ইসলামি শক্তির উত্থান ও যুক্তরাষ্ট্রের মাথাব্যথা
আফগানিস্তান থেকে বিদায় নিচ্ছে মার্কিন বাহিনী - ছবি : সংগৃহীত
আফগান মুজাহিদদের হাতে রাশিয়ার পরাজয় একটি বিশেষ কারণে আমেরিকাসহ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কারণটি হলো ইসলামি চেতনা। ওই যুদ্ধে ও তার পর মুজাহিদদের নানাভাবে ম্যানিপুলেট করতে ব্যর্থ হলে তৎকালীন মার্কিন প্রসিডেন্ট নিক্সন বলেছিলেন, এখন রাশিয়ার সাথে আমেরিকার বিরোধ মিটিয়ে ফেলা প্রয়োজন, ইসলামি মৌলবাদীদের শক্তি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেই সাথে সশস্ত্র প্রতিরোধ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। এগুলো দমন করা দরকার।
স্নায়ুযুদ্ধের সময় আমেরিকানদের মুখে প্রায়ই একটা কথা শোনা যেত : ‘র্যাডিকাল ন্যাশনালিস্ট’। ওই দিনগুলোতে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষকে র্যাডিকাল ন্যাশনালিস্টদের কবল থেকে রক্ষা করা নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন ছিল আমেরিকা। আমেরিকার অস্তিত্বের প্রতি র্যাডিকাল ন্যাশনালিস্টরা কেন হুমকি, সেটা নিয়েও শোনা যেত অনেক কথা। কিন্তু ‘র্যাডিকাল ন্যাশনালিজম’ নামের এ দানব আসলে কী ছিল?
শাব্দিকভাবে এর অর্থ হয় চরমপন্থী জাতীয়তাবাদ। কিন্তু আমেরিকান সাম্রাজ্যের কাছে র্যাডিকাল শব্দের একটা বিশেষ অর্থ ছিল। র্যাডিকাল মানে হলো ‘আমাদের কথা শোনে না’। আমেরিকার আধিপত্যবাদের বিরোধিতা করা যেকোনো দেশ, দল, গোষ্ঠী কিংবা ব্যক্তি এই সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘র্যাডিকাল’। তার রক্ত হালাল।
একইভাবে সাম্রাজ্যবাদের অভিধানে বিশেষ এক অর্থ ছিল ‘আগ্রাসনের’। আগ্রাসন মানে প্রতিরোধ। সাম্রাজ্যবাদী লুটপাট, হত্যা, সামরিক অভিযান চালানো আমেরিকা শান্তিকামী, আগ্রাসী নয়। কিন্তু আমেরিকান আগ্রাসন প্রতিরোধের চেষ্টা যে করে সে অবশ্যই, অতি অবশ্যই আগ্রাসী।
স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার এই ফর্মূলা আজকের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের যুগে প্রায় হুবহু ব্যবহার করা হচ্ছে। শুধু চরমপন্থী জাতীয়তাবাদের জায়গায় বসেছে ইসলামী চরমপন্থা (র্যাডিকাল ইসলাম) আর ‘আগ্রাসন’-এর জায়গায় এসেছে ‘সন্ত্রাস’। নিজেদের চিরাচরিত উদ্ভাবনী স্বভাব বজায় রেখে এই নতুন শব্দগুলো দিয়ে আমেরিকা তৈরি করেছে ভালো-খারাপ মুসলিমের নতুন নতুন সংজ্ঞাও।
মডারেট, ‘ভালো মুসলিম’ হলো আজ্ঞাবহ মুসলিম। যে আমেরিকাকে ভয় পায়। আমেরিকা যতটুকু মেনে নেবে তার ইসলাম ততটুকুই। আমেরিকা যা পছন্দ করে না সেটা তার কাছে চরমপন্থা, সন্ত্রাস, জঙ্গিপনা। দু-বেলা দু-মুঠো খেয়ে-পরে আমেরিকার কাছ থেকে শান্তিকামী, সভ্য, ভব্য খেতাব নিয়ে রাতে নিশ্চিতে ঘুমাতে পারলেই সে খুশি। হাউস নিগার। ডিনার টেবিলের পাশে মনিবের ছুড়ে দেয়া ছিটেফোঁটা খাবারের টুকরোর জন্য উদ্গ্রীব চোখে তাকিয়ে অনবরত লেজ নাড়াতে থাকা গর্বিত, সাম্রাজ্যপ্রেমী মডারেট কুকুর।
আর র্যাডিকাল মুসলিম হলো আমেরিকার কথা না শোনা দুষ্ট মুসলিম। ওই মুসলিম, যে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ আর সন্ত্রাসবাদকে মেনে নেয় না। ইসলামের বিরুদ্ধে নব্য ক্রুসেডে যারা আমেরিকার দলে তারা মডারেট, ভালো মুসলিম। যারা আমেরিকান ক্রুসেডের বিরোধিতা করে করে তারা র্যাডিকাল, খারাপ মুসলিম।
