ক্ষমতা কমছে প্রিন্স মোহাম্মদের?

মাসুম খলিলী | Jul 13, 2021 05:43 pm
প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান

প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান - ছবি : সংগৃহীত

 

প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতায় থাকাকালে ক্রাউন প্রিন্স মুহাম্মদ বিন সালমানের সৌদি শাসন ব্যবস্থার ওপর যে একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরি হয়েছিল তা অনেকখানি কমে গিয়েছে। সে সময় সৌদি সমাজকে ইসলামী রক্ষণশীলতা থেকে পশ্চিমা সেক্যুলারিস্ট সমাজে রূপান্তর করতে গিয়ে ওলামা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে গুরুত্বহীন করে তোলা হয়েছিল। ইসলামিস্টদের প্রশাসন থেকে বিদায় করা হয়। সৌদি রাজপরিবারের সিনিয়র সদস্যদের ক্ষমতা কাঠামো থেকে নিষ্ক্রিয় করে সেসব পরিবারের কনিষ্ঠ অথবা ক্ষমতাহীনদের দায়িত্বে নিয়ে এসে প্রশাসন সাজানো হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রে বাইডেনের ক্ষমতায় আসা, ইসরাইলের ক্ষমতা থেকে নেতানিয়াহুর বিদায় এবং বারবার অভ্যুত্থান বা বিদ্রোহ প্রচেষ্টার পরিপ্রেক্ষিতে বাদশাহ সালমান সৌদি সমাজ ও রাষ্ট্রিক ব্যবস্থাপনায় সৃষ্ট বিভক্তিকে জোড়া লাগানোর চেষ্টা করছেন।

একচ্ছত্র ক্ষমতা থাকছে না এমবিএসের
এই প্রচেষ্টায় মুহাম্মদ বিন সালমান (এমবিএস ) সৌদি প্রশাসন নিয়ন্ত্রণে তার একচ্ছত্র ক্ষমতাই শুধু হারাননি তিনি ভবিষ্যৎ বাদশাহ হতে পারবেন কিনা তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। এমবিএস-এর ব্যাপারে বাদশাহ সালমানের আস্থায় বড় ধরনের বিচ্যুতি ঘটে আরব অমিরাতের সাথে মিলে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় কোনো ছাড় ছাড়াই তার ইসরাইলকে স্বীকৃতিদানের প্রস্তাবে। বিন সালমানের এ প্রস্তাব নাকচ করে দেন বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজ। এরপর আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আর তার জামাতা কুশনারের চাপের মুখেও সালমান সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেননি। পরে সংযুক্ত আরব আমিরাত একতরফাভাবে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিয়ে দেশটির সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। সেই সাথে ইসরাইলকে স্বীকৃতি দানে মুসলিম দেশগুলোকে সম্মত করার ব্যাপারে তেলআবিবের দূতের ভূমিকা পালন করে আবুধাবি।
সৌদি বাদশাহকে না জানিয়ে ইসরাইলের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন এবং ইসরাইলের মদদপুষ্ট হয়ে মুসলিম বিশ্বের নেতা হবার জন্য আবুধাবির নানা ধরনের পদক্ষেপ সালমান বিন আবদুল আজিজ ভালোভাবে দেখেননি। এর মধ্যে জো বাইডেন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ট্রাম্পের নীতি থেকে সরে আসার প্রবণতায় সৌদি আরবের জন্য নানাভাবে অরক্ষিত হওয়ার আভাস আসতে থাকে। ধর্মীয় এস্টাবলিশমেন্টের সাথে দূরত্ব, মুসলিম ব্রাদারহুডকে ক্রাশ করার প্রচেষ্টা চালিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম অরাষ্ট্রিক শক্তিকে শত্রু বানানো, রাজপরিবারের ভিন্নমতাবলম্বীদের অর্থ সম্পদ কেড়ে নেয়া আর ইরান ও কাতার-তুরস্কের সাথে দূরত্ব ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকার মধ্যে সৌদি আরব ক্রমেই বড় রকমের ঝুঁকিতে পড়তে থাকে।


