আফগানিস্তান : যে ভুলের খেসারত দিতে হলো যুক্তরাষ্ট্রকে
বুশ ও রামসফেল্ড - ছবি : সংগৃহীত
আফগানিস্তান জয় করতে ব্যর্থ হওয়ার পর দেশটি থেকে সরে যাচ্ছে আমেরিকা। বেশির ভাগ বিশ্লেষকই এটাকে যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয় হিসেবে অভিহিত করেছেন। এত শক্তিধর রাষ্ট্র হয়েও কেন হারল যুক্তরাষ্ট্র? এখানে কিছু কারণ তুলে ধরা হলো।
বুশ প্রশাসনের আফগাননীতি : বুশ প্রশাসনের আফগান নীতিতেই ছিল পরাজয়ের বীজ। তার প্রতিরক্ষামন্ত্রী ডোনাল্ড রামসফেল্ড আফগান সেনাবাহিনীতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী ছিলেন না।
২০০২ থেকে ২০০৬ এই সময়ই আফগানিস্তানে আমেরিকার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যায়। ২০০৬ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানের জন্য প্রশিক্ষিত সেনা সদস্য ছিল মাত্র ৬০০০, সাথে আমেরিকা ও ন্যাটো সৈন্য ছিল ৩০০০। কোনো শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠনে আমেরিকার কোনো ইচ্ছে ছিল বলে মনে হয় না। ঠিক এই সময়ই আফগান-পাক সীমান্তবর্তী স্বায়ত্তশাসিত জেলাগুলোয় তালেবান পুনর্গঠিত হয়ে আফগান ভূমিতে ফিরে আসতে থাকে।তখন তালেবানের সক্রিয় সদস্য সংখ্যা ছিল মাত্র ১০ হাজার ।
আমেরিকার দুই নৌকায় পা : আমেরিকার হুমকির মুখে ওই সময়ের পাকিস্তান সরকার আফগান যুদ্ধে আমেরিকার সঙ্গ দিলেও পাকিস্তানের জনসাধারণের এতে কোনো সমর্থন ছিল না। তাই মাদরাসাগুলো থেকে আফগান যুদ্ধের জন্য সদলে দলে সদস্য যোগান দেয়া কখনোই বন্ধ করতে পারেনি পাক সরকার।
এদিকে আফগান যুদ্ধে ভারতকে পরোক্ষভাবে টেনে আনে আমেরিকা। এই সুযোগে ভারত আফগান ভূমিকে তার চিরশত্রু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহারের পূর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করতে রাজি ছিল না। পাক-আফগান বর্ডারজুড়ে ভারত খুলে বসে ২৪টি কনসুলেট।
এবং এগুলোকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে থাকে। তখন পর্যন্ত আফগানিস্তানে পাকিস্তানের কনসুলেট ছিল মাত্র চারটি যা আফগানিস্তানের বড় চারটি শহর অবস্থিত। পাকিস্তান নিজেকে আবিস্কার করে বন্দী এক খাঁচায়। যার চারপাশে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের অবাধ বিচরণ। যার সাথে ১৯৪৭ সালের পর মাত্র ২৫ বছরের কম সময়ে চার চারটি যুদ্ধে জড়িয়েছিল পাকিস্তান। এবং ৭১ সালের যুদ্ধে তার অঙ্গহানি ঘটে, বর্তমান বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান) তার হাতছাড়া হয়ে যায়।আমেরিকার কৌশলগত বন্ধুত্বের আড়ালে পাকিস্তানের ভেতরে অবাধে তথাকথিত উগ্রবাদবিরোধী অভিযান চলে। এতে হাজার হাজার নিরাপরাধ মানুষ নিহত হয় অর্থনৈতিক ক্ষতি দাঁড়ায় প্রায় ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলার, অথচ সাহায্যের নামে আমেরিকা পাকিস্তানকে দেয় মাত্র ২০ বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তানের আমেরিকান ডলারের মোহভঙ্গ ঘটে। তারা গোপনে তালেবানের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে। তাদের যাবতীয় বিষয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দেয়। পূর্বের ভুলগুলোকে পেছনে ফেলে তারা তালেবানকে কৌশলগত বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে পাকিস্তানের অস্তিত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য।