তাছাড়া সোভিয়েত পতনের পর হান্টিংটন হাজির করে তার বিখ্যাত প্রবন্ধ সভ্যতার সংঘাত।
যেখানে তিনি আমেরিকা তথা পশ্চিমা সভ্যতার জন্য সমাজতন্ত্রের পতনের পর ইসলামকে মূল প্রতিপক্ষ হিসেবে তুলে ধরেন। হান্টিংটন ইসলামকে নিছক ধর্ম হিসেবে উপস্থাপন না করে করলেন একটা স্বতন্ত্র সভ্যতা হিসেবে। যা কিনা অন্য সব মতবাদকে খারিজ করে, সহজ কথায় মেনে নেয় না। তাছাড়া এর রয়েছে স্বতন্ত্র ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মতবাদ ও পররাষ্টনীতি। এমনকি বিশ্বব্যবস্থার এক নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি।
এটি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসে ঠান্ডাযুদ্ধের অবসানের পর। শুরু হয় ইসলামের বিরুদ্ধে আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমাদের নতুন ক্রুসেড। এই ক্রুসেড শুধু সামরিক কার্যক্রমেই সীমাবদ্ধ ছিল না। কারণ ইতিমধ্যেই তারা উপলব্ধি করতে পেরেছে যে বায়তুল মাকদিসকে কেন্দ্র করে যতগুলো সামরিক ক্রুসেড ইউরোপীয়রা মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল তার ফলাফল তাদের ওপরই চরম হতাশার আর লজ্জা ছাড়া কিছুই দিতে পারেনি।অপর দিকে মুসলিমরা হয়েছে সংগঠিত ও সুসংহত। তাদের মানসপটে সালাহুদ্দিন আইয়ুবী আর রুকুনউদ্দীন বাইবার্স এখনো মূর্তিমান আতঙ্ক। এরই ধারাবাহিকতায় তারা শুরু করে বহুমুখী ক্রুসেড যুদ্ধ : তথ্য সন্ত্রাস, মুসলিমদের মাঝে গোত্রীয় সংঘাতকে উস্কে দেয়া ও জাতীয়তাবাদ চেতনার বিভেদের দেয়ালের মাধ্যমে মুসলমানদের পৃথক রাখা, ইসলাম সম্পর্কে ভীতিকর বয়ান বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়া।
রাশিয়া যখন কোনো প্রকার চুক্তিছাড়াই পাত্তারি গুটায়, তখন আমেরিকা জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে যখন ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করে আসছিল নজিবুল্লাহর সাথে জোট সরকার গঠন করতে মুজাহিদ নেতাদের। কিন্তু তারা কারো কথায় কর্ণপাত করেনি। উল্টা কাবুল যখন অস্ত্রের মুখে পতন ঘটায় তখন নাজিবুল্লাহকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করে। এ সমস্ত বিষয়ই মুজাহিদদের ব্যাপারে আমেরিকাকে ভীতসন্ত্রস্ত করে। এ থেকেই আফগানিস্তানকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করতে থাকে আমেরিকা।
৯/১১-এর আগে তা ছিল মূলত তথ্যসন্ত্রাস। যেমন আফগান-সোভিয়েত যুদ্ধকে পশ্চিমা মিডিয়া দুই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির গ্রেট গেম হিসেবে তুলে ধরে। এই যুদ্ধ যে কমিউনিজমের বিরুদ্ধে ইসলামের সশস্ত্র (জিহাদ) সংঘাত তা তারা সুকৌশলে পাশ কাটিয়ে যায়, যাতে মুসলিম মানসে আফগান জিহাদ যে প্রভাব বিস্তার করেছে, তাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা যায়।
কারণ আমেরিকাসহ পশ্চিমারা সহজেই উপলব্ধি করতে পেরেছে যে ১৯২৪ সালে উসমানি খিলাফতের পতনের পর মুসলিমরা বারবার উঠে দাড়াতে চেয়েছে, কিন্তু পশ্চিমাদের সামরিক অপরাজেয় শক্তির মিথ মুসলিম মানসকে শৃঙ্খলিত করে রেখেছে দীর্ঘ অর্ধশতক ধরে।
