সুদ ও মুনাফার পার্থক্য কোথায়?
সুদ ও মুনাফার পার্থক্য কোথায়? - ছবি : সংগৃহীত
বর্তমান বিশ্বে ইসলামী ব্যাংকিং কার্যক্রম দ্রুত বিকাশ লাভ করায় সুদ ও মুনাফার বিষয়টি নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্নের উদ্ভব হয়েছে। কেউ কেউ সুদ ও মুনাফাকে এক মনে করে থাকেন। প্রকৃতপক্ষে সুদ ও মুনাফা এক নয়। এ দুয়ের মধ্যে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক অনেক পার্থক্য রয়েছে। ‘সুদ’ উর্দু শব্দ। আল কুরআনে ‘রিবা’ সুদের প্রতিশব্দ। অনেকের দৃষ্টিতে রিবা ও সুদ সমার্থবোধক বলে বিবেচিত। প্রকৃতপক্ষে রিবা শব্দটি ব্যাপক অর্থবোধক। সুদ এর একাংশ মাত্র। সুদকে ইংরেজিতে ইউজারি বা ইন্টারেস্ট বলা হয়।
‘রিবা’-এর পারিভাষিক অর্থ বেশি হওয়া, বৃদ্ধি পাওয়া, অতিরিক্ত, সম্প্রসারণ, মূল থেকে বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পরিশোধের শর্তে কোনো নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য বা অর্থের বিপরীতে পূর্ব নির্ধারিত হারে যে অধিক পরিমাণ পণ্য বা অর্থ আদায় করা হয়, তাকেই বলে সুদ। আবার একই শ্রেণীভুক্ত পণ্যের পারস্পরিক লেনদেনের সময় চুক্তি মোতাবেক অতিরিক্ত যে পরিমাণ পণ্য গ্রহণ করা হয়, তাকেও রিবা বা সুদ বলা হয়। সুদ প্রধানত দুই প্রকার- রিবা আন নাসি’আহ বা মেয়াদি সুদ এবং রিবা আল ফদল।
আরবি নাসি’আহ শব্দের অর্থ হচ্ছে মেয়াদ, সময় নেয়া, বিলম্ব বা প্রতীক্ষা। রিবা নাসি’আহ হচ্ছে ঋণের ওপর সময়ের অনুপাতে ধার্যকৃত অতিরিক্ত অংশ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কেউ যদি কাউকে ১০০ টাকা ঋণ দেয় এ শর্তে যে, তাকে মেয়াদান্তে ১১০ টাকা দিতে হবে। এখানে অতিরিক্ত ১০ টাকাকে সুদ বলা হবে। এই সুদকে আল কুরআনে রিবা আন নাসি’আহ বা রিবা আল কুরআন বলা হয়। অন্য দিকে আরবি ‘ফদল’ শব্দের অর্থ অতিরিক্ত। একই জাতীয় জিনিস লেনদেনে কমবেশি করে আদায় করার নাম রিবা আল ফদল। অর্থাৎ একই জাতীয় দ্রব্য বা মুদ্রার লেনদেনকালে একপক্ষ আরেকপক্ষের কাছ থেকে চুক্তি মোতাবেক শরিয়াসম্মত বিনিময় ব্যতীত যে অতিরিক্ত মাল গ্রহণ করে তাকে রিবা আল ফদল বলে। যেমন এক কেজি উন্নতমানের খেজুরের সাথে দেড় কেজি নিম্নমানের খেজুর বিনিময় করা হলে আধা কেজি খেজুর সুদ এবং এ ধরনের সুদকে রিবা আল ফদল বা মালের সুদ বলা হয়।