আমেরিকার কূটনৈতিক ব্যর্থতা :
আমেরিকা তালেবানকে সঠিকভাবে পরিমাপ করতে ব্যর্থ হয়েছিল।তার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তি যে আফগান গোত্রতান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর গভীরে প্রোথিত। পক্ষান্তরে আমেরিকা-সমর্থিত কাবুল সরকার যে কার্যত জনবিচ্ছিন্ন- এই সত্যকে পাশ কাটিয়ে যায় আমেরিকা।
আফগানিস্তানের জনগণের চোখে তালেবান চিত্রিত হয়ে আছে, দেশ ও ধর্মের হেফাজতের কান্ডারি হিসেবে। এই বাস্তবতা আমেরিকা সজ্ঞানে এড়িয়ে চলেছে। তাই ট্রাম্প প্রশাসন ছাড়া আগের সব মার্কিন প্রশাসন তালেবানকে ভবিষৎ আফগান সরকার কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে অস্বীকৃতি জানিয়ে এসেছে। তালেবান সরকারের পতনের পর আমেরিকার সহায়তায় গণতন্ত্রের নামে যে সরকার কাবুলের ক্ষমতা দখল করে। তাদের সীমাহীন দুর্নীতি আর অবাধ লুটপাটে মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়, কে আসলে দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, নিজেদের সংস্কৃতির আর ইসলামের হেফাজতের জন্য যুদ্ধরত। তাছাড়া '৮০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসন এবং তাদের পতনের পর ছড়িয়ে পড়া গৃহযুদ্ধের ধ্বংসলীলা থেকে দেশকে এবং দেশের মানুষকে কারা শান্তিপূর্ণ জীবনে প্রত্যাবর্তন করাতে নিরলস প্রচেষ্টা আর ত্যাগ স্বীকার করেছে তা বুঝতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি সরলপ্রাণ আফগান জনগণকে।
তারা আমেরিকা আর সোভিয়েত ইউনিয়নের মাঝে কোনো তফাৎ করতে পারেনি। কারণ সোভিয়েত ইউনিয়ন '৮০-এর দশকে যা করেছে আমেরিকার নেতৃত্বে ন্যাটো সৈন্যরা তাই করে চলছে আফগানিস্তানে। আর তৎকালীন কমিউনিস্ট নাজিবুল্লাহর সরকার যেমন সোভিয়েতের পাপেট ছিল, আজকের কারজাই আর আশরাফ গনিও যে তার বিদেশী প্রভুদের স্বার্থরক্ষায় একই দায়িত্ব পালন করছে। বিষয়টি আফগান জনগণের উপলব্ধিতে আছে। এছাড়া তালেবানের বৈশ্বিক সমর্থন বিশেষ করে আমেরিকা যাদের শত্রুজ্ঞান করে চীন, রাশিয়া ও ইরানের সাথে স্ট্রাটেজিক কূটনৈতিক সম্পর্ক আফগানিস্তানে আমেরিকান সৈন্যের অবস্থান আরো চাপের মুখে পড়ে।
ভুল সামরিক স্ট্রাটেজিক সিদ্ধান্ত
আফগান যুদ্ধে সামরিক জয় নিশ্চিত না করেই প্রেসিডেন্ট বুশ তার প্রতিরক্ষামন্ত্রীর ব্যক্তিগত ক্রোধ প্রশমনে সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে গণ-বিধ্বংসী অস্ত্রের অবৈধ মজুদ থাকার অভিযোগে ২০০৩ সালে ইরাকের উপর আগ্রাসন শুরু করেন। এটি শেষ পর্যন্ত দেশটিকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়। সহসাই ইরাক যুদ্ধও আমেরিকার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। বিভিন্ন সশস্ত্র প্রতিরোধ গোষ্ঠীর উত্থানের সাথে সাথে আইএসের উত্থান আমেরিকাকে মধ্যপ্রাচ্যে বেকায়দায় ফেলে দেয়। আমেরিকার ইরাক যুদ্ধের সময়টাতেই তালেবান তার হারানো শক্তি পূর্ণমাত্রায় সঞ্চয় করে আফগানিস্তানে প্রবেশ করে।এর পর তালেবানকে আর পিছু হটতে হয়নি।