কিন্তু আফগান জিহাদে সেই মিথ ভেঙ্গে যায়। যেখানে বিশ্বপরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আফগানিস্তানের মতো একটা অনুন্নত, গরিব এবং তৃতীয় সারির দেশ যুদ্ধে নেমে পড়ে। অবশেষে সেই যুদ্ধ রূপ নেয় ইসলামের পবিত্র জিহাদে। তৎকালীন রাশিয়া ছিল সমাজতান্ত্রিক আদর্শের নাস্তিকবাদী, সমানভাবে ইসলামবিদ্বেষী চরিত্রে চিত্রিত। কারণ মধ্যে এশিয়া নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ধর্মকর্ম পালন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এতে তেমন কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই তাদের উপর আধিপত্য বজায় রেখে আফগানিস্তান হয়ে পাকিস্তান, এরপর ভারত মহাসাগরের প্রবেশের জন্য সব কিছু প্লান মতোই করতে থাকে।
কিন্তু আফগানিস্তানে তাদের যাত্রা এভাবে থেমে যাবে তা হয়ত শুধু রাশিয়া নয় স্বয়ং আমেরিকাও কল্পনা করতে পারেনি।
আফগান জিহাদকে আঞ্চলিক জিহাদ থেকে বৈশ্বিক জিহাদে নিয়ে আসতে যে ব্যক্তির অবদান অনস্বীকার্য তিনি হলেন ফিলিস্তিন বংশোদ্ভূত আরব ড. আব্দুল্লাহ আযযাম।
তার খুরধার লেখনি আর যুক্তিপূর্ণ বয়ানে দলে দলে আরব ধনকুবের যুবক শহীদি তামান্না নিয়ে হিজরত করে চলে আসে আফগানিস্তানের পাহাড়ি গুহায়। এদের একজন ছিলেন ওসামা বিন লাদেন।
আফগান জিহাদকে আমেরিকা যখন নিজের আয়ত্তে আর রাখতে পারল না এবং প্রপাগান্ডায় তেমন সফল হচ্ছিল না, তখন এই জিহাদের দুই প্রাণপুরুষ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হককে বিমান দুর্ঘটনায় হত্যা করা হয়। কারণ জিয়াউল হক এই জিহাদের প্রতি যেমন ছিলেন আন্তরিক, তেমনি নিজ দেশেও শরীয়াহ প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি ছিলেন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির।
এরপর আফগান জিহাদের অপর প্রাণ পুরুষ ড.আব্দুল্লাহ আযযামকেও গাড়ি বোমা হামলা করে তার দুই ছেলেসহ হত্যা করে ফেলে এই আমেরিকা।
এর পর আমেরিকার সিআইএ ও মোসাদের পরোক্ষ সহযোগিতায় পাকিস্তানের ক্ষমতায় বসেন বেনজির ভুট্টু। এবং আমেরিকার পুতুল হিসেবে কাজ করতে থাকেন। সব জিহাদি ক্যাম্প বন্ধ করে দেয়া হয় তার আমলে। এমনকি আফগানিস্তানের সাথে বর্ডার বন্ধ করে দেন তিনি। মুজাহিদিনদের সহযোগিতা তো দূরে থাক তাদের বিরুদ্ধে আমেরিকার আঞ্চলিক এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন।
এদিকে আফগানিস্তানের ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক জিহাদি গ্রুপগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব-কোন্দল হিংসাত্মক নৈরাজ্য তৎপরতা সৃষ্টি হয়। এই সুযোগেই আফগান জিহাদকে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরে পশ্চিমা মিডিয়াগুলো। ক্ষেত্র বিশেষ বিভিন্ন ফেক ভিডিও ছড়িয়ে দিয়ে মুজাহিদদের নানা অপকর্মের মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে মানুষকে জিহাদের ব্যাপারে বীতশ্রদ্ধ করে তুলতে সক্ষম হয়।
এরই মধ্যে অভ্যন্তরীণ অরাজকতাকে দমন করতে দৃশ্যপটে আসেন সোভিয়েতবিরোধী জিহাদে অংশ নেয়া কমান্ডার মোল্লা মুহাম্মদ ওমর মুজাহিদ।
তার নেতৃত্বে তালেবানের উত্থান হয়ে সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটে। আফগান জনগণের প্রাণের আকুতি যার জন্য এত ত্যাগ- তিনি ইসলামি শরিয়াহ শাসন কায়েম করেন। মাত্র চার বছরের কম সময়ে আফগান ভূমির ৯৫ ভাগ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে শান্তি, নিরাপত্তা আর ন্যায় বিচার।
