যে কারণে পাওয়া যাচ্ছে না করোনার টিকা

অন্য এক দিগন্ত | Jul 10, 2021 08:14 am
করোনার টিকা

করোনার টিকা - ছবি : সংগৃহীত

 

ঢাকার উপকণ্ঠে তার আন্তর্জাতিক মানের কারখানায় বসে আব্দুল মুক্তাদির দেখছেন, করোনাভাইরাসের টিকা পাওয়ার জন্য সারা বিশ্ব কেমন হিমশিম খাচ্ছে। এবং তাতে কোনো ধরনের সহযোগিতা করতে না পেরে তিনি অত্যন্ত হতাশ।

তার কারখানায় ইতোমধ্যেই ১১টি ভিন্ন ধরনের টিকা উৎপাদন করা হচ্ছে যার মধ্যে রয়েছে হেপাটাইটিস, হাম ও জলাতঙ্ক। কিন্তু কোভিড-১৯ রোগের জন্য কোনো টিকা এই কারখানায় উৎপাদন করা হচ্ছে না।

কারখানাগুলো অলস বসে আছে, আমার শুধু দরকার মৌলিক কিছু কাঁচামাল। তার কারাখানায় যে টিকা উৎপাদন করা যেতে পারে সেটা জানাতে তিনি টিকা উৎপাদনকারী বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

তিনি বলেন, আমরা প্রচুর পরিমাণে টিকা উৎপাদন করতে পারি এবং সেই বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতাও আমাদের রয়েছে। কিন্তু কোনো কিছু যাচাই বাছাই না করেই লোকজন বলে দেয় যে স্বল্প আয়ের দেশ অথবা কোম্পানির এসব উৎপাদনের বিশেষ জ্ঞান ও দক্ষতা অথবা সেরকম ব্যবস্থাপনা নেই।

বিশ্বের ইতিহাসে গত বছর সবচেয়ে বেশি সংখ্যক টিকা বিতরণ করা হয়েছে এবং ইতোমধ্যেই কোভিড-১৯ এর ৩২০ কোটি ডোজ দেয়া হয়েছে।

কিন্তু টিকার এই বিতরণ ভারসাম্যপূর্ণ নয়। কিছু দেশ যেখানে ইতোমধ্যেই তাদের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ জনগণকে টিকা দিয়ে দিয়েছে, সেখানে স্বল্প আয়ের বহু দেশ এখনও তাদেরকে দুই শতাংশ জনগণকেও টিকা দিতে পারেনি।

কেউ কেউ মনে করেন সমস্যা হচ্ছে ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি বা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ, টিকা উৎপাদনকারীরা তাদের লাভ নিশ্চিত করার জন্য টিকা উৎপাদনের প্রযুক্তি পেটেন্ট করে নিজেদের মধ্যে রেখে দেয়ায় এর উৎপাদনও অনেক সীমিত।

টিকা উৎপাদকরা তাদের উৎপাদনের পদ্ধতি অনুকরণ করলে পেটেন্ট ভঙ্গ করার অভিযোগে যে কোনো কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে পারে। বায়োটেক প্রতিষ্ঠানগুলোর যুক্তি হচ্ছে : এধরনের আইনি সুরক্ষার কারণে তারা কিছু সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকে যার ফলে তারা খুব দ্রুত টিকা উৎপাদন করতে পারে।

কিন্তু পিপলস ভ্যাকসিন্স অ্যালায়েন্সের মতো ক্যাম্পেইন গ্রুপগুলোর যুক্তি হলো- এই প্রযুক্তি জনগণের সম্পদ কারণ যুক্তরাজ্য অথবা যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের সরকার এসব কোম্পানিকে টিকা উৎপাদনের জন্য বড় ধরনের অনুদান দিয়ে সাহায্য করেছে।

গত বছরের শেষের দিকে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাছে আপিল করেছে কোভিড-১৯ টিকার পেটেন্ট তুলে নেয়ার জন্য। তখন থেকেই এই উদ্যোগ উল্লেখযোগ্য রকমের সমর্থন পেয়েছে।

এই মে মাসে পেটেন্ট তুলে নেয়ার আবেদনে সমর্থন দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু ব্রিটেন ও জার্মানি এখনো এই উদ্যোগের বিরোধিতা করছে।

কিন্তু আব্দুল মুক্তাদির মনে করেন, এই আন্দোলনে একটি বিষয়ের উল্লেখ নেই। আমি জানি না লোকেরা কেন ভুল জায়গায় হাত দিচ্ছে। বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই, বলেন তিনি।

