কাবুল বিমানবন্দরের দায়িত্ব নিলে তুরস্কের কী লাভ হবে?
কাবুল বিমানবন্দরের দায়িত্ব নিলে তুরস্কের কী লাভ হবে? - ছবি সংগৃহীত
তালেবানের উৎখাত করতে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোট যে হামলা শুরু করেছিল আজ তারা নিজেরাই তাতে উৎখাত হয়ে রাতের আঁধারে বাগরাম বিমানবন্দর ত্যাগ করেছে গত ১লা জুলাই। যুক্তরাষ্ট্রের সেনাপ্রত্যাহারের পর থেকে কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বিধান ও পরিচালনার প্রস্তাব আঙ্কারা দিয়েছে মে মাসে ন্যাটোর সভায়। যুক্তরাষ্ট্র এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানায়। সমালোচকরা বলছেন, এই পদক্ষেপ ওয়াশিংটন-আঙ্কারা সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ করবে।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের মাঝে অনেক বিষয় নিয়ে মতবিরোধ। যেমন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পিকেকে/ওয়াইপিজিকে সহায়তা যাদের তুরস্ক ‘টেররিস্ট’ আখ্যা দিয়েছে; ইসরাইল-ফিলিস্তিন সমস্যা নিয়ে মতবিরোধ, তুরস্কের স্টেট ব্যাংক নিয়ে ওয়াশিংটনের অভিযোগ, এস ৪০০ ক্রয়সহ দীর্ঘ ফিরিস্তি।
তুর্কিদের ধারায় ইউরো এশিয়ান বিভিন্ন সাংস্কৃতিক-ঐতিহাসিক চরিত্র মিশে আছে। ‘তুর্ক’ বলতে মূলত তাতার, কিরগিজ, উজবেক, তুর্কমেন ও বর্তমান তুরস্কের জনমানুষকে বোঝায়। ঐতিহাসিকরা বলে থাকেন, তুর্কিদের মাতৃভূমি মধ্য এশিয়ায়। অবলুপ্ত আরো অনেক ছোট ছোট তুর্কি জনগোষ্ঠী রয়েছে, যারা বড় জাতিগোষ্ঠীর সাথে মিশে গেছে। ঐতিহাসিকরা আরো বলেন, তুর্কিরা মধ্য এশিয়া থেকে সাইবেরিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ন এলাকায় বসবাস করেছে, এদের বড় এক অংশ চীনেও বসবাস করেছে। মধ্য এশিয়ার দেশগুলো ছাড়াও ক্রিমিয়া, ইউক্রেন, চীন, উত্তর ইরাক, ইরান, ইসরাইল, রাশিয়া, আফগানিস্তান, সাইপ্রাস, বুলগেরিয়া ও রোমানিয়ায়ও এরা বসবাসরত। লিথুয়ানিয়া, পূর্ব পোল্যান্ড, ফিনল্যান্ডে সংখ্যলঘু হিসেবে এবং জার্মানিতে উদ্বাস্তু হয়ে ও পরে নাগরিকত্ব নিয়ে তাদের অনেকে বসবাস করছে।
আফগানিস্তানে তুরস্কের ৫ শতাধিক সেনা এয়ারপোর্ট অপারেশনের কাজ পরিচালনা করছে। তালেবান বলছে, ন্যাটো বাহিনীর সাথে তুরস্কের কোনো পার্থক্য নেই, তাদেরও আফগানিস্তান ছাড়তে হবে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, সেনা প্রত্যাহারের এই চরম সময়ে কাবুল বিমানবন্দরের সুরক্ষার জন্য তুরস্কের পক্ষেই কাজটি সহজ। মনে রাখা প্রয়োজন, যদি কাবুল বিমানবন্দর নিরাপত্তার কোনো চুক্তি স্বাক্ষরিত না হয় তবে বিমানবন্দরটি যুক্তরাষ্ট্রের সাপোর্ট মিশনের হাতেই যাবে। তখন শতভাগ সেনা প্রত্যাহার প্রশ্নের মুখে পড়বে। বিমানবন্দর পাহারার জন্য কমপক্ষে এক হাজার সেনা সদস্য দরকার। নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ ছাড়া বিমানবন্দরে অপারেশন করা অসম্ভব। তালেবানদের এরকম হাইটেক লোকজন নেই। যুদ্ধ করা ও বিমানবন্দর অপারেট করা দুটি ভিন্ন বিষয়। যদি দেশে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, সেখানে