তালেবানের উত্থানে বলা হয়ে থাকে পাকিস্তানের আইএসআই তেমন কোনো সমস্যা সৃষ্টি করেনি। ক্ষেত্র বিশেষ সহযোগিতা করে বলে অনেকেই মনে করে থাকেন। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের তালেবান প্রীতির চেয়ে নিজ দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা এবং সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। কারণ ভারতের অতি আগ্রাসী পাকিস্তাননীতি এর অন্যতম প্রধান কারণ। যেহেতু আফগানিস্তানের শান্তি স্থিতিশিলতা প্রতিষ্ঠিত হলে ভারতের প্রভাব খর্ব করা পাকিস্তানের জন্য সহজ হবে। তাই পাকিস্তান যেমন আমেরিকার সাথেও ছিল তেমনি নিজের স্বার্থে অনেক কিছুই তাকে আমেরিকার অগোচরে করতে হয়েছে। এছাড়া তেহরিকে তালেবানকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যও পাকিস্তানকে ক্ষেত্রবিশেষে ডাবল এজেন্ট হিসেবে কাজ করতে হয়েছে। যাই হোক সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু কেউ যেন একথা না বলে পাকিস্তান তালেবানকে নিজেদের স্বার্থেই চাইলেই ব্যবহার করতে পারবে। ক্ষেত্র বিশেষ এটা তাদের জন্য বুমেরাং হয়ে যেতে পারে।
তালেবানের উত্থান নতুন সমীকরণ সামনে নিয়ে আসে সেই সাথে আল কায়েদার বৈশ্বিক জিহাদি তৎপরতা। আমেরিকার প্রতি খোলা চিঠি দেয় সংগঠনটি। প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সৌদি আরবের আমন্ত্রণে আমেরিকান সেনা মধ্যপ্রাচ্য প্রবেশ করে। যা ছিল রাসূল সা.-এর করা নির্দেশের স্পষ্ট পরিপন্থী। সকল সৈন্য প্রত্যাহার করাসহ আরব দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ না করার আহ্বান জানায় সংগঠনটি। ইসরাইলকে ফিলিস্তিনের বিপক্ষে সহায়তা করতে নিষেধ করার কথাও বলা হয়। তা না করলে মার্কিন স্বার্থে সামরিক হামলা চালানোর হুমকি দেয়া হয়।
এই সমস্ত প্রেক্ষাপটে তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন তালেবানের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তালেবান সরকার তাতে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। এমনকি তাদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে আমেরিকান কোনো কোম্পানিকে বিনিয়োগের নূন্যতম সুযোগ দিতেও তালেবান রাজি ছিল না। কারণ তালেবান আমেরিকাকে শুরু থেকেই সন্দেহের চোখে দেখত। এমনকি ইউনিকোল কোম্পানির গ্যাস পাইপলাইন নিয়ে তালেবান সরকারের সাথে কোনো অবস্থাতেই সমঝোতায় পৌছাতে ব্যর্থ হয়ে তালেবানকে সামরিক হামলার হুমকি পর্যন্ত দিতে থাকে আমেরিকা।
অনেকেই বলে থাকে, তালেবানের এমন আচরণের কারণেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে সামরিক হামলার বাহানার সুযোগ খুঁজতে থাকে। এর মধ্যেই ঘটে যায় ইতিহাসের দৃশ্যপট পরিবর্তনের অকল্পনীয় ৯/১১-এর টুইন টাওয়ার হামলার ঘটনা। এর আগেও সুদান, কেনিয়া, তানজানিয়া, সোমালিয়াসহ অনেক দেশে মার্কিন দূতাবাসে এবং মার্কিন স্বার্থে হামলার ঘটনা ঘটে।
কিন্তু ৯/১১সহ সকল হামলা কোন অদৃশ্য শক্তির ইশারায় হচ্ছে তা হয়ত সিআইএ অনুমান করতে পেরেছিল। কিন্তু তাদের হাতে যথেষ্ট প্রমাণ ছিল না, যা কোনো ব্যক্তি, গোষ্ঠি বা রাষ্ট্রকে দায়ী করার জন্য যথেষ্ট ।
কিন্তু ৯/১১ হামলা তাদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটায়। এটা ছিল প্রতাপশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গালে চপেটাঘাত করার সমান। কারণ তারাই বলে বেড়ায় যে তারা বিশ্বে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। যদিও এই নিরাপত্তার আওতায় কোনো মুসলিম ভূখণ্ড ছিল না। উল্টা মুসলিম ভূখণ্ডে দস্যুবৃত্তি চালাত সহযোগী পশ্চিমাদের সাথে নিয়ে।
আফ্রিকার খনিজসম্পদে ভরা মুসলিম দেশগুলোকে শোষণ করে আসছে স্বাধীনতা, সভ্যতার বুলি আউরিয়ে। ফিলিস্তিনে বুকে আগুন জ্বলছে প্রায় শতাব্দী ধরে, ইউরোপের মুসলিম ভুখণ্ডে মুসলমানদের রক্তে হলি খেলা শুরু করেছে নব্য ক্রুসেডাররা। অথচ শান্তি নিরাপত্তার ধব্জাধারী জাতিসঙ্ঘের কোনো হাঁকডাক চোখে পড়ত না।
এই দীর্ঘ প্রায় এক শ' বছরের মধ্যে মুসলিদের কোনো অর্জন চোখে পড়ে না। সামরিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক আর না আছে জ্ঞানে বিজ্ঞানে। তাদের আষ্টেপৃষ্টে যেন বেঁধে রেখে বলা হচ্ছে তোমরা স্বাধীন। নিষ্ঠাবান মুসলিম নেতা, বিজ্ঞানী, সমাজবিজ্ঞানী, রাজনৈতিক কর্মীরা, কেউ রেহাই পায়নি মোসাদের প্রত্যেক্ষ সহযোগিতায় টার্গেট কিলিং থেকে। মুসলিমদের নেতৃত্বহীন করে রাখাই তাদের প্রধান এজেন্ডা। সেই সাথে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে সামাজিক সাংস্কৃতিক আগ্রাসন তাদের প্রণীত শিক্ষাব্যবস্থা। এত সব অনাচার কোনো সচেতন মুসলিমের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব না। আর এই সমস্যাগুলো তাদের প্রণীত পুঁজিবাদী গণতন্ত্র কিংবা লিবারেল দর্শনের ফ্রেমওয়ার্ক দিয়েও সমাধান করা সম্ভব না।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, জাহেলিয়াতের সময়কালে আরবরা খেজুর দিয়ে মূর্তি তৈরি করত। কিন্তু ক্ষুধা লাগলে ওই মূর্তি তারা নিজেই ভেঙে খেয়ে ফেলত। তেমনি পশ্চিমারা মুসলিম ভুখণ্ডে তাদের প্রণীত গণতন্ত্র, পুঁজিবাদ, স্বাধীনতার কথা বললেও যখন এই সমস্ত ফ্রেমওয়ার্কের মধ্য দিয়েই কোনো একনিষ্ঠ মুসলিম নেতা শাসক নির্বাচিত হতেন, তখন আমেরিকা নানা ষড়যন্ত্র করে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা আর পুঁজিবাদকে খেয়ে ফেলত। আর তাদের গোলামিতে সন্তুষ্ট এমন কাউকে যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় নিয়ে আসত। ৯০-এর দশকে তিউনিসিয়ায় আন নাহদা পার্টিকে হটিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় বসায় পশ্চিমা পাপেট সেনা প্রধানকে। সাম্প্রতিক সময়ে মিসরে মুরসিকে হটিয়ে ক্ষমতায় বসায় পাপেট সিসিকে। এছাড়াও বিশ্বের সকল অত্যাচারী স্বৈরশাসক ও রাজতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রেখেছে আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমারা।
যাই হোক ৯/১১-এর হামলা ছিল বিগত এক শ' বছরের মধ্যে মুসলিদের পক্ষ থেকে পশ্চিমাদের জন্য সামান্য উপহার, যদিও এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের মিথ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ ঘোষণ করেন সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের। তিনি আরো ঘোষণা করেন, যারা এই যুদ্ধে তাদের সাথে থাকবে না তারা মার্কিনিদের শত্রু হিসেবে গণ্য হবে। এখানে নিরপেক্ষ থাকার কোনো সুযোগ নেই। অর্থাৎ ইসলামের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ ঘোষণা।