সব উৎপাদনকারী এর সাথে একমত নন। দক্ষিণ আফ্রিকায় টিকা উৎপাদনকারী কোম্পানি বায়োভ্যাকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্যাট্রিক টিপ্পো বিবিসিকে বলেন, বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদের শর্তটি তুলে নেয়া এই সমস্যা সমাধানের একটি অংশ, এবং এজন্য বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় তার দেশ যে উদ্যোগ নিয়েছে তিনি তার প্রশংসা করেছেন।

তবে তিনি মুক্তাদিরের সাথে একমত যে শুধুমাত্র এটাই বিশ্বব্যাপী টিকা সঙ্কটের সমাধান নয়।

ফাইজার যদি টিকা তৈরির সম্পূর্ণ রেসিপি বা প্রস্তুতপ্রণালী আজকে বায়োভ্যাককে দেয়, তাহলে প্রথম ডোজের টিকা বাজারে নিয়ে আসতেও আমাদের কয়েক বছর সময় লেগে যাবে, বলেন তিনি।

তিনি বলেন, কোভিড-১৯-এর টিকা উৎপাদন ত্বরান্বিত করার জন্য প্রযুক্তি এবং জ্ঞানের হস্তান্তর সবচেয়ে দ্রুত এবং ভালো উপায়।

এই প্রক্রিয়াকে তিনি বীজ থেকে গাছ বড় করার সাথে তুলনা করেন : আপনাকে সঠিক বীজ পেতে হবে এবং তার পর আপনি গাছটিকে বড় করবেন এবং তা থেকে ফল সংগ্রহ করবেন।

দ্বিতীয়ত, উৎপাদনের ব্যাপারে কারখানার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য ওই কোম্পানিকে বাংলাদেশে যেতে হবে।

তার যদি বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ ব্যবহারের অনুমতিও থাকে, তার পরও যেকোনো টিকা উৎপাদন করলে তাকেও পরীক্ষার এই তিনটি ধাপের ভেতর দিয়ে যেতে হবে। বর্তমানে যেসব টিকা বাজারে আছে সেগুলোকেও এই তিনটি ধাপ পার হয়ে আসতে হয়েছে।

এজন্য অন্তত এক বছর লেগে যেতে পারে।

মুক্তাদির মনে করেন, এসব কোম্পানিকে যদি তাদের ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি বা বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ হস্তান্তরে বাধ্য করা হয় তাহলে সেটা ভালোর চেয়ে খারাপই করতে পারে বেশি।

তাদেরকে এরকম একটি ভুল ও স্পর্শকাতর দিকে ঠেলে না দিয়ে, তাদের বরং শক্ত নেতৃত্ব এবং ওষুধ প্রস্ততকারক কোম্পানিগুলোর সাহায্য ও দিক-নির্দেশনা প্রয়োজন, তিনি বলেন।

সারা বিশ্বে টিকা সরবরাহের যে সমস্যা তা সমাধানের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এখন পর্যন্ত কোভ্যাক্স উদ্যোগের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।

এই কোভ্যাক্স উদ্যোগের আওতায় টিকা কেনা হয়, এবং দরিদ্র দেশ যাদের টিকা কেনার সামর্থ্য নেই, তাদের কাছে টিকা সরবরাহ করা হয়। কিন্তু এই কোভ্যাক্স প্রকল্প টিকার জন্য অল্প কিছু সংখ্যক উৎপাদনকারীর উপর প্রচণ্ডভাবে নির্ভরশীল।

এই কোভ্যাক্সের কাছে বেশিরভাগ টিকা আসে একটি মাত্র কারখানা থেকে এবং সেটি হচ্ছে ভারতের সিরাম ইন্সটিটিউট।

কিন্তু ভারতে যেহেতু এপ্রিল মাসে বিপুলসংখ্যক মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে, সেকারণে সিরাম ইন্সটিটিউট ঘোষণা করেছে যে এ বছর তারা ভারতের বাইরে আর কোনো কোভিড-১৯ টিকা রফতানি করবে না।

কোভ্যাক্সকে তারা এ বছর ৯ কোটি ডোজ সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু এই টিকা আর দেয়া হচ্ছে না।

মুক্তাদির মনে করেন, কোভ্যাক্সের পেছনে যে পরিমাণ শক্তি ব্যয় করা হচ্ছে, সেটা টিকা উৎপাদন বাড়ানোর পেছনে ব্যয় করা উচিত ছিল।

কোভ্যাক্স উদ্যোগের পেছনে যারা আছে- বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, সেন্টার ফর এপিডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস এবং ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স গ্যাভি- তারা এখন এটাই করার চেষ্টা করছে।

