হেল্পিং হ্যান্ড
হেল্পিং হ্যান্ড - ছবি : সংগৃহীত
ট্রে হাতেই দাঁড়িয়েছিলাম। এক কাপ দুধ চা, একটা সিঙ্গারা একটা আলুর চপ। এখানকার নিয়মানুযায়ী চায়ের সাথে টা যা-ই নিন না কেন, তা জোড়ায় কিনতে হবে। কিন্তু আজ আর সিঙ্গারা নয়, তাই একটি আলুর চপ মিলিয়ে জোড়া নিলাম। মনের ইচ্ছে তো আল্লাহই ভালো জানেন। আমার বাসার হেল্পিং হ্যান্ডের জন্য প্রতিদিনের মতোই একটা সিঙ্গারা নিয়ে যাব যেহেতু সে সিঙ্গারাই পছন্দ করে আর গরম গরম সিঙ্গারাটি হাতে পেয়ে সে যে কি তৃপ্তির হাসিটি দেয়- তা আমার সারা দিনের ক্লান্তি জুড়িয়ে এক স্বর্গীয় সুধা বইয়ে দেয় হৃদয়ে।
আসলে সন্তানদের সুশিক্ষার জন্য একটা পারিবারিক আদর্শ গঠনের লক্ষ্যে আমি আর আমার চিকিৎসক স্বামী বিয়ের প্রথম থেকেই বেশ কিছু পরিকল্পনা নিয়ে নিই। পরিবার পরিকল্পনা বলতে যে শুধু জন্ম নিয়ন্ত্রণকেই বুঝায় না বরং একটা সুষ্ঠু সুন্দর পরিকল্পনায় সংসার সন্তান তথা জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তোলাও যে একটি অন্যতম পরিকল্পনা সেটিও বুঝাতেই তথা প্রতিষ্ঠা করতেই আমরা দু’জন পরিবারে বেশ কিছু নিয়ম কানুন প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করি। এরই মধ্যে অন্যতম একটি হলো বাসার গৃহপরিচারিকাদেরে শিশুরা যাতে সম্মানের চোখে দেখতে পারে তার জন্য কখনো কাজের লোক না বলে আমরা ‘হেল্পিং হ্যান্ড’ বলেই ধারণা দিতে অভ্যস্থ হয়ে উঠি।
বলছিলাম আমার সেই হোল্পিং হ্যান্ডের তৃপ্তিময় হাসির কথা। হ্যাঁ, যে হাসি দেখে আমার ব্যস্ত হৃদয়ে আনন্দের ফল্গুধারা বইতে শুরু করে, সাথে সাথে প্রত্যয় জাগে আরেকটা নতুন কিছু লেখার।
এদিক-ওদিক তাকাচ্ছিলাম। কোনো চেয়ার খালি নেই। সন্ধ্যা হতে হতে ভিড় যেন উপচে পড়ে। সালাতুল আসর আদায়ের জন্য উঠে গিয়েছিলাম। নামাজ পড়ে ক্যান্টিন থেকে চা নিয়ে ফিরে আসতেই জায়গা দখল। ওদিকে হঠাৎ আশ্বিনের আকাশ ভারী বৃষ্টি মাটির বিছানায় ঢেলে দিয়ে হালকা হলো বটে কিন্তু ভাসিয়ে দিলো ঢাকা শহর। খরস্রোতা নদীর মতো রাস্তার পানি কাটছে রিকশা-গাড়ি; মুহূর্তেই গড়ে উঠছে মিনি সুইমিংপুল! সেরকমই ভিজিয়ে দিয়ে গেল এখানেও বাইরে পাতা চেয়ার-টেবিলগুলো। গায়ে হলুদ দেয়া কন্যাকে ভিজানোর মতোই ওরাও ভিজে পড়ে আছে। এদিকে নবাগতরাসহ সব ভেতরমুখী হওয়ায় যেমনি ভিড় তেমনি চেয়ার সঙ্কট দেখা দিলো।
ঘটনাটি হচ্ছে ধানমন্ডি সাতাশ নম্বরে অবস্থিত একটি হাউজের সান্ধ্যকালীন সময়ের। সপ্তাহে প্রায় দু’দিন আমি এখানে স্টাডি করে থাকি। ভীষণ ভালোলাগার একটা পরিবেশ। নাতনীদের কুরআন শেখার বৈকালিক ক্লাসে রেখে দুই ঘণ্টা সময় পাই। এ সময়টুকু আমার, একান্তই আমার। ২৫ বছর চাকরি শেষে আজ নাতনীদের সময় দিতে গিয়ে নিজেও কিন্তু কম লাভবান হইনি। এই প্রাণভরে বই পড়ার সুযোগ! বইপাগলা আমার জন্য সত্যিই এটি এক বিশেষ সময়। বিভিন্ন ধরনের বইয়ে ঠাসা সেলফের পরে সেলফ। ইচ্ছেমতো টেনে নিয়ে পড়া যায় কোনো শর্ত নেই। সবাই যে পাঠক তা নয়, কিছু কিছু দর্শকও আছেন। আছেন গপ্পিস, চাখোর আমার মতো বিলাসী বয়স্করাও। তবে আমার মতো ‘একাকী’ খুবই কম।