সালমানের পাঁচ উদ্যোগ
এই অবস্থায় বাদশাহ সালমান সুনির্দিষ্ট কিছু নীতি পদক্ষেপ নিয়ে অগ্রসর হবার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রথমত, মুহাম্মদ বিন সালমান উদ্যোগী হয়ে ইয়েমেনে যে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে সেটির অবসান ঘটানো। এই প্রচেষ্টায় পাকিস্তান মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করছে আর ইরানের সাথে প্রত্যক্ষ আলোচনায় মতের ব্যবধান ঘোচানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, সৌদি ধর্মীয় নেতৃত্বের পুরনো অবস্থান ও মর্যাদা ফিরিয়ে এনে, সৌদি জনমতে রাজতন্ত্রবিরোধী যে মনোভাব ক্রমেই চাঙ্গা হচ্ছে সেটাকে নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ গ্রহণ। তৃতীয়ত, সৌদি আরবের ভেতরে এবং পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে মুসলিম ব্রাদারহুড বিরোধী অবস্থান নিতে গিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের জনমত এবং সমাজ কাঠামোতে সৌদি আরবের প্রভাব দুর্বল হয়ে পড়ে। সেটি পুনরুদ্ধার করতে মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে পুরনো সম্পর্ক ফিরিয়ে আনার চেষ্টা হচ্ছে। এজন্য নির্বাসিত ব্রাদারহুড নেতৃত্বকে যুক্তরাজ্যে পুনর্বাসনে সহায়তা দেয়া এবং পর্যায়ক্রমে তাদের স্বদেশে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টির প্রয়াস নেয়া হয়েছে। চতুর্থত, ফিলিস্তিনি স্বার্থের বিপক্ষে অবস্থান নেওয়ার ব্যাপারে যে নেতিবাচক ভাবমর্যাদা সৌদি আরবের সৃষ্টি হয়েছে সেটি পুনরুদ্ধারের জন্য ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ সংগঠন হামাসের সাথে সম্পর্ক পুনরুদ্ধার করা। পঞ্চমত, রাজপরিবারের ভিন্ন মতের সদস্য ও কোণঠাসা পরিবারগুলোর আস্থা ফেরানোর ব্যাপারে উদ্যোগী হওয়া।

সালমান বাদশাহ ফয়সলের আমল থেকেই সৌদি রাজপরিবারের অভ্যন্তরীণ সংহতির বিষয়াদি দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত যুবরাজ ছিলেন। ফলে রাজপরিবারের সব খুঁটিনাটি বিষয় তার জানা রয়েছে। অন্য দিকে তিনি ছিলেন সৌদি আরবের ফিলিস্তিনের বিষয় দেখাশোনার দায়িত্বপ্রাপ্ত যুবরাজ। মুসলিম ব্রাদারহুডের সাথে সম্পর্ক ও যোগাযোগ বজায় রাখার দায়িত্বও তিনি একসময় পালন করেছিলেন। ফলে ধারণা করা হচ্ছে বাদশাহ সালমান যেভাবে এখন দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে কার্যকরভাবে সক্রিয় হচ্ছেন তাতে তার পক্ষে সৌদি সমাজ ও রাষ্ট্র্রে এর মধ্যে যে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে, তা নিরসনে কার্যকর ভূমিকা পালন করা সম্ভব হবে।

তবে বাদশাহ সালমানের একটি বড় দুর্বলতা হলো তার পুত্র মুহাম্মদ বিন সালমানের ব্যাপারে। তিনি এই পুত্রের বেপরোয়া পদক্ষেপ গ্রহণের সামর্থ্যরে মধ্যে পিতা আবদুল আজিজের ছায়া প্রত্যক্ষ করতেন। কিন্তু পিতার সে আস্থা মুহাম্মদ বিন সালমানের ব্যাপারে রক্ষা হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে বাদশাহ বড় একটি ধাক্কা খান তার অগোচরে ইস্তাম্বুলের সৌদি মিশনে বিখ্যাত সাংবাদিক জামাল খাশোগির নির্মম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়। এই ঘটনার প্রভাব এতটা গভীর হয় যে, সালমানের ব্যক্তিগত উদ্যোগ গ্রহণের পরও পুত্র মুহাম্মদকে ক্ষমতার উত্তরাধিকারের অবস্থানে ফেরানো সম্ভব হচ্ছে না। আমেরিকায় বাইডেন প্রশাসন দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে বাদশাহ সালমানের সাথে সরাসরি সব যোগাযোগ রক্ষা করছেন। ট্রাম্পের সময় একাধিকবার যুক্তরাষ্ট্র সফরে যেতে পারলেও বাইডেনের সাথে এমবিএস সরাসরি সাক্ষাৎ পর্যন্ত করতে পারেননি। সর্বশেষ, খালিদ বিন সালমানকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠিয়েছেন পিতা বাদশাহ সালমান। এই সফরে খাশোগি হত্যাকাণ্ডের বিচারের বিষয় এবং ক্রাউন প্রিন্সের উত্তরাধিকারের প্রশ্ন নিয়ে কথাবার্তা হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us