ড. আব্দুল্লাহ আযযাম ও আফগানিস্তানের পরিবর্তন
ড. আব্দুল্লাহ আযযাম - ছবি : সংগৃহীত
আফগান জিহাদকে আঞ্চলিক জিহাদ থেকে বৈশ্বিক জিহাদে নিয়ে আসতে যে ব্যক্তির অবদান অনস্বীকার্য তিনি হলেন ফিলিস্তিন বংশোদ্ভূত আরব ড. আব্দুল্লাহ আযযাম।
তার খুরধার লেখনি আর যুক্তিপূর্ণ বয়ানে দলে দলে আরব ধনকুবের যুবক শহীদি তামান্না নিয়ে হিজরত করে চলে আসে আফগানিস্তানের পাহাড়ি গুহায়। এদের একজন ছিলেন ওসামা বিন লাদেন।
আফগান জিহাদকে আমেরিকা যখন নিজের আয়ত্তে আর রাখতে পারল না এবং প্রপাগান্ডায় তেমন সফল হচ্ছিল না, তখন এই জিহাদের দুই প্রাণপুরুষ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হককে বিমান দুর্ঘটনায় হত্যা করা হয়। কারণ জিয়াউল হক এই জিহাদের প্রতি যেমন ছিলেন আন্তরিক, তেমনি নিজ দেশেও শরীয়াহ প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি ছিলেন ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির।
এরপর আফগান জিহাদের অপর প্রাণ পুরুষ ড.আব্দুল্লাহ আযযামকেও গাড়ি বোমা হামলা করে তার দুই ছেলেসহ হত্যা করে ফেলে এই আমেরিকা।
এর পর আমেরিকার সিআইএ ও মোসাদের পরোক্ষ সহযোগিতায় পাকিস্তানের ক্ষমতায় বসেন বেনজির ভুট্টু। এবং আমেরিকার পুতুল হিসেবে কাজ করতে থাকেন। সব জিহাদি ক্যাম্প বন্ধ করে দেয়া হয় তার আমলে। এমনকি আফগানিস্তানের সাথে বর্ডার বন্ধ করে দেন তিনি। মুজাহিদিনদের সহযোগিতা তো দূরে থাক তাদের বিরুদ্ধে আমেরিকার আঞ্চলিক এজেন্ট হিসেবে কাজ করেন।
এদিকে আফগানিস্তানের ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক জিহাদি গ্রুপগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব-কোন্দল হিংসাত্মক নৈরাজ্য তৎপরতা সৃষ্টি হয়। এই সুযোগেই আফগান জিহাদকে নেতিবাচকভাবে তুলে ধরে পশ্চিমা মিডিয়াগুলো। ক্ষেত্র বিশেষ বিভিন্ন ফেক ভিডিও ছড়িয়ে দিয়ে মুজাহিদদের নানা অপকর্মের মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছড়িয়ে মানুষকে জিহাদের ব্যাপারে বীতশ্রদ্ধ করে তুলতে সক্ষম হয়।
এরই মধ্যে অভ্যন্তরীণ অরাজকতাকে দমন করতে দৃশ্যপটে আসেন সোভিয়েতবিরোধী জিহাদে অংশ নেয়া কমান্ডার মোল্লা মুহাম্মদ ওমর মুজাহিদ।
তার নেতৃত্বে তালেবানের উত্থান হয়ে সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটে। আফগান জনগণের প্রাণের আকুতি যার জন্য এত ত্যাগ- তিনি ইসলামি শরিয়াহ শাসন কায়েম করেন। মাত্র চার বছরের কম সময়ে আফগান ভূমির ৯৫ ভাগ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে শান্তি, নিরাপত্তা আর ন্যায় বিচার।
তালেবানের উত্থানে বলা হয়ে থাকে পাকিস্তানের আইএসআই তেমন কোনো সমস্যা সৃষ্টি করেনি। ক্ষেত্র বিশেষ সহযোগিতা করে বলে অনেকেই মনে করে থাকেন। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের তালেবান প্রীতির চেয়ে নিজ দেশের ভৌগোলিক অখণ্ডতা এবং সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি আমার কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। কারণ ভারতের অতি আগ্রাসী পাকিস্তাননীতি এর অন্যতম প্রধান কারণ। যেহেতু আফগানিস্তানের শান্তি স্থিতিশিলতা প্রতিষ্ঠিত হলে ভারতের প্রভাব খর্ব করা পাকিস্তানের জন্য সহজ হবে। তাই পাকিস্তান যেমন আমেরিকার সাথেও ছিল তেমনি নিজের স্বার্থে অনেক কিছুই তাকে আমেরিকার অগোচরে করতে হয়েছে। এছাড়া তেহরিকে তালেবানকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যও পাকিস্তানকে ক্ষেত্রবিশেষে ডাবল এজেন্ট হিসেবে কাজ করতে হয়েছে। যাই হোক সেটা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু কেউ যেন একথা না বলে পাকিস্তান তালেবানকে নিজেদের স্বার্থেই চাইলেই ব্যবহার করতে পারবে। ক্ষেত্র বিশেষ এটা তাদের জন্য বুমেরাং হয়ে যেতে পারে।
তালেবানের উত্থান নতুন সমীকরণ সামনে নিয়ে আসে সেই সাথে আল কায়েদার বৈশ্বিক জিহাদি তৎপরতা। আমেরিকার প্রতি খোলা চিঠি দেয় সংগঠনটি। প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধকে কেন্দ্র করে সৌদি আরবের আমন্ত্রণে আমেরিকান সেনা মধ্যপ্রাচ্য প্রবেশ করে। যা ছিল রাসূল সা.-এর করা নির্দেশের স্পষ্ট পরিপন্থী। সকল সৈন্য প্রত্যাহার করাসহ আরব দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো হস্তক্ষেপ না করার আহ্বান জানায় সংগঠনটি। ইসরাইলকে ফিলিস্তিনের বিপক্ষে সহায়তা করতে নিষেধ করার কথাও বলা হয়। তা না করলে মার্কিন স্বার্থে সামরিক হামলা চালানোর হুমকি দেয়া হয়।
এই সমস্ত প্রেক্ষাপটে তৎকালীন মার্কিন প্রশাসন তালেবানের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে তালেবান সরকার তাতে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। এমনকি তাদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে আমেরিকান কোনো কোম্পানিকে বিনিয়োগের নূন্যতম সুযোগ দিতেও তালেবান রাজি ছিল না। কারণ তালেবান আমেরিকাকে শুরু থেকেই সন্দেহের চোখে দেখত। এমনকি ইউনিকোল কোম্পানির গ্যাস পাইপলাইন নিয়ে তালেবান সরকারের সাথে কোনো অবস্থাতেই সমঝোতায় পৌছাতে ব্যর্থ হয়ে তালেবানকে সামরিক হামলার হুমকি পর্যন্ত দিতে থাকে আমেরিকা।