স্বর্ণকারের বাটখারা ও রত্তি দানার ইতিবৃত্ত
রত্তি দানা - ছবি : সংগৃহীত
বাংলাদেশের স্বর্ণকারের ভাষায় এর নাম রতি বা ‘রত্তি’। বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে এটার ভিন্ন ভিন্ন নাম আছে। হিন্দিতে গুঞ্জা আর ইংরেজিতে বলে Rosary Peas. বৈজ্ঞানিক নাম Abrus precatorius. রত্তি দানা বর্তমান সময়ের তরুণেরা না চিনলেও ২০ বছর আগেও কম-বেশি এটার চল ছিল সমাজে। আজকের দিনে যারা মুরুব্বি- তাদের প্রায় সবার কাছেই এটা সম্পর্কে সম্যক ধারণা আছে। এটার নাম ‘রত্তি’।
স্বর্ণকারেরা একে বাটখারা হিসেবে ব্যবহার করত। এটার ওজন দিয়েই সোনা-রূপা মাপার কাজ সেরে নিত। স্বর্ণের হিসাব ছিল এমন, ষোল আনাতে এক ভরি। স্বর্ণকারের কাছে ভরি ও আনা মাপার নিক্তি ছিল- কিন্তু আনার নিচের অংশগুলো মাপ-জোক করার কোনো কিছু ছিল না। গণিতের ওই অংশ সমাধান করার জন্য স্বর্ণকারেরা এই রত্তির সহায়তা নিত। অর্থাৎ সোনা-দানা মাপার জন্য এই রত্তির ব্যবহার সর্বত্র পরিলক্ষিত হতো। ফলে কম-বেশী সবাই এই রত্তি দানা চিনে।
এটি লতা জাতীয় উদ্ভিদে জন্মে। পাতাগুলো দেখতে আমলকীর পাতার মতো। যদিও বর্তমান প্রজন্মের অনেকে আমলকীর পাতা দেখেছে কিনা সন্দেহ। উদ্ভিদের রকম একই হলেও, রত্তি বিচি তিন বর্ণের হয়ে থাকে। বৃহদাকার লালের মধ্যে কিছুটা কাল দাগের এই বিচিটি দেখতে খুব সুন্দর। সর্বদা উজ্জ্বল ও চকচকে।
আরেকটি হলো ঠিক তার উল্টা বর্ণের। বৃহদাকার কালোর মধ্যে একটু লাল। আরেকটি হলো একেবারেই সাদা বর্ণের। দেখলে কোনো ক্ষুদ্র প্রাণীর ডিম বলে ভুল হতে পারে। শামুক-ঝিনুক থেকে আহরিত মুক্তায়, যত ঘষা খায়, সেটার উজ্জ্বলতা ততই বাড়ে। ভেষজ উদ্ভিদের এই দানাটিরও রয়েছে একই ধরনের খাসিয়ত। সাদা, কালো, লাল বর্ণের সবগুলো দানাই চকচকে হবার কারণে আগেকার যুগে এগুলো দিয়ে গলার হার, কানের দুল, হাতের ব্রেসলেট বানানো হতো। আর পুরুষেরাও এসব চাকচিক্যময় দামী উপহার স্ত্রীদের দিয়ে খুশিতে রাখতে পারত।
ভিন্ন জায়গায় একটু সমস্যাও ছিল। এই বিচিগুলো চরম বিষাক্ত। এগুলো কেউ গিলে ফেললে মারা যাবার কারণ ঘটে। মাটিতে পড়ে থাকলে গুরুত্বপূর্ণ কিছু দেখার সময় এগুলোতে আগে নজর পড়ে। ফলে শিশুরাও আগ্রহী হয়ে উঠে। তাই এগুলো মানুষের জন্য বিপজ্জনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করার ভয় থাকত। তাই যাদের কাছে এসব দানা থাকত তারা নিজ দায়িত্বে সংরক্ষণ করত।
আমাদের খামার বাড়িতে এটার একটি গাছ ছিল, তাই বেশ কিছু দানা আমার সংগ্রহে ছিল। খাদ্যের সাথে মিশিয়ে হাস-মুরগিকে খেতে দিতাম! তারা ঠোঁটে নিয়ে খাদ্যপযোগী কিনা পরখ করে দেখত। অতঃপর ফেলে দিত। কাক, শালিক ও কবুতরের বেলাতেও একই দৃশ্য দেখেছি। অর্থাৎ মানুষ ব্যতীত অন্য সকল প্রাণীই প্রকৃতির পরিচয় জানে। মানুষকে জ্ঞান দিয়ে পরখ করতে হয় কোন জিনিস কী কাজের।
হয়ত ভাববেন এত সুন্দর বিচির এত বদনাম কেন? আর কেনই বা স্বর্ণকারেরা এটাকে তাদের সোনা-চাঁদি মাপার বাটখারা বানিয়েছে? দুঃচিন্তার কোনো কারণ নেই। এই দানার ভেষজ গুণ অনেক বেশি। আয়ুর্বেদ ও ইউনানি শাস্ত্রে এর বহুবিধ ব্যবহার আছে। তাদের ওষুধে এসব ব্যবহার হয়। যৌনশক্তি তথা ‘রতি’ বৃদ্ধির কাজে ইউনানি হাকিমেরা এটার ব্যবহার করত। সে কারণে এটার নাম রতি থেকে রত্তি হয়েছে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, যেসব ভেষজ খেলে মানুষ মারা যায়, সে সব ভেষজ আবার মানুষের বাত-ব্যাধি ও মাংসপেশির সংবেদনশীলতার জন্য অনেক বেশি কার্যকরী। আবার তান্ত্রিকদের কাছে এই বিচির গুরুত্ব ভিন্ন ধরনের। তারা এটাকে ব্যবসায়ে লাভবান ও ভাগ্যের সাথে জড়িত করে। ভারতীয় উপমহাদেশের বেশিরভাগ স্বর্ণকারেরা ভাগ্যলিপিতে বিশ্বাস করে। তান্ত্রিকদের প্রভাবেই স্বর্ণকারেরা এই দানাকে বাটখারার অংশ বানিয়েছে।
আরেকটি অদ্ভুত চরিত্র হলো, এই দানার আকৃতি ও ওজন অবিকল একই হয়। হয়ত রত্তি দানা বাটখারা হয়ে উঠার পিছনে এটাও একটা কারণ হতে পারে। সকল ভেষজ আল্লাহর অফুরন্ত নেয়ামত রাজির অংশ। এসবের মধ্যে লুকিয়ে আছে মানুষের জন্য প্রভূত কল্যাণ ও উপকারিতা।