লন্ডনের আকাশ কালো করে হাসল রোম
লন্ডনের আকাশ কালো করে হাসল রোম - ছবি : সংগৃহীত
'অপেক্ষার স্টেশনে আমি রয়েছিলাম আজও বসে,
তুমি আসবে বলে কথা দিয়েও, আসলে না অবশেষে।
যদি কখনো মনে হয়, এবার তবে ফিরে যাই...
ফিরে এসো আমার তরে, আজো আছি অপেক্ষায়।'
ছোট্ট এই চারটি লাইনই যেন আজ বেজে চলেছে ইংলিশদের মনে। অপেক্ষা ছাড়া আর তাদের কিইবা করার আছে? ৫৫ বছর ধরে যে স্বপ্ন দেখছিল ওরা, সেই স্বপ্নের সীমানা আরো একবার বেড়ে গেল। তা কত দিন বা কত বছর তা বিধাতাই ভালো জানে। এবার ওরা সবে ভেবেছিল হয়তো অর্ধ শতকের এই প্রতীক্ষার অবসান হবে। সেই মুহূর্তটাকে বরণ করে নিতে কমতি ছিলন না তাদের প্রস্তুতি। গোটা ব্রিটিশ ভূমি রাস্তায় নেমে আসা ছিল রেফারির শেষ বাঁশির অপেক্ষা মাত্র। কিন্তু হায়! কপালে না থাকিলে কি আর আপনা আপনি আসিবে?
'অসীম দিগন্তের শেষে খুঁজে পেয়েছি তোমায়,
স্বপ্নীল মোহের স্রোতে ভেসে যাব অজানায়।
শত ব্যথার উপশম পেলা তুমি আসাতে,
দীর্ঘতর স্বপ্ন আজ সত্যি হলো তোমার ছুয়াঁতে।
কি করে বুঝাব তোমায়, মনেতে কি সুর বাজে,
তোমার জন্য রোমের আকাশ যে বর্ণালী সব সাজে।'
ছয় লাইনের এই ছন্দ যেন আজ আজ্জুরিদের মুখে মুখে। হবেই না বা কেন, ৫৭ বছর পর যে আজ অপেক্ষা ফুরিয়েছে। কত হাজার দিন চলে গেছে এই একটা দিনের অপেক্ষাতে, কত হাজার রাত বিনিদ্র গেছে তাকে পাবে বলে। মাঝে সুখসময় অনেক এসেছে, সুখানুভবও ধরা দিয়েছে। বিশ্বজয়ের স্বাদ একাধিকবার মিলেছে। কিন্তু আজকের স্বাদটা ভিন্ন। ১৯৬৪ সালের পর এই প্রথম যে ইউরো শিরোপা রোমে ফিরেছে। উপলক্ষটা আরো বড় করে দিয়েছে গতবারের বিশ্বকাপ ব্যর্থতা। তবে আর নয় শোক, দু'বছরের ব্যবধানেই যে পাল্টে গেছে ওরা। ওরা এখন ইউরো সেরা!
প্রথম ইউরো জয়ের স্বাদ পেতে থ্রি লায়ন্সরা ছিল দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, ছিল সর্বোচ্চটা নিংড়ে দেয়ার প্রত্যয়। সুবাদে সবাইকে বিস্মিত করে, কিছু বোঝার আগে মাঠে নামার দুই মিনিটেরই মাঝে ইংল্যান্ডের বল ইতালির জালে। পুরো ওয়েম্বলি যেন তখন বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাসে নেচে উঠল একই সাথে। সেকেন্ড ভগ্নাংশের কম সময়ে খানিকটা স্তব্ধতা ভেঙে নেচে উঠল গোটা ইংল্যান্ড। এই উন্মাদনা যে অর্ধশতকের অপেক্ষা ফল! ওদিকে গোলের সাথে সাথে ক্যামেরা গেল ভিআইপি গ্যালারিতে, ওখানে দৃশ্যমান মিশন ইম্পসিবল সুপার স্টার টম ক্রুজ। যেন ইংল্যান্ড দলটা তারই মতো মিশন ইম্পসিবল সাকসেসফুল করতে চলেছে।
কিন্তু আজ্জুরিরা কি এত সহজে ছেড়ে দিবে? ওরা তো বদলে গিয়ে নতুনত্ব নিয়ে এসেছে। এবার যে বদলে এই যাওয়ার স্বীকৃতি দরকার। তবে ওরা হাল ছাড়ে কী করে? সুবাদে মুহুর্মুহু আক্রমণে ইংল্যান্ড রক্ষণে কাঁপন ধরিয়েছে ওরা। কিন্তু আসরে মাত্র এক গোল হজম করা ইংল্যান্ডের রক্ষণ দুর্গ কী এত সহজে ভাঙা পড়ে? হয়েও হচ্ছিল না, কখনো আটকে যাচ্ছিল ইংলিশ গোল কিপারের চুম্বক শক্তিতে। অবশেষে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার বা লোহা দিয়ে লোহা কাঁটার মতো করে বোনুচ্চির গোলে রক্ষণ দিয়েই রক্ষণ ভাঙল আজ্জুরিরা।
নির্ধারিত সময়ের বাকি সময়টা শুধুই ইতালির। আক্রমণ আর আক্রমণে যেন দমবন্ধ করে তুলছিলো ওয়েম্বলি প্রাঙ্গণের হাজার ইংলিশ সমর্থকের। তবে আর গোল না আসায় ৯০ মিনিটেও সমাধা হয়নি ম্যাচের, অতিরিক্ত ৩০ মিনিটেও থেকে যায় সমতা। ফলে ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারণে যেতে হয় টাইব্রেকারে। ট্রাইবেকারে যখন ম্যাচ গড়াল ইংল্যান্ডবাসীর মনে হয়তো তখন ১৯৯৬ ইউরো সেমিফাইনালের দুঃসহ স্মৃতি ভেসে উঠেছিল। ভাসিয়ে দিয়েছিল ইংলিশ কোচ সাউথগেট। কারণ, তার ট্রাইবেকারে গোল মিসেই সেবার জার্মানির কাছে হারতে হয় ইংলিশদের। ফলে গ্যালারিজুড়ে প্রার্থনা শুরু হয়েছিল, যেন হারানো ব্যথা ফিরে না আসে, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি না হয় এবারে।
কিন্তু হায়... ইংলিশ সমর্থকদের প্রার্থনা বিফলে গেল। টানা দুটো বল জালে দিতে পারলেও বাকিগুলোতে বাধা হয়ে দাঁড়াল গোলপোস্ট আর গোল কিপার ডুনারোম্মা। আসরের সেরা খেলোয়াড়ও হয়েছেন এই ইতালিয়ান গোলকিপার। যাহোক, সানচোর শেষ শটটা দারুণ দক্ষতায় রুখে দেয়া মাত্রই যেন ইংল্যান্ডের আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেল। আরো একবার স্বপ্ন ভঙ্গ হলো, আর একবার শিরোপা হাত থেকে ছুটে গেল, আর বেড়ে গেল অপেক্ষার সময়সীমা। ততক্ষণে রোমের আকাশ রাতের আঁধারেও আলোকিত হয়ে গেছে।