প্রথমে মার্কিন প্রশাসন তালেবানের প্রধান মোল্লা মুহাম্মদ ওমরের কাছে বার্তা পাঠায় ওসামা বিন লাদেনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিতে। কিন্তু আত্মমর্যাদাবান মোল্লা ওমর তা অস্বীকার করেন। অবশেষে ৭ অক্টোবর আমেরিকা শুরু করে এক যুদ্ধ, যা দীর্ঘ ২০ বছর ধরে চলে। কিন্তু তারা সাময়িক সময়ের জন্য তালেবান সরকারকে উৎখাত করতে পারলেও ২০ বছর পর এসে দেখা যায়, তালেবান আগের চেয়ে আরো শক্তিশালী। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক রাজনীতিতে এবং কূটনৈতিকভাবে নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ তারা যথাযথভাবে দিয়ে যাচ্ছে। অবশেষে ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারিতে কাতারে রাজধানী দোহায় সকল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উপস্থিতিতে মার্কিনিদের সাথে তালেবানের শান্তি চুক্তি হয় ট্রাম্প প্রশাসনের।
বাইডেন ক্ষমতায় আসার পরও ওই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার ধৃষ্ঠতা দেখানোর সাহস করেনি। ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১-এর মধ্যে সকল সৈন্য প্রত্যাহারে বাইডেন প্রশাসন তালেবানের সাথে একমত হয়। ইতিমধ্যেই ৯০ শতাংশ সেনা সদস্যদের ফিরিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছে।
এদিকে তালেবানের ক্রমাগত হামলায় কাবুল সরকার যথেষ্ট বেকায়দায় আছে। অভ্যন্তরীণ শান্তি আলোচনা ফলপ্রসূ না হওয়া উভয় পক্ষই জড়িয়ে পড়েছে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। সেই সাথে চলমান রয়েছে কূটনৈতিক যুদ্ধ। আশরাফ গনি এরই মধ্যে বাইডেনের সাথে চলমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলার জন্য হোয়াইট হাউস সফর করেছেন। কিন্তু বাইডেন তাকে খুশির সংবাদ দিতে পারেনি। যেকোনো মূল্যে সেনা প্রত্যাহার বাইডেনের প্রাথমিক লক্ষ্য হিসেবে উল্লেখ করে হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারি। সান্ত্বনা স্বরূপ অর্থ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা কতটা বাস্তবতায় রূপ নেবে বলা মুশকিল। যুদ্ধে কাবুল রিজিমের চেয়ে বহুগুণ এগিয়ে তালেবান বিদ্রোহীরা।
সর্বশেষ আপডেট অনুযায়ী দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকা আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্তিতি তুলে ধরেছে।
দখলে রয়েছে :
কাবুল রেজিম : ৭৪ জেলা।
তালিবান : ১৯৭ জেলা।
কনটেস্টেড : ১২৭ জেলা।
প্রাদেশিক রাজ্যগুলো কাবুল রেজিমের দখলে। তবে ১০টার মতো প্রাদেশিক রাজধানী অবরুদ্ধ। যেকোনো সময় বেদখল হয়ে যাবে।
পত্রিকায় দেখানো ম্যাপের গাঢ় লাল অঞ্চল তালিবানের দখলে। হালকা লাল অঞ্চল কনটেস্টেড (দুই গ্রুপের অবস্থান আছে)। আর বাকি কালো অঞ্চল কাবুল অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের দখলে।
ম্যাপের মাঝের বিস্তৃত কালো অঞ্চল হলো মাইনোরিটি হাজারাদের। কৌশলগত কারণে এই অঞ্চল যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে রয়েছে। হাজারাদের সিকিউরিটির নিশ্চয়তা দিয়েছে তালিবান। এছাড়া বাগরাম বিমান ঘাঁটি রাতের আঁধারে ছেড়ে যাওয়াকে কাপুরুষের কাজ বলে আখ্যাায়িত করেছেন বাগরাম ছেড়ে যাওয়ার পর এর দায়িত্ব নেয়া কমান্ডার আব্দল্লাহ কোহেস্তানি। সবশেষে পশতুন ভাষায় একটি প্রবাদের কথা বলে শেষ করছি 'ঘড়ি তোমাদের হাতে থাকলেও সময় আমাদের হাতে।'
তথ্যসূত্র :
চিন্তাপরাধ- আসিফ আদনান
আরব্য রজনীর নতুন অধ্যায়
দ্যা ইকোনোমিস্ট
আল-জাজিরা
লেখক : সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
merajislam920@gmail.com