বিমানবন্দরও মুখ্য ভূমিকায় থাকবে। এখন তুরস্ক কাবুলের এই সমস্যার সমাধান দিতে পারে, পরে কাবুল-প্রশাসনের হাতে এর দায়ভার তুলে দিতে পারে। কাবুল-আঙ্কারা সুমধুর সম্পর্ক সেই ১৯৮২ সাল থেকে। যদি এভাবে পথচলা না হয় তবে পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব আজিজ আহমদের মতে, কাবুলে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়ে গৃহযুদ্ধ শুরু হতে পারে। পাকিস্তানের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কোরেশী পাওয়ার শেয়ারিং-এর কথা বলেছেন, ‘নতুবা গৃহযুদ্ধ ঠেকানো যাবে না’।
কাবুলে তুরস্কের যে সব ফোর্স রয়েছে তারা কোনো যোদ্ধা শ্রেণীর নয়। দায়িত্ব পেলে তুরস্ককে সেনা বদল করতে হবে। এই মিশনে যুক্তরাষ্ট্রেরও সার্বিক সহায়তা দরকার। জানা যায়, এই কাজে পেন্টাগনের কর্মকর্তারা এখন আঙ্কারায় অবস্থান করছেন। তুর্কি পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তারা এর মধ্যে কিরগিজস্তান ও তাজিকিস্তান সফর করেছেন। তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগান কাবুল মিশনে কাজ করার আগে কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছেন, সেগুলো না মেটা পর্যন্ত এই বিষয়ে চূড়ান্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। যেমন- মিশনের কাজ করার বিষয়ে আরো কিছু দেশের লজিস্টিক সহায়তার জন্য তুরস্ক কথাবার্তা চূড়ান্ত করেছে। তা ছাড়া ন্যাটো সদর দফতর ও জাতিসঙ্ঘের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত চেয়েছে। তখন তুরস্ক অনেকটা স্বাধীনভাবে আফগান সরকারের সাথে চুক্তি করতে পারবে। তুরস্কের পররাষ্ট্র দফতর আফগানিস্তানকে ‘সিস্টার দেশ’ মনে করে। আফগানিস্তানে শান্তি, স্থায়িত্ব ও প্রগতির জন্য তুরস্ক সবসময় কাজ করতে প্রস্তুত। কাবুল মিশনে এরদোগান পাকিস্তান এবং হাঙ্গেরিও অন্তর্ভুক্ত হোক- এমনটি চাইছেন। সেনা প্রত্যাহার করা হলেও কমপক্ষে ৬০০ কমান্ডো সেনা কাবুলে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল আয়তনের কূটনৈতিক কম্পাউন্ডের নিরাপত্তার জন্য পেন্টাগন রেখে দেবে।
এমন সমস্যাসঙ্কুল মিশন পালনে তুরস্কের কিছু সুবিধা আছে মর্মে বিশ্লেষকরা বলছেন। কাবুল বিমানবন্দরকে তুরস্ক ২০১৩ সাল থেকে নিরাপত্তা দিয়ে আসছে। তুরস্ক কি এখনো পারবে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বজায় রাখতে? ইস্তাম্বুলের মুরাদ আসলান, নিরাপত্তা গবেষক জানান, সেটি নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর। কাবুল বিমানবন্দরটির চারিদিকে পবর্তশ্রেণী ও পাহাড়। যদি তালেবানরা কাবুল দখল করে নেয় তবে বিমানবন্দর পাহারা দেয়া শুধু তুরস্ক কেন, অন্য যেকোনো দেশের বা কাবুল সরকারের জন্য খুবই বিপজ্জনক হবে। যদি তালেবানদের সাথে বোঝাপড়া হয় তাহলে তুর্কি মিশন ভালো করতে পারে। এদিকে তুর্কি বাহিনীকে যুক্তরাষ্ট্র সব ধরনের ‘ইন্টেলিজেন্স’ সরবরাহ করবে বলে জানিয়েছে। তালেবানরা মনে করে, তুরস্ক ন্যাটোর একটি অংশ; তারা কেন ছাড় পাবে?
ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে দেখা যাবে, তুরস্ক আফগানদের স্বার্থ দেখে আসছে এবং তাদের সাথে ভালো সম্পর্কও রেখেছে। ন্যাটো জোটের সদস্য হলেও তুরস্ক তালেবানের বা আফগানিস্তানের কোনো ক্ষতি চায়নি এবং এমন কোনো কাজের সাথে জড়িত নয়। তালেবান ইতঃপূর্বে শাসন করার সময় তৈরি করা সংবিধানকে আরো পরিমার্জিত করে এবার উপস্থাপন করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। তুরস্ক এসব কিছুতে জড়াতে চাইছে না এবং রাজনীতিতেও হস্তক্ষেপ করতে চাইছে না। আফগানিস্তানে স্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত উভয় পক্ষের সাথে তুরস্ককে ‘ব্যালেন্স’ করে চলতে হবে; কোনো ভুল করা যাবে না।
তালেবানের ভেতরও বড় সমস্যা আছে, তাদের মাঝে রয়েছে বহু নৃতাত্ত্বিক দল ও ধর্মীয় মতবিরোধসম্পন্ন জঙ্গি গোষ্ঠী। তারা মূল তালেবানের সব কাজকে সমর্থন করে, এমন নয়। তালেবানের প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি থাকলে হয়তো সবাইকে মিলিত করা সম্ভব হবে। তালেবানে এখন উজবেক ও তাজিক গ্রুপগুলোও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তুরস্কের সাথে পাকিস্তানের বহু আগে থেকে ঐতিহাসিক বন্ধন রয়েছে। তালেবানদের ওপর পাকিস্তানেরও বড় কর্তৃত্ব রয়েছে। এসব ফ্যাক্টর এখন গুরুত্বপূর্ণ। এই দুই দেশের সাথে কাতারের সম্পর্ক বেশি। তালেবানরা এসব ঝেড়ে ফেলে দিতে পারে না। কাতার, তুরস্ক ও পাকিস্তান তালেবানদের কোনো সমস্যা নিয়ে মধ্যস্থতা করলে বা কোনো অনুরোধ জানালে তালেবানরা রক্ষা করবে এমনই মনে করা হচ্ছে।
বিগত শতাব্দীতে আফগানিস্তানে ব্রিটিশদের দুর্গ ছিল। বিংশ শতাব্দীতে তদানীন্তন সোভিয়েতরা ঢুকে পড়ে। ২০১০ সালে আফগানিস্তানে আমেরিকার ৭০০ বড় ও ছোট সেনাছাউনি ছিল। এসব ছাউনির প্রায় রসদপত্র ও গোলাবারুদ বাইরে থেকে সরবরাহ করা হতো। বতর্মানে আফগানিস্তানে আমেরিকার ও মিত্রদের ৪০০ সেনা ঘাঁটি রয়েছে। কিছু ঘাঁটি অনেক বড়। যেমন- কান্দাহার বিমানঘাঁটি। এখানে সর্বক্ষণ আমেরিকার যুদ্ধবিমান উঠা-নামা করে। এখান থেকে বিশ্বের অন্যান্য স্থানেও আমেরিকার যুদ্ধবিমান যাতায়াত করে। এই বিমানঘাঁটিকে বিশ্বের ব্যস্ততম সামরিক বিমানঘাঁটিগুলোর একটি হিসেবে ধরা হয় যার কোনো হিসাব-নিকাশ ও নিয়ন্ত্রণ আফগান সরকারের হাতে নেই, এটি যেন এক স্বাধীন এলাকা। বাগরাম বিমানঘাঁটিও তেমন একটি। এখানে সোভিয়েত ইউনিয়নও ঘাঁটি গেড়েছিল। সেখানে আমেরিকার সেনা কত ছিল তার সঠিক তথ্য প্রচার করা হয়নি, মিডিয়ার কাছেও এর সঠিক তথ্য নেই। তবে জানা যায়, বাগরামে ২০ হাজার সেনা ছিল। রাতের আঁধারে তাদের ঘাঁটি ত্যাগ করার অন্যতম কারণ হলো- প্রকৃত সেনা সংখ্যা যেন মিডিয়ায় না যায়। বাগরাম ঘাঁটি আধুনিকীকরণের জন্য ওয়াশিংটন ২০০ মিলিয়ন ডলারের প্রজেক্ট হাতে নিয়েছিল আরো আধুনিক অ্যাপ্রন স্পেস, কার্গো হেলিকপ্টার অ্যাপ্রন, টেকটিক্যাল এয়ারলিফট অ্যাপ্রন নির্মাণের। অন্য বড় ঘাঁটিগুলোতে এবং কান্দাহারেও এমন প্রকল্প নেয়া হয়েছে। অতিরিক্ত ৩০ হাজার সেনা ও এক হাজার ন্যাটো সেনার অবস্থানের জন্যও কান্দাহারকে আপগ্রেড করা হয়েছে এবং ১২টি সেনাছাউনি তৈরি করা হয়েছে। সেদেশে নামকরা আরো সেনা ঘাঁটি আছে- পাকতিয়া, হিরাত এবং মাজার-ই শরিফ।