মে মাসে তারা কোভ্যাক্স ম্যানুফ্যাকচারিং টাস্কফোর্স গঠন করেছে। এর পেছনে উদ্দেশ্য হচ্ছে- টিকা সরবরাহের সমস্যা, বিশেষ করে কাঁচামালের ঘাটতি মেটানোর বিষয়ে উপায় খুঁজে বের করা।

এছাড়াও সরবরাহের বেলায় যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়ে গেছে এই টাস্কফোর্স সেসব সমাধানেরও চেষ্টা করবে।

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যেসব উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত টিকা উৎপাদন করেছে কিন্তু সেগুলো শিশিতে ভরার ক্ষমতা নেই, তাদের সাথে সেসব কোম্পানির যোগাযোগ ঘটানো, যাদের এটা করার কারখানা বা ক্ষমতা রয়েছে।

আমি এটাকে বলছি কোভ্যাক্স টিন্ডার, বলছেন মার্টিন ফ্রেডি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার টিকা গবেষণা ইউনিটের কর্মকর্তা।

এছাড়াও তিনি নিম্ন ও মধ্যম-আয়ের দেশগুলোর জন্য এমআরএনএ টিকা উৎপাদনের ব্যাপারে প্রযুক্তি শেয়ারের একটি কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য কাজ করছেন।

এই কেন্দ্রে জ্ঞান শেয়ার করা হবে এবং কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

এসব কেন্দ্র টিকা উৎপাদনকারী কারাখানা হিসেবেও কাজ করবে। টিকা তৈরির জন্য যেসব কাঁচামাল প্রয়োজন, এসব কেন্দ্রে সেগুলোর উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করা হবে এবং উৎপাদনকারীদের মধ্যে এই কাঁচামাল বিতরণের ব্যাপারে সাহায্য করা হবে।

এর আগে এইচওয়ান এনওয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকা বেলাতেও এরকম করা হয়েছিল।

গত মাসে ঘোষণা করা হয়েছিল যে প্রথম কেন্দ্রটি হবে দক্ষিণ আফ্রিকায় এবং এই প্রকল্পে বায়োভ্যাক জড়িত থাকবে।

টিকা প্রস্ততকারক কোম্পানিগুলো কিভাবে একে অপরকে সহযোগিতা করবে সেটা নির্ধারণ করার জন্য মার্টিন ফ্রিড এবং তার দল এখনও প্রস্ততকারকদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।

কোনো কোনো প্রযুক্তি অন্যগুলোর চেয়ে বেশি উন্নত। কিন্তু কেউ কেউ তাদের প্রযুক্তি অন্যদের জন্য খুলে দেয়ার জন্য প্রস্তুত, বলেন তিনি।

এটা হয়তো এরকম হতে পারে- প্রস্ততকারক যে কোম্পানিটি এখনো তাদের টিকা তৈরি কাজ শেষ করতে পারেনি তারা এগিয়ে আসবে এবং ওই কেন্দ্র তাদেরকে এবিষয়ে সাহায্য করবে।

তবে এজন্য কিছু সময় লাগতে পারে।

আমরা জানি না কোভিড কতোদিন থাকবে, সেকারণে আমাদেরকে আজকেই শুরু করতে হবে কারণ এজন্য দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হতে পারে, বলেন ফ্রিড।

এটা হতে পারে- আমরা যেটা করছি সেটা আমাদেরকে দীর্ঘ কোভিড মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত করছে, অথবা হয়তো আগামী মহামারির জন্য।

আব্দুল মুক্তাদির সবে মাত্র কোভ্যাক্স টিন্ডার বিষয়ে জানতে পেরেছেন এবং তিনি আশা করছেন যে এই উদ্যোগ টিকা উৎপাদনে তার কারখানাকে সাহায্য করবে।

এখনো তিনি টিকা প্রস্ততকারকদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু সফল হননি। এজন্য তিনি তাদেরকে দায়ীও করছেন না।

সম্ভবত তারা খুব ব্যস্ত, তিনি বলেন, তারা ধারণা করতে পারেনি যে এরকম পরিস্থিতি তৈরি হবে। তাদের শক্ত নেতৃত্ব এবং সাহায্য দরকার।

সূত্র : বিবিসি


 

ko cuce /div>

দৈনিক নয়াদিগন্তের মাসিক প্রকাশনা

সম্পাদক: আলমগীর মহিউদ্দিন
ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: সালাহউদ্দিন বাবর
বার্তা সম্পাদক: মাসুমুর রহমান খলিলী


Email: online@dailynayadiganta.com

যোগাযোগ

১ আর. কে মিশন রোড, (মানিক মিয়া ফাউন্ডেশন), ঢাকা-১২০৩।  ফোন: ৫৭১৬৫২৬১-৯

Follow Us