাজনীতি

তুরস্কের ব্যর্থ অভ্যুত্থান ও ভূ-রাজনীতি - ছবি : সংগৃহীত
গত ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই তুরস্কে সেনাবাহিনীর একাংশের অভ্যুত্থানের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পরও এর নানা দিক নিয়ে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শুরু হয়েছে।
অভ্যুত্থান কেন ব্যর্থ হলো, ভূ-রাজনীতিতে সার্বিকভাবে এর প্রভাব কী হতে পারে – এ নিয়েও বিভিন্ন সংস্থা এবং বিশেষ ব্যক্তিত্ব তাদের মতামত তুলে ধরেছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক তথ্যভিত্তিক গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র প্রাক্তন কর্মকর্তারা অভ্যুত্থান শুরু হওয়ার পর থেকেই সিএনএন-এ তুরস্কে সেনা অভ্যুত্থান চেষ্টার বিভিন্ন দুর্বলতা নিয়ে আলোচনা করতে থাকেন। অভ্যুত্থান সফল করতে না পারায় সেনা সদস্যদের প্রতি খানিকটা অসন্তুষ্টও মনে হচ্ছিল একাধিক আলোচককে।
সিআইএ’র অভিজ্ঞ সাবেক কর্মকর্তা রবার্ট বেয়ার নিজেই এককালে সেনা অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলেন। বেয়ারের মতে, তুরস্কের সেনা অভ্যুত্থানটি পেশাদারিত্বের সঙ্গে পরিচালিত হয়নি।
‘তাদের উচিৎ ছিল সিএনএন তুর্ক-এর দখল নিয়ে সাথে সাথেই সেটি এবং পাশাপাশি রেডিও স্টেশন, সামাজিক মাধ্যম ও ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া। প্রেসিডেন্ট এরদোগানকে তখন গ্রেফতার না করলেও এ জিনিসগুলো প্রথমেই দখলে নেয়া উচিৎ ছিল।’
সব উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সমর্থন না থাকাও বিদ্রোহের একটি সীমাবদ্ধতা ছিল বলে মনে করেন বেয়ার। তবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এগোলে ভবিষ্যতেও আবার তুরস্কে অভ্যুত্থান ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে বলে ধারণা বেয়ারের, এবং সেটি তখন অভ্যুত্থান নয়, হবে গৃহযুদ্ধ।
আরেক সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা জেমস উলসির মতে, অভ্যুত্থানের ব্যর্থতার জন্য পরিকল্পনাকারীদের কৌশলগত ভুলই দায়ী। অভ্যুত্থানকারীদের পরিস্থিতি অনুযায়ী বারবার কৌশল পরিবর্তনের সামর্থ্য থাকতে হয়, যা তুরস্কের পরিকল্পনাকারীদের ছিল না।
অন্যদিকে অভ্যুত্থানকে নিরুৎসাহিত করলেও সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল ওয়েসলি ক্লার্ক মনে করেন, অভ্যুত্থান করতে হলে সেটা সত্যিই মন থেকে চাইতে হবে। সন্দেহ থাকলে অভ্যুত্থান সফল হয় না।
ইসরাইল বলছে, সেনা অভ্যুত্থানের ব্যর্থ চেষ্টাটি তুরস্ক-ইসরাইলের সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে না। তবে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান ক্ষমতাচ্যুত হলেও কষ্ট পেত না জেরুজালেম।
ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম জেরুজালেম পোস্ট বিশ্লেষণে জানায়, প্রেসিডেন্ট এরদোগান বহু বছর ধরেই তার প্রশাসনের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করার অভিযোগে সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোর স্বাধীন কার্যক্রমে বাধা দিয়ে আসছিলেন। অথচ এই সামাজিক নেটওয়ার্কগুলোই অভ্যুত্থান ঠেকাতে তাকে সাহায্য করেছে। নিজের প্রথমে স্মার্টফোনে ইন্টারনেট ব্যবহার করে এবং পরে তার ঘৃণিত গণমাধ্যমের সাহায্যেই এরদোগান জনগণের কাছে নিজের বার্তা পাঠিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘অভ্যুত্থানের পরিকল্পনাটা বেশ ভালোই ছিল, কিন্তু এর জন্য কৌশল ব্যবহৃত হয়েছে ১৯৭০ এর দশকের।’
তুর্কি বিশ্লেষক সিনান উলগেন বলেন, সেনাবাহিনীর চেইন অব কমান্ডের বাইরে গিয়ে চেষ্টা করায় বিদ্রোহীরা অনেক ক্ষমতা আর সুযোগ হাতে পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। উচ্চপদস্থদের সহায়তা না পাওয়ায় নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতের বাইরে চলে যায়। বিদ্রোহীরা কোনো সামরিক স্থাপনা বা তুরস্কের কোনো রাজনৈতিক নেতাকেও জিম্মি করতে পারেনি। এটাও অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ার একটি বিরাট কারণ।
তুরস্কের ব্যর্থ অভ্যুত্থান ও ভূ-রাজনীতি
১৯২৩ সালে মুস্তফা কামাল আতাতুর্ক গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদ এবং কট্টর ধর্মনিরপেক্ষতার (কামালিজম) ওপর ভিত্তি করে আধুনিক তুর্কি প্রজাতন্ত্র গঠন করেন। তুর্কি সেনাবাহিনী সবসময়ই নিজেদের কামালিজমের রক্ষাকর্তা হিসেবে ভেবে এসেছে। এই চিন্তাধারা থেকেই ১৯৬০ থেকে এখন পর্যন্ত তুরস্কের চারটি ইসলামি ভাবধারার সরকারের পতন ঘটিয়েছে তারা।
প্রেসিডেন্ট এরদোগানের ইসলামি দলের শাসনের মাঝেও এত বছর চুপ থাকার পর এতদিনে সেনাবাহিনীর একটি চেষ্টা, হোক সে ব্যর্থ, এটাই তুলে ধরে, সেনাবাহিনীর কিছু অংশ এখনো তাদের আগের নৈতিকতাতেই বিশ্বাস করে।
ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনার পর জনগণসহ বিরোধী কয়েকটি রাজনৈতিক নেতৃত্ব অনেকটাই এরদোগানের পক্ষে চলে গেছে। এতে এরদোগানের শক্তি বেড়ে গেছে বলে অনেকে মনে করছেন। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হওয়ায় অভ্যুত্থানকারীদের কঠোর শাস্তি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন এরদোগান।
সূত্র : ওয়েব সাইট