মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ : পার্শ্বচরিত্র না সাইলেন্ট কিলার
মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ - ছবি : সংগৃহীত
মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। বাংলাদেশের ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা পার্শ্বচরিত্র, যিনি চরিত্র নিজেকে উজাড় করে, সবটা বিলিয়েও থেকে গেছেন আঁধারে। যখন দলের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তখন একজন মাহমুদউল্লাহ আছেন, যিনি সর্বস্ব উজাড় করে দিতে জানেন। মেধাবী কিংবা সর্বজয়ী কোনো রূপ নয়, বরং শ্রমিকরূপটাই বেছে নিয়েছেন বরাবরই। দল তাকে যখন যেখানে চেয়েছে, সেখানেই নির্দ্বিধায় খেলেছেন, পারফর্মও করেছেন। দল বিপর্যয়ে পড়লে তিনি দৃঢ় হাতে সামাল দেন, আবার রানরেটে পিছিয়ে পড়লে মারকাটারি ‘টর্নেডো’ ইনিংস খেলতে জানেন, আবার দলের প্রয়োজনে পার্টটাইমার হিসেবে বল হাতে তুলে নিয়ে এনে দিতে পারেন কাঙ্ক্ষিত সব ব্রেকথ্রু। এমনকি উইকেটরক্ষণের প্রয়োজনে উইকেটের পিছনে দাঁড়াতেও দ্বিধা করেন না তিনি।
তবে তাকে আমরা কখনো সেভাবে মূল্যায়ন করতে পারিনি, তার প্রতিভার যোগ্য স্বীকৃতি মেলেনি কখনোই। উপরন্তু পান থেকে চুন খসতেই তাকে বিষোদ্গার করতে আমাদের বিন্দুমাত্র বাঁধেনি কখনও, বরাবরই মিডিয়া এড়িয়ে চলতে চাওয়া মানুষটিই হয়ে উঠেন সবচেয়ে সহজ টার্গেট! সিনিয়রদের মাঝে সব থেকে বেশি নিবেদন নিয়ে প্রশ্ন তো তারই উঠে। অথচ ইতিহাস বলে, বাংলাদেশের ক্রিকেটের সব বড় বড় জয়ের অন্যতম সেরা চরিত্র তিনি। সুখকর সব মুহূর্তের গোপন কারিগর তিনি। আড়াল থেকেই দিয়ে যান সাধ্যের সবটা। তাকে বলা হয়, বাংলাদেশের ক্রিকেটের সাইলেন্ট কিলার। সত্যিই তো তাই। সাকিব, তামিমকে নিয়ে যতটা আলোচনা হয়, তার খানিকটাও কি হয় তাকে নিয়ে? হালের মিরাজ, তাসকিন থেকেও তো তিনি পিছিয়ে। তার বিশাল কোনো ফ্যানবেইজ নেই, নেই বিজ্ঞাপনের বড় ব্যানার।
তবু হাল ছাড়েননি রিয়াদ, চোয়ালবদ্ধ সংকল্পে লড়ে গেছেন দাঁতে দাঁত চেপে। যখনই দলের প্রয়োজন হয়েছে, অবতীর্ণ হয়েছেন মূল পুরোধা হিসেবে। ২ রানের বেদনায় পোড়া ওই এশিয়া কাপের ফাইনাল, কিংবা ৩ বলে ২ রানের হতাশায় দগ্ধ হওয়া কিছু মুহূর্ত এসেছে ঠিক, তবে তার চেয়ে ঢের বেশি ম্যাচ একা হাতে তুলে এনেছেন তিনি। কিন্তু আর পারেননি সহ্য করতে। এত অপবাদ সহ্য হয় কি করে? দেশের শততম টেস্টের গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষী তার হওয়া হয়নি। তবুও কিছু বলেননি, চুপ ছিলেন, সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। এরপর আবারো দলে ফিরেছেন, ভালো-খারাপের মিশেলে পারফর্ম করেছেন। কিন্তু জিততে পারেননি মন। ফলে হঠাৎ সুযোগে পাওয়া জিম্বাবুয়ে সফরটাকে কাজে লাগালেন নিজের মতো করে। অতঃপর সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন... যদিও গত দু'দিনে বাস্তবতা বুঝে আসেনি, গুঞ্জনেই সীমাবদ্ধ ছিলো তা।
শেষ পর্যন্ত আর গুঞ্জনেই তা সীমাবদ্ধ রইল না, নিয়ে নিলো বাস্তব রূপ। শেষ শঙ্কা দূর করে বেজে গেল বিদায় ঘণ্টা সাদা পোশাকের ক্রিকেটে জাতীয় দলের হয়ে খেলে ফেললেন নিজের শেষ ম্যাচটা। জিম্বাবুয়ের মাটিতে হারারের মাঠে আজ শেষবারের মতো মাঠে নামলেন মাহমুদউল্লাহ। বিদায় যে নেবেন তা চলতি টেস্টের তৃতীয় দিনে মাঠে নামার আগেই সতীর্থদের জানিয়েছিলেন তিনি। দিনটি ছিল ৯ জুলাই। অবাক করা বিষয় হলো মাহমুদউল্লাহর টেস্ট অভিষেকও হয়েছিল সেদিন থেকে ঠিক এক যুগ আগে ২০০৯ সালের ৯ জুলাই তারিখে, ক্যারাবীয় দ্বীপপুঞ্জের সেন্ট ভিনসেন্টে।
জীবনের চলার পথে, গোল এই চলার পথে পার্শ্বচরিত্ররা বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে। হোক তা সিনেমাতে, কিংবা ক্রিকেট মাঠে। কি আর করা, ইতিহাসই যে বড় নিষ্ঠুর আর স্বার্থপরতায় ঘেরা। সে তার অতল গর্ভে পরম মমতায় আগলে রাখে শুধু সেরাদের। পার্শ্বচরিত্রের কোনো ঠাঁই নেই সেখানে। খেলার মাঠ হোক আর রণক্ষেত্র, জয় কিভাবে এলো বা কে সমর্থন দিলো তা কেউ মনে রাখে না। সব ভুলে মানুষ কুর্নিশ জানায় শুধুই বিজয়ীকে। আধুনিকতার এই যুগ আরো বেশি বিজয়-পূজারী। অমোঘ সত্যটা মাহমুদউল্লাহও জানেন। জানেন যাত্রার শেষটা মধুর না হলে মানুষ একদিন ভুলে যাবে। কারণ ‘সব ভালো তার, শেষ ভালো যার’ এই রীতিতেই এখন মানুষ বিশ্বাস করে।
ভাগ্যিস ভালো ১৫' বিশ্বকাপটা সাজিয়ে ছিলেন নিজের মতো করে, দেশের হয়ে বিশ্বকাপে তুলে নিয়েছিলেন প্রথম সেঞ্চুরি। রেকর্ড গড়ে তাও টানা দুই ম্যাচে। আর নিদাহাস ট্রফির ম্যাচটায় ছক্কা হাঁকিয়ে এনেছিলেন জয় ছিনিয়ে। নয়তো, এই মাহমুদউল্লাহকে কে মনে রাখত? কি দিয়ে মনে রাখত? ইতিহাস কি আর পার্শ্বচরিত্রকে মনে রাখে...