'মডারেট মুসলিম' কেন আমেরিকার পছন্দের শব্দ
ইবাদতরত মুসলিম - ছবি : সংগৃহীত
একইভাবে সাম্রাজ্যবাদের অভিধানে বিশেষ এক অর্থ ছিল ‘আগ্রাসনের’। আগ্রাসন মানে প্রতিরোধ। সাম্রাজ্যবাদী লুটপাট, হত্যা, সামরিক অভিযান চালানো আমেরিকা শান্তিকামী, আগ্রাসী নয়। কিন্তু আমেরিকান আগ্রাসন প্রতিরোধের চেষ্টা যে করে সে অবশ্যই, অতি অবশ্যই আগ্রাসী।
স্নায়ুযুদ্ধের সময়কার এই ফর্মূলা আজকের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের যুগে প্রায় হুবহু ব্যবহার করা হচ্ছে। শুধু চরমপন্থী জাতীয়তাবাদের জায়গায় বসেছে ইসলামী চরমপন্থা (র্যাডিকাল ইসলাম) আর ‘আগ্রাসন’-এর জায়গায় এসেছে ‘সন্ত্রাস’। নিজেদের চিরাচরিত উদ্ভাবনী স্বভাব বজায় রেখে এই নতুন শব্দগুলো দিয়ে আমেরিকা তৈরি করেছে ভালো-খারাপ মুসলিমের নতুন নতুন সংজ্ঞাও।
মডারেট, ‘ভালো মুসলিম’ হলো আজ্ঞাবহ মুসলিম। যে আমেরিকাকে ভয় পায়। আমেরিকা যতটুকু মেনে নেবে তার ইসলাম ততটুকুই। আমেরিকা যা পছন্দ করে না সেটা তার কাছে চরমপন্থা, সন্ত্রাস, জঙ্গিপনা। দু-বেলা দু-মুঠো খেয়ে-পরে আমেরিকার কাছ থেকে শান্তিকামী, সভ্য, ভব্য খেতাব নিয়ে রাতে নিশ্চিতে ঘুমাতে পারলেই সে খুশি। হাউস নিগার। ডিনার টেবিলের পাশে মনিবের ছুড়ে দেয়া ছিটেফোঁটা খাবারের টুকরোর জন্য উদ্গ্রীব চোখে তাকিয়ে অনবরত লেজ নাড়াতে থাকা গর্বিত, সাম্রাজ্যপ্রেমী মডারেট কুকুর।
আর র্যাডিকাল মুসলিম হলো আমেরিকার কথা না শোনা দুষ্ট মুসলিম। ওই মুসলিম, যে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ আর সন্ত্রাসবাদকে মেনে নেয় না। ইসলামের বিরুদ্ধে নব্য ক্রুসেডে যারা আমেরিকার দলে তারা মডারেট, ভালো মুসলিম। যারা আমেরিকান ক্রুসেডের বিরোধিতা করে করে তারা র্যাডিকাল, খারাপ মুসলিম।
তাছাড়া সোভিয়েত পতনের পর হান্টিংটন হাজির করে তার বিখ্যাত প্রবন্ধ সভ্যতার সংঘাত।
যেখানে তিনি আমেরিকা তথা পশ্চিমা সভ্যতার জন্য সমাজতন্ত্রের পতনের পর ইসলামকে মূল প্রতিপক্ষ হিসেবে তুলে ধরেন। হান্টিংটন ইসলামকে নিছক ধর্ম হিসেবে উপস্থাপন না করে করলেন একটা স্বতন্ত্র সভ্যতা হিসেবে। যা কিনা অন্য সব মতবাদকে খারিজ করে, সহজ কথায় মেনে নেয় না। তাছাড়া এর রয়েছে স্বতন্ত্র ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মতবাদ ও পররাষ্টনীতি। এমনকি বিশ্বব্যবস্থার এক নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি।
এটি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসে ঠান্ডাযুদ্ধের অবসানের পর। শুরু হয় ইসলামের বিরুদ্ধে আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমাদের নতুন ক্রুসেড। এই ক্রুসেড শুধু সামরিক কার্যক্রমেই সীমাবদ্ধ ছিল না। কারণ ইতিমধ্যেই তারা উপলব্ধি করতে পেরেছে যে বায়তুল মাকদিসকে কেন্দ্র করে যতগুলো সামরিক ক্রুসেড ইউরোপীয়রা মুসলমানদের উপর চাপিয়ে দিয়েছিল তার ফলাফল তাদের ওপরই চরম হতাশার আর লজ্জা ছাড়া কিছুই দিতে পারেনি।অপর দিকে মুসলিমরা হয়েছে সংগঠিত ও সুসংহত। তাদের মানসপটে সালাহুদ্দিন আইয়ুবী আর রুকুনউদ্দীন বাইবার্স এখনো মূর্তিমান আতঙ্ক। এরই ধারাবাহিকতায় তারা শুরু করে বহুমুখী ক্রুসেড যুদ্ধ : তথ্য সন্ত্রাস, মুসলিমদের মাঝে গোত্রীয় সংঘাতকে উস্কে দেয়া ও জাতীয়তাবাদ চেতনার বিভেদের দেয়ালের মাধ্যমে মুসলমানদের পৃথক রাখা, ইসলাম সম্পর্কে ভীতিকর বয়ান বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়া।
