পাকিস্তানে চীনাদের ওপর হামলা : কাকতালীয় নাকি জটিল ভূরাজনীতি?
পাকিস্তানে চীনাদের ওপর হামলা : কাকতালীয় নাকি জটিল ভূরাজনীতি? - ছবি : সংগৃহীত
চীনারা পাকিস্তানের মাটিতে 'চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর' সংক্ষেপে যা সিপিইসি নামে পরিচিত এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। করিডরটি চীনের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর কাশগড় (জিনজিয়াং তথা পূর্ব তুর্কিস্তানের রাজধানী) থেকে শুরু হয়ে পুরো পাকিস্তানকে লম্বভাবে ছেদ করে বেলুচিস্তানের গোয়াদর বন্দরে (বন্দরটি আরব সাগরের তীরে অবস্থিত) গিয়ে শেষ হবে।
সিপিইসি প্রকল্পটি অন্য ১০টি সাধারণ বৈদেশিক বিনিয়োগের মতো নয়। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত করতে পারলে এই অঞ্চলের সামগ্রিক ভূরাজনীতি নতুন করে মোড় নেবে। আর এই প্রকল্পের সবচেয়ে বড় সুবিধা পাবে চীন ও পাকিস্তান। স্বাভাবিকভাবেই এই দুই দেশের প্রতিপক্ষ দেশগুলোর জন্য এই সিপিইসি প্রকল্পটি স্বস্তিদায়ক হিসেবে বিবেচিত হবে না।
১.
সিপিইসি প্রকল্পে চীনের লাভ কী?
চীন তার বৈদেশিক বাণিজ্যের উল্লেখযোগ্য অংশ সম্পাদন করে আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সাথে। বর্তমানে এই দুই অঞ্চলে যেতে হলে চীনকে পাড়ি দিতে হয় দক্ষিণ চীন সাগর-মালাক্কা প্রণালী-বঙ্গোপসাগর-ভারত মহাসাগরের বিশাল এক পথ।
বর্তমানে চীনের রাজধানী বেইজিং থেকে পারস্য উপসাগরে (সমুদ্রপথে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রবেশপথ) প্রবেশ করতে পাড়ি দিতে হয় প্রায় ১৩ হাজার কিলোমিটার পথ। অপরদিকে পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে সিপিইসি করিডর দিয়ে বেইজিং থেকে পারস্য উপসাগরে যেতে পাড়ি দিতে হবে মাত্র সাড়ে ছয় হাজার কিলোমিটার পথ। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক পথ কমে যাবে সিপিইসি করিডর বাস্তবায়িত হলে।
চীনের বেশিরভাগ শিল্পায়ন হয়েছে পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চলগুলোতে। বেইজিং, সাংহাইসহ সব উন্নত চীনা শহর দেশটির পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত। দেশটির পশ্চিম প্রান্ত থেকে সমুদ্রপথ দূরে হওয়ায় তেমন শিল্প গড়ে উঠেনি।
কিন্তু সিপিইসি প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর কাশগড় থেকে পারস্য উপসাগরে যেতে পাড়ি দিতে হবে মাত্র আড়াই হাজার কিলোমিটার পথ। বর্তমানে কাশগড় থেকে বেইজিংয়ের দূরত্ব প্রায় চার হাজার কিলোমিটার। আর এদিকে সিপিইসির মাধ্যমে বেইজিং-কাশগড় পথের তুলনায় কাশগড়-মধ্যপ্রাচ্যের দূরত্ব কম হবে। অর্থাৎ বলা যায়, সিপিইসির মাধ্যমে কম সময়ে মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় প্রবেশের রুট পাওয়ায় চীনের পশ্চিমাঞ্চলে শিল্প ও বাণিজ্য ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পাবে।
শুধুমাত্র বাণিজ্যিক রুটের দূরত্ব কমার মধ্য দিয়ে এ প্রকল্প থেকে চীন লাভবান হবে ব্যাপারটা এমন না। চীনের বাণিজ্য রুটের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিপিইসি প্রকল্প। কারণ সিপিইসি বাস্তবায়িত হলে চীনকে আর মালাক্কা প্রণালী পাড়ি দিতে হবে না। বর্তমানে এই প্রণালী ঘিরে দক্ষিণ চীন সাগরের ভূ রাজনীতি উত্তপ্ত। দক্ষিণ চীন সাগরের সমুদ্রসীমা নিয়ে চীনের সাথে প্রতিবেশী ভিয়েতনাম, মালেশিয়া, ব্রুনাই, ফিলিপাইন, তাইওয়ান, ইন্দোনেশিয়ার বিরোধ ক্রমে বাড়ছে। সাগরের রাজনীতিতে চীনবিরোধী এই দেশগুলোর সাথে যোগ দিতে এক পায়ে খাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের বিখ্যাত নৌবহরগুলো।
দক্ষিণ চীন সাগরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে বিরোধে থাকার কারণে চীন আশঙ্কা করছে, যেকোনো নাজুক পরিস্থিতিতে এই প্রণালী বন্ধ করে চীনকে বেকায়দায় ফেলতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। আর তাই মালাক্কা প্রণালীর বিকল্প রুট হিসেবে চীনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রুট হলো সিপিইসি তথা 'চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর।'
২.
সিপিইসি প্রকল্পে পাকিস্তানের লাভ কী?
পাকিস্তানের ভঙ্গুর অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সিপিইসি প্রকল্পকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে দেশটির সরকার ও সেনাবাহিনী।
সিপিইসি বাস্তবায়িত হলে চীন, আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়া থেকে অসংখ্য যাত্রী এবং পণ্য পাকিস্তানের উপর দিয়ে পাড়ি দিবে। আর এর বিনিময়ে একটা সময় পর থেকে পাকিস্তান পাবে প্রচুর বাণিজ্য শুল্ক।
সিপিইসি প্রকল্পটি পাকিস্তানি কাশ্মিরের উপর দিয়ে যাবে। এই অঞ্চলটিকে ভারত নিজেদের ভূখণ্ড বলে দাবি করে থাকে। এরকম ভূখণ্ডে চীনা প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে নিঃসন্দেহে পাকিস্তানি কাশ্মিরের নিরাপত্তা বৃদ্ধি (পাকিস্তানের দৃষ্টিকোণ থেকে) পাবে এবং অঞ্চলটির উপর ভারত সহজে আর চোখ ফেলতে পারবে না।
সিপিইসি প্রকল্পের অংশ হিসেবে আজাদ কাশ্মিরে অনেকগুলো জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করছে চীন। বিদ্যুৎ সমস্যায় জর্জরিত পাকিস্তানের জন্য এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বিরাট আশীর্বাদ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে আফগানিস্তানে প্রভাব বজায় রাখতে চাচ্ছে। সিপিইসি প্রকল্পের মাধ্যমে ভূবেষ্টিত দেশ আফগানিস্তান সহজেই সাগরে প্রবেশের সুযোগ পাবে। এতে করে আফগানিস্তানে বৃদ্ধি পাবে পাকিস্তানি প্রভাব।
মধ্য এশিয়ার পাঁচটি 'স্তান' রাষ্ট্র তথা কাজাখস্তান, কিরঘিস্তান, উজবেকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান সিপিইসি প্রকল্পের মাধ্যমে সমুদ্রপথে সহজে মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকাতে যাতায়াতের এবং বাণিজ্যের সুযোগ পাবে। এতে দেশগুলোর উপর প্রভাব বৃদ্ধি পাবে পাকিস্তানের।
৩.
সিপিইসি প্রকল্পে ক্ষতিগ্রস্ত হবে কোন দেশগুলো?
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক প্রভাব এই প্রকল্পের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
চিরশত্রু পাকিস্তানকে চেপে ধরে রাখতে ভারতের জন্য আফগানিস্তান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি মধ্য এশিয়ার 'স্তান' রাষ্ট্রগুলোর বিশাল বাজার ধরতে আগ্রহী ভারত। কিন্তু সিপিইসি বাস্তবায়িত হলে আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার 'স্তান' রাষ্ট্রগুলো তাদের বাণিজ্য সুবিধার জন্য আরো বেশি পাকিস্তানমুখী হবে।
আর তাই ভারত সরকার সিপিইসির বিকল্প হিসেবে ভারত-ইরান (চাবাহার বন্দর)-আফগানিস্তান (কাবুল)-মধ্য এশিয়ার মধ্য দিয়ে নতুন বাণিজ্য রুট চালু করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু ভৌগোলিক কারণে সিপিইসিকে টেক্কা দিতে যথেষ্ট সক্ষম ছিল না ভারতের এ প্রকল্পটি। আর তাই শুরুতে আগ্রহ প্রকাশ করলেও ইরান তার চাবাহার বন্দরের উন্নয়নের কাজ ভারত থেকে নিয়ে চীনকে দিয়ে দিয়েছে। ফলে কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে ভারতের বাণিজ্য রুটের প্রকল্পটি।
নতুন বাণিজ্য রুট তৈরি করতে ব্যর্থ ভারত নিশ্চয়ই খুশি হবে না চীন-পাকিস্তানের সিপিইসি রুটের বাস্তবায়ন হওয়া দেখে।
সিপিইসি প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে আজাদ কাশ্মিরের ওপর দিয়ে। অঞ্চলটির ওপর নিজেদের দাবি এখনো ছাড়েনি ভারত। ফলে চীনের নির্মিত এ প্রকল্পকে নিজেদের সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত হিসেবে বিবেচনা করতে হচ্ছে ভারতকে।
ভারতের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সিপিইসি প্রকল্প নিয়ে অনেকটা শঙ্কিত। কেননা এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের বাণিজ্য ও রাজনৈতিক প্রভাব অনেক বাড়বে। মালাক্কা প্রণালী দিয়ে চীনকে আটকানোর হুমকি আর দিতে পারবে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানে নিজেদের রাজনৈতিক প্রভাব অনেকটা শেষ হয়ে যাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের।
৪.
পাকিস্তানের মাটিতে সিপিইসি প্রকল্প বাস্তবায়নে নিয়োজিত চীনা প্রকৌশলীদের ওপর বারবার হামলা হচ্ছে। এই হামলা নিছক কাকতালীয় নাকি সিপিইসি প্রকল্পে বাধা দানের উদ্দেশ্য করা হচ্ছে তা নিয়ে গভীর চিন্তিত চীন ও পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।
ভূ-রাজনৈতিক নানা মারপ্যাঁচে সিপিইসি প্রকল্পটি বাস্তবায়নে যে চীন ও পাকিস্তানকে বন্ধুর পথ পাড়ি দিতে হবে তা বোঝাই যাচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, এই পথ পাড়ি দিতে দেশ দুটি সক্ষম হয় কিনা। চীন ও পাকিস্তানের প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো প্রকল্পটি ভণ্ডল করতে সক্ষম হবে কিনা তাও দেখার বিষয়।