কাবুল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি যত না মানুষ পরিবহন করে, তার চেয়ে ঢের বেশি সামরিক কাজে ব্যবহৃত হয়। বাইরের পৃথিবী মনে করে কাবুল বিমানবন্দর নিয়ন্ত্রণ মানে, আফগানিস্তান নিয়ন্ত্রণ। আফগান সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ বন্দরের এয়ার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ন্যাটো বাহিনীর কাছ থেকে তাদের নিয়ন্ত্রণে দেয়ার অনুরোধ করেছিল। বিমানবন্দরের নিরাপত্তার সাথে বিদেশী কূটনৈতিক মিশনের নিরাপত্তা জড়িত বিধায় বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ কারণে অস্ট্রেলিয়া তাদের দূতাবাস আগেভাগে বন্ধ করে দেয়। অনিরাপদ ঘাঁটি দিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠান মানবিক সহায়তা নিয়ে আফগানিস্তানে আসবে না। এতদসত্ত্বেও তুরস্কের প্রস্তাবে তালেবানরা প্রাথমিকভাবে রাজি হয়নি। কিভাবে এর সমাধান হবে তার বেশির ভাগ নির্ভর করছে আঙ্কারা ও কাবুল সরকারের সাথে তালেবানদের বোঝাপড়ার ওপর। এখন পর্যন্ত তালেবানরা এলাকার পর এলাকা দখল করছে আর আফগান সরকারি বাহিনীও তালেবানদের হত্যা করছে। সুতরাং বিষয়টি যেকোনো দিকে গড়াতে পারে। ব্যাপক গৃহযুদ্ধও একটি পরিণতি। শান্তি সেখানে দিল্লি দূরঅস্তের মতোই।
তুরস্কের জন্য বড় প্রশ্ন হলো- কিভাবে সেনারা দায়িত্ব পালন করবে, বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বিধান করবে, দূতাবাস দেখভাল করবে, আরো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোও নজরদারি করবে, কোনো সামরিক প্যাট্রোলিং ছাড়া তা সম্ভব নয়। কেননা, বর্ণিত বিষয়গুলো সামরিক প্যাট্রোলিং ও ‘কমব্যাট টাস্ক’। ন্যাটো জোটের একমাত্র মুসলিম দেশ, তুরস্ক হওয়ায় তালেবানরা তুরস্কের ব্যাপারে নমনীয়। পুরনো বন্ধুত্ব এবং ধর্মীয় সংশ্লিষ্টতা তুরস্ককে আফগানিস্তানে অনেক রাজনৈতিক ও সামাজিক সুবিধা এনে দিয়েছে। তুর্কি সেনারা যেখানেই গেছে সেখানে ভালো সমাদর পেয়েছে। ওয়াশিংটনের সাথে তুরস্ক সম্পর্কের জন্য ‘সফট পাওয়ার’ ব্যবহার করতে চায়। এরদোগানের এই উচ্চাভিলাষী মিশন সাবধানতা ও বুদ্ধিমত্তা সাথে পরিচালনা করা না গেলে মাঝপথে পীড়াদায়ক দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে পারে।
আঙ্কারা দুটি বিষয় সাবধানতার সাথে পর্যবেক্ষণ করতে হবে সেটি হলো- আফগান ইস্যুতে অন্যান্য দৃশ্যমান ও নেপথ্যের নায়কদের সঠিকভাবে বিশ্লেষণে রাখা। এর মধ্যে পাকিস্তান গুরুত্বপূর্ণ, আফগানিস্তানের সাথে পাকিস্তানের সীমান্ত বিরোধ রয়েছে, পাকিস্তানে থাকা পশতুন জনগোষ্ঠীর সংখ্যা আফগান ভূমিতে থাকা পশতুনের চেয়ে বেশি। তালেবানের ‘মৌলপন্থী’রা পশতুন। তারা মিলে স্বাধীন পশতুনিস্তান বানাতে চায়, এটি তাদের দু’দশকের লালিত ইচ্ছা। পাকিস্তান নিজেদের পশতুনকে শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করছে। এদের অঞ্চলটি সীমান্তের দিকে অবস্থিত। আফগানিস্তানের পশতুন বন্ধুরা সহজে সীমান্তে মিলিত হয়ে প্রীতির বন্ধন গড়ে তুলেছে। এরাও কৌশলগত সুযোগের অপেক্ষায়। কাবুলের সাথে পাকিস্তানের চলমান পানি বিরোধও বড় এক সমস্যা। পানিবিরোধের কারণে কাবুলের ভারতমুখিতা বৃদ্ধি পেয়েছে। তুরস্কের বিমানবন্দর পাহারায় পাকিস্তান কতটুকু কাজে আসবে সেটি ভবিষ্যৎ জানান দেবে। এর পর আসছে ইরান। ইরানপন্থী বিদ্রোহী যোদ্ধারা আফগানিস্তানে খুব তৎপর। এরা তালেবানদের প্রতি অনুরক্ত। ইরান তাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দিয়ে থাকে। রাশিয়া পজিটিভ না হলেও তুরস্ক আফগানিস্তানে দক্ষতার সাথে কাজ করুক চীন তা কামনা করে; বেল্ট ও রোড প্রকল্পে প্রচুর বিনিযোগ রয়েছে চীনের।