‘রিবহুন’ শব্দের প্রতিশব্দ হলো লাভ বা মুনাফা। ইসলামী শরিয়তে মুনাফা হচ্ছে ‘সম্পদের এমন প্রবৃদ্ধি যা কোনো অর্থনৈতিক কারবারে সম্পদ বিনিয়োগ করার ফলে অর্জিত হয়। উদ্যোক্তা প্রথমে বিনিয়োগকৃত অর্থকে পণ্যে রূপান্তর করে, অতঃপর উক্ত পণ্য বিক্রি করে পণ্যকে অর্থে রূপান্তর করে। এভাবে রূপান্তরিত অর্থ বিনিয়োগকৃত অর্থের তুলনায় বেশি হলে উদ্যোক্তা লাভ পায় আর প্রাপ্ত অর্থ আগের তুলনায় কম হলে তার পুঁজি কমে যায় বা তার লোকসান হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একজন ব্যবসায়ী ১০ হাজার টাকার পণ্য ক্রয় করে ১২ হাজার টাকায় বিক্রি করল। এখানে পুঁজি বৃদ্ধি পেয়েছে দুই হাজার টাকা। পুঁজির এ বর্ধিত অংশ হলো মুনাফা বা লাভ। আর পুঁজি কমে গেলে তাকে বলা হতো লোকসান। ব্যবসায়ে লাভ-লোকসানের ক্ষেত্রে পুঁজিকে পণ্যে রূপান্তর ও শ্রম বিনিয়োগের সাথে সাথে ঝুঁকিও গ্রহণ করতে হয়।
উল্লেখ্য যে, সুদের মাধ্যমে মূলধন বৃদ্ধি পায়, আবার ব্যবসায়ের মাধ্যমেও তা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ইসলামে রিবার মাধ্যমে অর্জিত বৃদ্ধিকে হারাম ঘোষণা করা হয়েছে আর ব্যবসার মাধ্যমে বৃদ্ধিকে হালাল করা হয়েছে। কেননা, ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীকে মূলধন ও শ্রম বিনিয়োগ করতে হয়েছে এবং ঝুঁকি গ্রহণ করতে হয়েছে। মূলধন ও শ্রম বিনিয়োগ এবং ঝুঁকি গ্রহণের মাধ্যমে মূলধনের যে বৃদ্ধি তা-ই মুনাফা। এখানে আরো উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কেউ যদি কোনো ব্যক্তিকে ১০ টাকা ঋণ দেয় এ শর্তে যে এক দিন পরে তাকে ১১ টাকা দিতে হবে। এখানে অতিরিক্ত ১ টাকা সুদ, যা শরিয়তে হারাম। বিপরীতপক্ষে, কেউ যদি হাট থেকে ১০ টাকা দিয়ে এক কেজি বেগুন কিনে অন্য বাজারে গিয়ে ১৫ টাকায় বিক্রি করে, তা হলে যে পাঁচ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে, তাকে সুদ বলা যাবে না। এই পাঁচ টাকা লাভ, যা হালাল বলে গণ্য হবে।
পরিশেষে সুদ ও মুনাফার পার্থক্য সংক্ষেপে বলা যায় এভাবে : মুনাফা বেচাকেনা বা ব্যবসার স্বাভাবিক ফল থেকে আসে। বিপরীতপক্ষে, সুদ অর্জিত হয় ঋণের ওপর। মুনাফা উদ্যোক্তার পুঁজি, শ্রম ও সময় বিনিয়োগ এবং ঝুঁকি গ্রহণের ফল, কিন্তু সুদের ক্ষেত্রে ঋণদাতা পুঁজি, শ্রম ও সময় বিনিয়োগ এবং ঝুঁকি গ্রহণ করে না, অর্থ ধার দেয় মাত্র। মুনাফা অনির্ধারিত ও অনিশ্চিত, কিন্তু সুদ পূর্বনির্ধারিত ও নিশ্চিত। মুনাফায় ঝুঁকি গ্রহণ করতে হয়, আর সুদে তা গ্রহণ করতে হয় না। ব্যবসায় কোনো পণ্যের ওপর লাভ একেবারে নির্ধারণ করা যায়, কিন্তু একই মূলধনের ওপর বারবার সুদ নির্ধারণ ও আদায় করা যায়।
লেখক : সাবেক ডিএমডি, ইসলামী ব্যাংক, বর্তমানে কো-অর্ডিনেটর, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক