আফগানিস্তান : যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে হিরো থেকে জিরো
ট্রাম্প ও বাইডেন : দুই মার্কিন প্রেসিডেন্ট - ছবি : সংগৃহীত
এটি ঠিক যে আমেরিকা যখন ২০ বছর আগে আফগান যুদ্ধ শুরু করেছিল, তখন তারা আত্মবিশ্বাসে টইটম্বুর এবং জয়ের জন্য দৃঢপ্রতিজ্ঞ ছিল। তবে যতই সময় গড়িয়েছে ততই আবিষ্কার করেছে যে এ যুদ্ধে জয়ী হওয়া তাদের পক্ষে সহজ নয়। প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেবার আগে সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বক্তব্যটি এক্ষেত্রে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি বলেছিলেন, ‘আফগানিস্তানে জয়ী হওয়া আমেরিকার পক্ষে সম্ভব। তবে এ জন্য দেশটিকে মানুষশূন্য করতে হবে, সেটি করে আমেরিকা সেখানে জয়ী হতে চায় না।’
ঐতিহাসিকভাবে এটি ঠিক যে আফগানিস্তান ছিল সাম্রাজ্যলিপ্সুদের জন্য কবরস্থান। ব্রিটিশরা একসময় আফগানিস্তান জয় করতে চেয়ে বিফল হয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পরিণতিও হয়েছে একই। সর্বশেষ একই পথের অনুগামি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রও। তবে এখানে যুক্তরাষ্ট্রের ভুলও ছিল অনেক। পাকিস্তানের ভূখণ্ডগত ব্যবহার আর ঘাঁটি গেড়ে আফগানিস্তানে তালেবানের পতন ঘটিয়েছে আর আল কায়েদার নেটওয়ার্ক ধ্বংস করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু আফগানিস্তানে দখল কায়েমের পর সেখানকার সামরিক বাহিনী, গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠান আর প্রশাসন সাজানো হয়েছে পাকিস্তানের বৈরী প্রতিবেশী ভারতকে দিয়ে। পাকিস্তানে অন্তর্ঘাতের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে আফগানিস্তানের মাটি। এতে পাকিস্তানের এক ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি আর তিন লাখের মতো প্রাণহানি ঘটেছে যার মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য রয়েছে ৪৩ হাজারের মতো। এর বিপরীতে পাকিস্তানের মাটি ব্যবহার আর ঘাঁটির জন্য যুক্তরাষ্ট্র টাকা দিয়েছে ১২ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলারের মতো। আর আফগানিস্তানের আমেরিকান ব্যর্থতার জন্য বার বার পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
আমেরিকার ভারতমুখী ও পাকিস্তান বৈরি নীতির ফলে ইসলামাবাদের সহায়তা নিয়ে প্রথম দিকে আফগানিস্তানে যে সাফল্য যুক্তরাষ্ট্র পেয়েছিল সেটি আর থাকেনি। এখন সেনা প্রত্যাহারের জন্য আবার সেই পাকিস্তানের সহায়তাই ওয়াশিংটনকে নিতে হচ্ছে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপারে পাকিস্তানের আস্থা বিশ্বাস এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, দেশটিতে নতুন করে মার্কিন ঘাঁটি করার প্রস্তাব দেয়ার সাথে সাথেই নাকচ করে দিয়ে পাক প্রধানিমন্ত্রী ইমরান খান বলেছেন, ‘যথেষ্ট অভিজ্ঞতা হয়েছে, কোনো যুদ্ধে পাকিস্তান আর কারো সহযোগী হতে চায় না। শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেই সাহায্যকারী হতে পারে কেবল।
’
তালেবান পরিকল্পনার রূপরেখা
১১ সেপ্টেম্বরের নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো সৈন্য প্রত্যাহার নিশ্চিত হবার পর তালিবান আগস্টে অন্তবর্তী ব্যবস্থার আলোচনায় লিখিত শান্তি পরিকল্পনা উপস্থাপন করতে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে তালিবানের স্পষ্ট বক্তব্য আসার পর অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা নিয়ে আশঙ্কার কিছুটা অবসান ঘটছে। এই অন্তর্বর্তী সরকারের ধরন কী হবে সে বিষয়ে নিশ্চিত কিছু প্রকাশ করা না হলেও প্রাপ্ত আভাস অনুসারে সব দল মতকে সমন্বিত করে একটি জিরগা বা সংসদ এবং কেন্দ্রীয় প্রাদেশিক প্রশাসন গঠনের প্রস্তাব থাকবে তালিবানের পক্ষ থেকে। প্রস্তাব অনুসারে তালিবানের নেতৃত্বে নিরাপত্তা বাহিনী পূনর্গঠন করা হবে। তবে সরকারের উপর তালেবানের একক নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। এমন একজন ব্যক্তিকে অন্তর্বর্তী রাষ্ট্র পরিচালনা পরিষদের প্রধানের দায়িত্ব দেয়া হবে যিনি তালিবানের কাছে গ্রহণযোগ্য হলেও তাদের নিজস্ব কেউ হবেন না। জাতিগতভাবে সব গোষ্ঠীর প্রতিনিধি অন্তর্বর্তী সরকারে থাকবে। প্রাদেশিক সরকার গঠনের ক্ষেত্রেও জাতিগত সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হবে। চার বছরের মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটির পূনর্গঠন এবং রাষ্ট্র পরিচালনার একটি সংবিধান ও কাঠামো ঠিক করবে অন্তবর্তী সরকার।
ধারণা করা হচ্ছে, তালিবান হিসেবে পরিচিত ‘ইসলামী অ্যামিরেটস অব আফগানিস্তান’ আগামী মাসে লিখিত প্রস্তাব আসার আগেই কাবুলের বাইরের প্রায় সব অঞ্চলের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে। তালিবান রাজধানী কাবুলে কোনো অভিযান পরিচালনা করবে না। এর মধ্যে আফগানিস্তানের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ অঞ্চল তালেবানের নিয়ন্ত্রণে বলে চলে গেছে উল্লেখ করা হচ্ছে। বাকিগুলোও দ্রুত তালিবানের নিয়ন্ত্রণে আসছে। সর্বশেষ কান্দাহার দখলের জন্য তালেবানের অভিযানের মুখে সেখান থেকে ভারতীয় মিশনের সব কর্মকর্তাকে বিমানে করে দেশে ফিরিয়ে নেয়া হয়েছে। সরকারি বাহিনী তালেবান যোদ্ধাদের হাতে অস্ত্র সমর্পণ করে ক্ষতিপূরণের অর্থ নিয়ে বাড়ি চলে যাবার ভিডিও প্রকাশ হচ্ছে একের পর এক।
রয়টার্সের এক রিপোর্টে বলা হয়, তালেবান আগামী আগস্টের গোড়ার দিকে আফগান সরকারকে একটি লিখিত প্রস্তাব দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। এক তালেবান মুখপাত্র এই বার্তা সংস্থাকে বলেছে যে, তারা বিদেশী বাহিনী আফগানিস্তান ছেড়ে যেতে থাকার সাথে সাথে দেশের প্রধান ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ লাভ করেছে। সমস্ত বিদেশী সৈন্য প্রত্যাহারের পরিকল্পনার অংশ হিসাবে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মূল আফগান ঘাঁটি বাগরাম খালি করায় আফগান সরকারি বাহিনীর মনোবল একবারেই ভেঙ্গে পড়েছে।
তালেবান মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ রয়টার্সকে বলেছেন, 'আগামী দিনগুলিতে শান্তি আলোচনা এবং প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হবে ... এবং তারা একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে প্রবেশ করবে বলে আশা করা হচ্ছে, স্বাভাবিকভাবেই এটি হবে শান্তির পরিকল্পনা সম্পর্কে।'
আফগানিস্তানের শান্তি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাজিয়া আনোয়ারি আন্তঃ-আফগান আলোচনা পুনরায় শুরু হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেছিলেন যে তালেবান রাষ্ট্রদূতরা এ প্রক্রিয়াটি প্রত্যক্ষভাবে শুরু করছে বলে তার সরকারের প্রতিনিধিরা ‘অত্যন্ত খুশি’।