জিঙ্ক বেশি খেলে হতে পারে যেসব বিপদ
জিঙ্ক বেশি খেলে হতে পারে যেসব বিপদ - ছবি : সংগৃহীত
• সাধারণ মানুষকে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া জিঙ্ক ক্যাপসুল বা ট্যাবলেট খেতে নিষেধ করা হচ্ছে। অথচ কোভিড রোগীকে যে জিঙ্ক দেয়া হচ্ছে?
•• বহু করোনা রোগীর দেহে সাইটোকাইন স্টর্ম লক্ষ করা যাচ্ছে। এর মূল কারণ হলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অতিসক্রিয়তা। এর মধ্যে ইন্টারলিউকিন নামক সাইটোকাইন কোভিড রোগীর পক্ষে খুবই বিপজ্জনক প্রমাণিত হচ্ছে। সাধারণভাবে মানব দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার অস্ত্র হিসেবে সাইটোকাইন বহিরাগত শত্রুকে ধ্বংস করে। মুশকিল হলো, উপকারী সাইটোকাইন অতিসক্রিয়তা দেখাতে শুরু করলে বিপদ। তখন সে নিজের দেহের অঙ্গের কোষগুলোকেই ধ্বংস করতে থাকে। কোভিড রোগীর ক্ষেত্রে সাইটোকাইম স্টর্মের তাৎক্ষণিক কুপ্রভাব দেখা যাচ্ছে ফুসফুসে। সাইটোকাইন স্টর্মের কারণে ফুসফুসের ভাইরাস আক্রান্ত কোষের সঙ্গে সুস্থ কোষগুলিও ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
এখন কোভিড রোগীর দেহে সাইটোকাইন স্টর্ম আটকানোর জন্য চিকিৎসকদের হাতে দু’খানি উপায় আছে। এক, সাইটোকাইন স্টর্ম-এর লক্ষণ দেখা মাত্র স্টেরয়েড প্রয়োগ করা। স্টেরয়েড রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে খানিকটা লঘু করে। ফলে সাইটোকাইন স্টর্ম হয় না।
দ্বিতীয়ত, রোগীর কোভিড হয়েছে সন্দেহ হওয়া মাত্র আগে থেকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া। প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা বলতে রয়েছে রোগীকে আলাদা করে জিঙ্ক সাপ্লিমেন্ট দেয়া। দেখা গিয়েছে, ইন্টারলিউকনকে কিছুটা হলেও প্রতিরোধ করতে পারে জিঙ্ক নামের খনিজটি।
জিঙ্কয়ের কাজ এখানেই শেষ হয় না। দস্তা বা জিঙ্ক আমাদের দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে তুলতেও সাহায্য করে। এটি করোনা রোগীর প্রতিরোধ ক্ষমতার সক্রিয়তা নিয়ন্ত্রণে রাখতেও সাহায্য করে। আরো অনেক জরুরি কাজ রয়েছে জিঙ্কের। যেমন- দেহের নানা উৎসেচকের মধ্যে সমতা বিধান করতে সাহায্য করে। জিনের গঠন, ক্ষত নিরাময়ে জরুরি। এই কারণে জিঙ্ককে বলা হয় এসেনশিয়াল মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টস। জিঙ্ক শরীরে তৈরি হয় না। খাদ্যের মাধ্যমে ঢোকে ও চাহিদা পূরণ হয়। তবে কোভিড রোগীর ক্ষেত্রে আলাদা করে ক্যাপসুল বা ট্যাবলেট খেতে হয়।
• কেউ কেউ বলছেন জিঙ্কের সঙ্গে মিউকরমাইকোসিস হওয়ার যোগ রয়েছে?
•• কিছু কিছু গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, একটা বড় অংশের রোগী কোভিড সেরে যাওয়ার পরও জিঙ্ক সাপ্লিমেন্ট সেবন করছিলেন এবং তাদের অনেকেই মিউকরমাইকোসিসে আক্রান্তও হয়েছিলেন। এই ধরনের গবেষণা থেকে জিঙ্ক এবং মিউকরমাইকোসিসের মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে কিনা বোঝার চেষ্টা করা হচ্ছে। কিছু কিছু গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়েছে, বেশি মাত্রায় জিঙ্ক-এর উপস্থিতির কারণে এই ছত্রাক বেড়ে ওঠার সুযোগ পাচ্ছে। এই কারণেই কোভিড সেরে যাওয়ার পর জিঙ্ক সাপ্লিমেন্ট খাওয়া বন্ধ করে দিতে বলা হচ্ছে। তবে গবেষণাগুলি এখনও বিস্তারিতভাবে সবটুকু ব্যাখ্যা করতে পারছে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, মিউকরমাইকোসিস একটি ছত্রাক সংক্রমণ। মানবশরীরে যে কোনও ছত্রাক সংক্রমণ হয় দেহের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়লে।
• কোনো ব্যক্তির শরীরে জিঙ্কের অভাব হচ্ছে বোঝা যাবে কীভাবে?