রাশিয়া যখন কোনো প্রকার চুক্তিছাড়াই পাত্তারি গুটায়, তখন আমেরিকা জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে যখন ক্রমাগত চাপ প্রয়োগ করে আসছিল নজিবুল্লাহর সাথে জোট সরকার গঠন করতে মুজাহিদ নেতাদের। কিন্তু তারা কারো কথায় কর্ণপাত করেনি। উল্টা কাবুল যখন অস্ত্রের মুখে পতন ঘটায় তখন নাজিবুল্লাহকে প্রকাশ্যে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করে। এ সমস্ত বিষয়ই মুজাহিদদের ব্যাপারে আমেরিকাকে ভীতসন্ত্রস্ত করে। এ থেকেই আফগানিস্তানকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করতে থাকে আমেরিকা।
৯/১১-এর আগে তা ছিল মূলত তথ্যসন্ত্রাস। যেমন আফগান-সোভিয়েত যুদ্ধকে পশ্চিমা মিডিয়া দুই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির গ্রেট গেম হিসেবে তুলে ধরে। এই যুদ্ধ যে কমিউনিজমের বিরুদ্ধে ইসলামের স্ব-সশস্ত্র (জিহাদ) সংঘাত তা তারা সুকৌশলে পাশ কাটিয়ে যায়, যাতে মুসলিম মানসে আফগান জিহাদ যে প্রভাব বিস্তার করেছে, তাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা যায়।
কারণ আমেরিকাসহ পশ্চিমারা সহজেই উপলব্ধি করতে পেরেছে যে ১৯২৪ সালে উসমানি খিলাফতের পতনের পর মুসলিমরা বারবার উঠে দাড়াতে চেয়েছে, কিন্তু পশ্চিমাদের সামরিক অপরাজেয় শক্তির মিথ মুসলিম মানসকে শৃঙ্খলিত করে রেখেছে দীর্ঘ অর্ধশতক ধরে।
কিন্তু আফগান জিহাদে সেই মিথ ভেঙ্গে যায়। যেখানে বিশ্বপরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং আফগানিস্তানের মতো একটা অনুন্নত, গরিব এবং তৃতীয় সারির দেশ যুদ্ধে নেমে পড়ে। অবশেষে সেই যুদ্ধ রূপ নেয় ইসলামের পবিত্র জিহাদে। তৎকালীন রাশিয়া ছিল সমাজতান্ত্রিক আদর্শের নাস্তিকবাদী, সমানভাবে ইসলামবিদ্বেষী চরিত্রে চিত্রিত। কারণ মধ্যে এশিয়া নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন ধর্মকর্ম পালন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এতে তেমন কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই তাদের উপর আধিপত্য বজায় রেখে আফগানিস্তান হয়ে পাকিস্তান, এরপর ভারত মহাসাগরের প্রবেশের জন্য সব কিছু প্লান মতোই করতে থাকে।
কিন্তু আফগানিস্তানে তাদের যাত্রা এভাবে থেমে যাবে তা হয়ত শুধু রাশিয়া নয় স্বয়ং আমেরিকাও কল্পনা করতে পারেনি।
আফগান জিহাদকে আঞ্চলিক জিহাদ থেকে বৈশ্বিক জিহাদে নিয়ে আসতে যে ব্যক্তির অবদান অনস্বীকার্য তিনি হলেন ফিলিস্তিন বংশোদ্ভূত আরব ড. আব্দুল্লাহ আযযাম।
তার খুরধার লেখনি আর যুক্তিপূর্ণ বয়ানে দলে দলে আরব ধনকুবের যুবক শহীদি তামান্না নিয়ে হিজরত করে চলে আসে আফগানিস্তানের পাহাড়ি গুহায়। এদের একজন ছিলেন ওসামা বিন লাদেন।