আজ পড়ছিলাম ‘নির্বাচিত প্রবন্ধ-নিবন্ধ’ একটি বই। যেখানে কিছু পরিচিত প্রিয়জনের লেখা প্রাণবন্ত ছোঁয়ায় মাখিয়ে রেখেছিল বইটিকে। যেমন- জুবাইদা গুলশান আরা, নয়ন রহমান, আসমা আব্বাসী, সেলিনা আলী, সেগুপ্তা ইয়াসমিন, রওশন রোশনাই প্রমুখ। এদের কেউ আমার প্রত্যক্ষদর্শী কেউ আবার পরোক্ষ ভালোবাসার মানুষ। সেই আশির দশকের দাপুটে লেখিয়ে এরা। সে সময় আজকের মতো ভার্চুয়াল জগৎ ছিল না। পত্রিকায় পত্রিকায়-ই চেনা-জানা, কালেভদ্রে কোনো অনুষ্ঠানে দেখা। তবু যেন কত আপন-কত কাছের। আজ ভার্চুয়াল জগতে এসে এদের আবার কাউকে কাউকে পেয়েও গেছি, এই তো সেদিন অভিনেত্রী-আবৃত্তিকার কেয়া চৌধুরী, প্রজ্ঞা লাবনী- সে কি উচ্ছ্বলতা, এতটা বছর পর ফিরে পাওয়া। সত্যিই পৃথিবীটা গোলÑ নস্টালজিয়ায় ডুবে গেলাম।
আন্টি চেয়ার লাগবে? হঠাৎ প্রশ্নে ঘুরে দাঁড়ালাম। দুটো ছেলে। ছাত্র হবে হয়তো। পিঠে ব্যাগ- ভদ্র পোশাক। উত্তরের অপেক্ষা না করে আমার সম্মতিসূচক চাহনি দেখেই ওরা এগিয়ে গিয়ে কাউন্টার থেকে টিস্যু পেপার এনে সেই গায়ে হলুদে গোসল করা কন্যার মতো ভেজা চেয়ার-টেবিল এনে মুছে বিছিয়ে দিলো কাউন্টারের কাছেই এক কোণায়। ফলে চা-পায়ীদের দাঁড়ানো লাইনটা একটু বেঁকে গেল। আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম। হাসিমুখে আমার হাত থেকে চায়ের ট্রে টা নামিয়ে টেবিলে রেখে ওরা বলল- এবার বসুন, এখন পড়ুন, চা নিন। প্রবন্ধের বইটা আমার হাতেই ধরা ছিল।
জাজাকাল্লাহু খাইরান বলে আমি ভদ্রতাসূচক আহ্বান করলাম আমার সাথে শেয়ার করতে। কিন্তু বিনয়ের সাথে ধন্যবাদ জানিয়ে ওরা ফিরে যাচ্ছিল- কৌতূহলী মন আমার বিস্ময় তাড়িত ঘোর কাটিয়ে বলে ফেলল; এখনো আছে মানবতা! এমন সোনার ছেলে! মুখে বললাম, শোনো, তোমরা তো চলেই যাচ্ছিলে, তবে আমার জন্য এতটা কষ্ট করে তোমাদের এত ব্যস্ততার মধ্যেও সময় নষ্ট করলে যে!
না না, জোর প্রতিবাদ জানিয়ে ওরা বলল- এটাতে আমাদের কোনো সময় নষ্ট হয়নি আন্টি। প্রতিদিন একটা ভালো কাজ করা আমাদের স্পৃহা! আমরা সবাই সবার হেল্পিং হ্যান্ড। হেল্পিং হেন্ড! অভিভূতের মতো আমার দৃষ্টি ওদের চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে থাকল- মনে হলো ওদের বাবা-মা ও কি আমাদের মতোই প্ল্যানিং? সন্তান মানুষ করা, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়া, জাতির বোঝা না হওয়া, ইত্যাদি ইত্যাদি! চোখে ভাসলো বাসায় অপেক্ষারত আমার হেল্পিং হ্যান্ড লতিফার তৃপ্তিমধুর হাসিটা! আহারে! মাঝে মাঝে আমি যখন ওর নির্ধারিত কাজগুলো করে দেই অনেক সময় ওকে একটু রিলাক্স দেয়ার জন্য- ওর সে কি কৃতজ্ঞতা। পরদিন পারলে আরো দ্বিগুণ কাজ করে দেয় সংসারের। তবে কি আমিও, আমরা সবাই সবার হেল্পিং হ্যান্ড? ছেলেগুলোর ছোট্ট উত্তর। কথাটা সত্যি? কে তোমরা বাপু? তোমাদের সংখ্যা বাড়িয়ে দিন আল্লাহ তায়ালা।
কতদিন পর যেন একটা লম্বা শ্বাস নিতে পারলাম আমি।