হবস : যার কাছে ম্লান ব্র্যাডম্যান-শচিনও
জ্যাক হবস - ছবি : সংগৃহীত
শচিন আর সেঞ্চুরি, দুটি শব্দই যেনো একে অপরের সমার্থক। আবার কখনো শচিন আর সেঞ্চুরিকে একে অপরের পরিপূরকও বলা হয়ে থাকে। হবে না-ই বা কেন? আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের কীর্তিগাঁথায় শচিনই যে একমাত্র সেঞ্চুরির সেঞ্চুরিয়ান! শতকের শতক কীর্তিগাঁথা তাকে করেছে অম্লান, দিয়েছে তকমা 'ক্রিকেট ঈশ্বরের'!
কিন্তু অবাক হলেও সত্য, জ্যাক হবসের কৃতিত্বটা আরো অবিশ্বাস্য! মাত্র এক শতকের ব্যবধানে হবস থেমেছেন, শতকের দ্বি-শতকের দোরগোড়ায়। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে তিন সংখ্যার মাইলফলকটা তিনি ছুঁয়েছেন ১৯৯ বার! ডন ব্র্যাডম্যানের ৯৯.৯৪ গড়ের মতো এটাও ক্রিকেটের জন্য চির আক্ষেপের একটা। অবশ্য, প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটের সর্বোচ্চ ৬১ হাজার ৭৬০ রানটা তার সংগ্রহশালায়!
শতকের দ্বি-শতক কীর্তিটা হয়তো ছোঁয়া হয়নি, কিন্তু রয়েছে আরো অসংখ্য সব অম্লান কীর্তি, যা তাকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে ইতিহাসের পাতায়। কারো চোখে তো বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানই তিনি। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন, যেকোনো মাঠ আর ভিন্ন পরিস্থিতি বিবেচনায় অনায়াস আর শান্ত-সাবলীল ব্যাটিংয়ে স্যার হবস স্যার ব্র্যাডম্যানের চেয়ে এগিয়ে!
পরিসংখ্যান হয়তো হবস সম্পর্কে খানিকটা ধারণা দিবে, কিন্তু বাস্তবতার প্রকৃত স্বাদ অনুধাবন করা কখনো সম্ভব হবে না। কারণ, পরিসংখ্যানের পাতায় তো লেখা নেই, বিশ্বযুদ্ধের দামামায় অর্ধযুগ ক্রিকেট থেকে দূরে থাকতে হয়েছে! লেখা তো নেই, শতক হাঁকানোর পর অন্যদের সুযোগ করে দেয়ার উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছায় উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসার গল্পগুলো! অন্যথায় কেমন হতে পারত পরিসংখ্যান একবার ভাবুন তো!
মজার ব্যাপার হলো, হবসের টেস্ট সেঞ্চুরির অর্ধেকের বেশিই এসেছে চল্লিশ পেরোনোর পর! টেস্ট ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বয়সে সেঞ্চুরি হাঁকানোর বিরলতম রেকর্ডটিও তার। ১৯২৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট সেঞ্চুরিটা হাঁকিয়েছিলেন ৪৬ বছর ৮২ দিন বয়সে! আর প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটেও চল্লিশোর্ধ্ব বয়সে করেছেন ৫৮.৬২ গড়ে ২৬ হাজার ৪১১ রান! সেঞ্চুরি ৯৮টি! 'Life begins after forty!' কথাটি হবসের বেলায় অক্ষরে অক্ষরে প্রযোজ্য।
১৮৮২ সালের ১৬ ডিসেম্বর, ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ শহরে জন্ম তার। পুরো নাম জন বেরি হবস। ডাকনাম ছিল জ্যাক। ১২ ভাই-বোনের মাঝে জ্যাক সবার বড়। বাবা জন কুপার ছিলেন গ্রাউন্ডসম্যান। আবার স্থানীয় ক্লাব ক্রিকেটে আম্পায়ারিংও করতেন মাঝে মধ্যে। তাই বাবার হাত ধরে মাত্র ৯ বছর বয়সে ক্রিকেটের হাতেখড়ি হবসের। হবস কারো থেকে কোচিং নেননি, যা শিখেছেন সবটাই স্ব-ইচ্ছায়ই।
দরিদ্র পরিবারের সন্তান হওয়ায় পড়ালেখাটা বেশি দূর করতে পারেননি হবস। মাত্র ১৩ বছর বয়সে হবস পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে যোগ দেন কলেজে সার্ভেন্ট হিসেবে। কাঁধে তুলে নেন সংসারের জোয়াল। ভাগ্য সহায়, হবস যে চাকরি জুটিয়ে ছিলেন,তা ছিল সেই ক্রিকেট নিয়েই। কলেজের ক্রিকেট দলের ফরমায়েশ খাটতেন, পাশাপাশি গ্রাউন্ডসম্যান ও নেট বোলারের ভূমিকাও পালন করতেন তিনি।
১৯০১ সালে হবস যোগ দেন কেমব্রিজের একটি আধা-পেশাদার ক্লাবে। ধারাবাহিক নৈপুণ্যের সুবাদে পরের বছরেই সাপ্তাহিক মাত্র ১০ শিলিংয়ের চুক্তিতে যোগদান করেন পেশাদার বেডফোর্ড ক্লাবে। এরই মাঝে হঠাৎ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মারা যান হবসের বাবা। ফলে তাদের পরিবারে নেমে আসে মারাত্মক আর্থিক সংকট।
ফলে, স্থানীয় কাউন্টি দল এসেক্সে ট্রায়ালের জন্য আবেদন করেন হবস। কিন্তু সে আবেদন না-মঞ্জুর করে দেয় এসেক্স কর্তৃপক্ষ। এবার স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে আসেন স্বয়ং হবসের আদর্শ টম হেওয়ার্ড। তার সাহায্যে কাউন্টি ক্লাব সারের ট্রায়ালে অংশ নিয়ে মুগ্ধতা ছড়ান। ১৯০৩ সালে সারের সাথে চুক্তিবদ্ধ হন, আর ১৯০৫ সালে সুযোগ পান সারের মূল একাদশে।
হবসের অভিষেকে প্রতিপক্ষ ছিল ডব্লু জি গ্রেসের জেন্টলম্যান একাদশ। অভিষেক ম্যাচে হবসকে দেখে টিচার অফ ক্রিকেট খ্যাত ডব্লু জি গ্রেস ভবিষৎবাণী করেছিলেন, 'এই ছেলে একদিন বড় কিছু হবে।' ভুল হয়নি গ্রেসের ভবিষ্যৎবাণী, হবস বড় হলেন। এত বড় হলেন যে শিক্ষকের সেরা ছাত্রের তকমাটও লাগল গায়ে।
উইজডেন মনোনীত বর্ষসেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার জেতেন দুবার; ১৯০৯ ও ১৯২৬ সালে। আর ২০০০ সালে উইজডেন কর্তৃক নির্বাচিত হন শতাব্দীর সেরা পাঁচ ক্রিকেটারের একজন। আর ক্রিকেটে অসামান্য অবদান রাখায় ১৯৫৩ সালে হবস ভূষিত হন সম্মানসূচক 'নাইটহুড' উপাধিতে। নামের শুরুতে সংযোজন হয় 'স্যার' শব্দের।
১৯৬৩ সালে ৮১ বছর বয়সে মারা যান। হবস মারা গেছেন- এই তথ্য পুরো সত্য নয়। কারণ তিনি বেঁচে আছেন, বেঁচে আছেন তার কীর্তিতে ইতিহাসের পাতায়।