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো- ন্যাটো সদস্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পরই তুরস্কের গুরুত্ব। আফগানিস্তানে তুরস্ক থেকে যাওয়া মানে, ন্যাটো থেকে যাওয়া। সে জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অফারটি এক ধরনের ‘হট কেক’। তুরস্ক এই কাজে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক নতুন লেভেলে পৌঁছবে এবং বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। বৈশ্বিক গেম প্লে করার জন্য তুরস্কের এবং এরদোগানের নিজের জন্য লেভেলটি এখন প্রয়োজন।
আফগানিস্তানে কিছু ভেতরের সমস্যা কাজ করছে। সেটি পপি চাষ ও ড্রাগ চোরাচালান করা। বিভিন্ন জিনিস ক্রসবর্ডার চোরাচালানের জন্য আফগান সীমান্তগুলো ‘বিখ্যাত’ হয়ে আছে। হাজার হাজার দরিদ্র পরিবার এই ব্যবসা করে সংসার চালায়। এসব রাতারাতি বন্ধ করা সম্ভব নয়। তালেবানের আগমনে নারী সমাজ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। উত্তর আফগানিস্তানে নারীবাদীরা অস্ত্র নিয়ে তালেবানবিরোধী যুদ্ধে নেমে পড়েছে মর্মে ভারতীয় একটি সংস্থা খবর দিয়েছে। তালেবানরা শক্তি দিয়ে দেশ শাসন করতে চাইলে গৃহযুদ্ধ অনিবার্য। তখন গুরুত্বপূর্ণ বিমানঘাঁটিতে তুরস্কের সেনাদের পক্ষে কাজ চালিয়ে যাওয়া বিপজ্জনক হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের মতে, আফগান সেনাবাহিনী অনেক দক্ষ ও প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী। ৭৫ হাজার তালেবান সেনার চাইতে অনেক বড় আকারের। তিন লাখের উপর আফগান বাহিনী, যারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। এখন আফগান সেনা ও তালেবানদের মধ্যে বিভিন্ন স্থানে তুমুল লড়াই চলছে। প্রকৃত অর্থে এটাই গৃহযুদ্ধ।
কাবুল বিমানবন্দরের নিরাপত্তা দেয়ার প্রস্তাবটি তুরস্কের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের যতুটুকু প্রচেষ্টা-ফসল, তার চেয়েও বেশি ‘রিস্কি’ মনে করা হচ্ছে। আঞ্চলিক দেশগুলোর সাথে তুরস্কের সম্পর্কের পারদও খাদে নামতে পারে। বাইডেনের সাথে আলোচনায় এরদোগান বলে দিয়েছেন, এই মিশনে আফগানদের সম্মতি না পেলে এবং যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক ও আর্থিক বরাদ্দ না পেলে তুরস্ক না-ও এগুতে পারে। তুরস্ক আফগানিস্তানে সেনা রাখলেও কোনো যুদ্ধে তারা অংশগ্রহণ করেনি, কোনো বুলেট তাদের বন্দুকের নল দিয়ে বের হয়নি। সব কিছু অনুকূলে থাকলেও আঙ্কারাকে ‘দুবার’ ভাবতে হবে দায়িত্ব পালন করবে কি না। সাবধান থাকতে হবে; কেননা, আফগানিস্তান কোনো সিরিয়া, লিবিয়া বা নাগরনো-কারাবাখ নয়। আফগানিস্তান সবসময়ই ‘বিদেশী সাম্রাজ্যের কবরস্থান’ হিসেবে পরিচিত।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত যুগ্ম সচিব ও গ্রন্থকার