এক আনন্দের ফেরিওয়ালা
ক্রিস গেইল - ছবি : সংগৃহীত
খুব সাধারণ এক নিম্নবিত্ত পরিবারের জন্ম তার। বাবা সাধারণ এক পুলিশ সদস্য, মা বাদাম বিক্রেতা। তবুও অসচ্ছলতা আর দারিদ্র্যতার মাঝেই বেড়ে উঠা। রাত কাটাতেন কোনোরকমে দাঁড়িয়ে থাকা এক টিনের ঘরে, যার ফাঁকা দিয়ে দেখা যেত সুদূর আকাশটাকে। রাত্রি হলে দেখা যেত মায়াবি চাঁদটাও যে। বৃষ্টিতে ফোঁটা ফোঁটা জলও আসত তাতে। তবে ক্ষুধাটাই বেশি কষ্ট দিত। ছয় ভাইবোনের যে ঠিকমতো খাবারও জুটত না কপালে। বাংলায় যাকে 'নুন আনতে পান্তা ফুরোয়' অবস্থা। খাবারের অভাবে রাস্তার ধারে পড়ে থাকা পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের বোতলও কুড়াতেন। একবার তো অর্থাভাবে চুরিও করেছিলেন।
ওসব এখন নিছকই অতীত। ফুটপাতের ওই ছেলেটা আজ অনেক বদলে গেছে, বদলে গেছে তার পৃথিবী, বদলে গেছে তার চারপাশ। যেই অর্থাভাবের কারণে চুরি করেছিলেন, আজ ওই অর্থ তার পায়েতে গড়াগড়ি খায়। টাকার জন্য ভরপেট খেতে না পাওয়া ছেলেটির সম্পদের পরিমাণ এখন ৪০ মিলিয়ন ডলার! তার সব কিছু বদলে দিয়েছে তার ভেতরে লুকিয়ে থাকা একটা রোগ। ছোটবেলা থেকেই সমস্যাটা ছিল তার। হঠাৎই বুকটা চেপে ধরত, জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে হতো। কখনো বুকে বাতাস পেতেন না; কখনো বা দেখা দিতো খানিকটা ব্যথা। তবে সমস্যাটা কাউকে কখনো বুঝতে দেননি। মজায়, হাসিতে উড়িয়ে দিয়েছেন সবকিছু।
ক্রিকেটটা তার রক্তের সাথে অনেক আগেই মিশে ছিল। দাদা ক্লাব ক্রিকেটে খেলতেন। সেই ধারাবাহিকতায় নিজেও ক্রিকেটে এসেছেন। তবে রোগটা তার পেছন ছাড়েনি। ব্যাটিং করতে গিয়ে বার বার বাঁধাগ্রস্থ হতেন।এমন হলে একটু বসে পড়ে পানি খেয়ে আবার খেলায় মনযোগ দিতেন। কাউকে টের পেতে দিতেন না বাস্তবতা। এমন করে খেলেই ইতমধ্যে জায়গা করে নিলেন জাতীয় দলে। তবে আর পারলেন না তাকে দমিয়ে রাখতে। ২০০৫ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়ে ব্লক ধরা পড়ল হার্টে। জীবন-মরণ সন্ধিক্ষণে যেতে হলো হাসপাতালে। আর সেই হাসপাতালে শুয়েই সিদ্ধান্ত নিলেন পরবর্তী জীবনটা নতুন করে সাজাবেন বলে। উপভোগ করবেন ফিরে আসাটা। আনন্দ দিয়ে যাবেন সবাইকে।
আনন্দ দেবার উপলক্ষ হিসেবে বেছে নিলেন ব্যাট-বল জুটিকে। দেশ-দেশান্তর ঘুরে ফিরে ফেরি করতে থাকলেন ক্রিকেটকে। আর বিলি করতে থাকলেন আনন্দ। আর তাতেই তার বদলে যাওয়ার শুরু, দুঃখগুলো চাপা পড়তে থাকল পেছনে। আর এই পথে চলতে চলতে নিজেকে দাঁড় করালেন ব্রান্ড অফ ক্রিকেটে। ক্রিকেট ফেরি করে নিজের সম্পদসীমা পৌঁছালেন ৪০ মিলিয়ন ডলারে। এখন প্রশ্ন আসতেই পারে, ক্রিকেটকে ফেরি করে আজ এই অবস্থানে, তিনি ক্রিকেটকে কী দিয়েছেন বিনিময়ে?
ক্রিকেটকে কি দিয়েছেন জানেন? ৭২১৪ টেস্ট রান, ১০৪৮০ ওয়ানডে রান আর টি-টুয়েন্টিতে ১৭৯৬ চলমান৷ তবে সব থেকে বেশি দিয়েছেন আনন্দ, তার প্রমাণস্বরূপ একটা পরিসংখ্যানই যথেষ্ট। স্বীকৃত টি-২০ ক্রিকেটে বল উড়িয়ে সীমানা পাড় করেছেন ১০২৮ বার। চারের মারেও পিছিয়ে নেই- ১০৮৩ বার৷ সর্বোচ্চ ২২ সেঞ্চুরিও তার দখলে। অর্ধশতক আছে শতকের পথে, সংখ্যায় তা ৮৭টি। এত রেকর্ডের মাঝে আরেকটা রেকর্ড গড়েছেন নতুন করে আজ ভোরে। স্বীকৃত টি-২০ ক্রিকেটে তার রান সংখ্যা যে ১৪ হাজার ছাড়িয়েছে!
তার নামটা এখনো বলিনি। বলার প্রয়োজনবোধ করিনি। গোটা বিশ্ব ঘুরে যিনি ক্রিকেট ফেরি করে বেড়ান আনন্দের বিনিময়ে, তার নামটা কি আবার বলতে হবে নতুন করে? চার-ছক্কার ঝড়েই মূর্ত তার ছবি। পৃথিবীর সব প্রান্তেই টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের নিয়মিত মুখ তিনি। তাই তো টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন ধরা হয় তাকে। ব্যাট হাতে বাইশ গজে অগ্নিমূর্তি ধারণ শুধু নয়, মাঠে নেচেগেয়ে, হাসি-ঠাট্টায় ভক্তদের আনন্দ দিতে তার জুড়ি মেলা ভার। চোখ-হাতের সমন্বয়ে বিশ্বের সেরা আক্রমণাত্মক ব্যাটসম্যান তিনি। তিনি যেন মারমুখী ক্রিকেটের এক প্রতিশব্দ!
বয়সটা বাড়ছে। ইতমধ্যে ৪১ ছুঁয়েছে। কিন্তু তিনি যেন আজো তারুণ্যে ভরপুর একজন। এখনো কমেনি তার ব্যাটের ধার। এজন্যই তো নিজ আত্মজীবনীতে 'সিক্স মেশিনে' একটা প্রশ্ন তুলেছেন ধরে, বলেছেন ‘কী ভাবছেন, আপনারা আমাকে চেনেন? তবে আপনি ভুল জানেন। আমি রীতিবহির্ভূত। আমি এক অদ্ভুতুড়ে'। সত্যিই তো তাই, তাকে বোঝার সাধ্য কার আছে? সবাই কি গেইল হতে পারে?