•• ক্ষত শুকোতে না চাইলে, বারবার ঠান্ডা লাগলে, সংক্রমণ হলে, জিভের স্বাদ কমে গেলে, চুল পড়ে গেলে, বুঝতে হবে শরীরে জিঙ্কের ঘাটতি হচ্ছে।
• মানব শরীরে জিঙ্কের স্বাভাবিক মাত্রা কত?
•• সাধারণভাবে বলা যায় প্রতি মিলিলিটার রক্তে জিঙ্কের স্বাভাবিক মাত্রা ০.৬৬ থেকে ১.১০ মাইক্রোগ্রাম। তবে ১০ বছর বা তার এই বয়সের নীচে বাচ্চার ক্ষেত্রে রক্তে জিঙ্কের স্বাভাবিক মাত্রা একটু বেশি হওয়া দরকার।
• রোজ আমাদের কত মাত্রায় জিঙ্ক দরকার পড়ে?
•• প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের রোজ ১১ মিলিগ্রাম জিঙ্ক দরকার পড়ে। প্রাপ্তবয়স্ক মহিলার দরকার ৮ মিলিগ্রাম। তবে বয়স এবং শারীরিক পরিস্থিতি অনুযায়ী চাহিদা কমবেশি হতে পারে।
• কাদের জিঙ্ক-এর অভাবে ভোগার আশঙ্কা বেশি থাকে?
•• মদ্যপানে আসক্ত, সম্পূর্ণ নিরামিষাশী, ক্রোনজ ডিজিজ-এর রোগী, কিডনির রোগী, ক্রনিক ডায়ারিয়া হতে থাকলে রোগীর দেহে জিঙ্কের অভাব হতে পারে। আবার সঠিক পুষ্টিকর খাদ্যগ্রহণের অভাবেও জিঙ্ক ডেফিশিয়েন্সি দেখা দিতে পারে। আমরা দেখেছি সত্তরোর্ধ্ব ব্যক্তি যার দাঁত পড়ে গিয়েছে, ভালো করে পুষ্টিকর শক্ত খাদ্য চিবিয়ে খেতে পারেন না। ফলে তার শরীরেও জিঙ্কের অভাব দেখা দেয়। সন্তানসম্ভবা ও বুকের দুধ খাওয়ানো মায়েদের রোজ জিঙ্ক-এর চাহিদা বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে জিঙ্ক সাপ্লিমেন্ট দিতে হতে পারে। তবে সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক অবস্থায় খাদ্যের মাধ্যমে শরীরে জিঙ্ক ঢুকলেই ভালো।
• কোন কোন খাদ্যে জিঙ্ক বেশি থাকে?
•• ডিম, চিংড়ি, গোশতের মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে জিঙ্ক থাকে। ওটস, ভুট্টা, ব্রাউন রাইস, মাশরুম, দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্যদ্রব্যেও প্রচুর জিঙ্ক আছে।
• প্রয়োজনের তুলনায় বেশি মাত্রায় জিঙ্ক গ্রহণ করলে কী হতে পারে?
•• দুর্বল বোধ হয়, বমি বমি ভাব দেখা যায়, ডায়ারিয়া হতে পারে। পেট ব্যথার মতো উপসর্গও দেখা দিতে পারে। এছাড়া বেশিমাত্রায় জিঙ্ক গ্রহণ করলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সঠিকভাবে সক্রিয় হতে পারে না। কারণ জিঙ্কের আধিক্যে নানা এনজাইমের ক্রিয়াশীলতা নষ্ট হয়। এই এনজাইমগুলোই রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা সচল রাখে। এই কারণে সাধারণ মানুষকে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া আলাদা করে জিঙ্ক ট্যাবলেট বা ক্যাপসুল খেতে নিষেধ করা হয়।
লেখক : বিশিষ্ট ফার্মাকোলজিস্ট
সূত্র : বর্তমান